আরিফ সাওন: রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী রাইদাহ গালিবা। মাত্র ৬ বছর বয়স থেকেই শুরু করে গল্প লেখা। পরিচিতি পেয়েছে শিশুসাহিত্যিক হিসেবে। এ পর্যন্ত তার চারটি গল্পের বই প্রকাশ হয়েছে। এবারের বইমেলায়ও ছিল তার নতুন বই ‘ভয়ের গাছ’। তবে রাইদাহ এ বইটি স্পর্শ করতে পারেনি। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নেয়ার আগেই মাত্র ১২ বছর বয়সে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত বছর ৩০ নভেম্বর গভীর রাতে ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।
অভিযোগ উঠেছে, চিকিৎসকের অবহেলা ও গাফিলতির কারণে মেধাবী এ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। গত বছর ১৪ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে এ অভিযোগ করেছেন শিশুটির মা কানিজ কুলসুম। এ অভিযোগ তদন্তে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. সাইফুল্লাহিল আজমকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
তদন্ত বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত সচিব মো. সাইফুল্লাহিল আজম ভোরের আকাশকে বলেন, তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ হলে শাস্তি দেয়া হবে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এছাড়া তদন্ত কমিটির সদস্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনকসমূহ) ডা. শেখ দাউদ আদনান ভোরের আকাশকে বলেন, এ অভিযোগটির বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে তাকে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। যেহেতু বিষয়টি তদন্তাধীন পর্যায়ে রয়েছে, তাই তিনি কোনো মন্তব্য করতে পারছেন না। তবে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে সম্প্রতি অধ্যাপক ডা. এফএম সিদ্দিকীকে তার মোবাইল ফোনে কয়েকবার ফোন করা হয়। এছাড়া তার হোয়াটসঅ্যাপেও এসএমএস করা হয়। তবে তিনি সাড়া দেননি।
অভিযোগে বলা হয়, ‘ডেঙ্গু চিকিৎসায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ফ্লুইড ব্যবস্থাপনা। কিন্তু অধ্যাপক সিদ্দিকী রোগীর উচ্চতা ও ওজন অনুসারে স্যালাইন ও ফ্লইডের ব্যবস্থা না করে মুখে খাওয়ার সুপ, জুস, ডাবের পানি বন্ধ করে দেন। ২০২২ সালের ২৮ ও ২৯ নভেম্বরের হাসপাতালের বিলে এ-সংক্রান্ত প্রমাণ রয়েছে। ৩০ নভেম্বর ভোরে রোগীর রক্তক্ষরণ শুরু হলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকদের জানানো হয়। তবে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি। হাসপাতালের প্রদত্ত টেস্ট রিপোর্ট ও বিলে এর প্রমাণ রয়েছে। এমনকি হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজে এর প্রমাণ মিলবে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
২৮ থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত রোগীর হিমোগ্লোবিন ও পিভিসি লেভেলে রোগীর রিস্ক সাইন স্পষ্ট ছিল। কিন্তু ফ্লুইড বাড়ানো, রক্তচাপ দেখা ইত্যাদি ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দুদিনে মাত্র দুবার এক থেকে ২ মিনিটের জন্য ডা. সিদ্দিকী রোগীকে দেখতে আসেন।
এ সময়ে তিনি পরীক্ষার রিপোর্ট, শারীরিক অবস্থা, প্রেশার, তাপমাত্রা, প্ল্যাটিলেট কাউন্ট, ইউরিন আউটপুট, হিমো কন্সেন্ট্রশন, পিভিসি লেভেল জানার ও সেই অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান- কোনো ব্যবস্থা তিনি করেননি। একইসঙ্গে রোগীর চিকিৎসায় অধ্যাপক সিদ্দিকী ও তার পুরো চিকিৎসক দলের চরম অবহেলা লক্ষ করা গেছে। ভর্তির প্রথম দিন থেকেই রোগীর প্লাটিলেট কমতে শুরু করে। ২৯ নভেম্বর সকালে রোগীর প্লাটিলেট ছিল ৬০ হাজার, যা সন্ধ্যায় ৩০ হাজারে নেমে আসে। কিন্তু তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এ অবস্থায় ৩০ নভেম্বর রোগী শকে চলে গেলে তাকে আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) পাঠানো হয়। আইসিইউতে নেয়ার পরও স্বজনদের কাছে রোগীর প্রকৃত অবস্থা গোপন করে মিথ্যা তথ্য দেয়া হয়। এমনকি উন্নত চিকিৎসার্থে রোগীকে অন্যত্র নিতে চাইলে এ চিকিৎসকদল স্বজনদের বাধা দেয়। একপর্যায়ে আইসিইউতে রোগীর শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটলে মফিদুর রহমান নামে এক চিকিৎসক শিশু রাইদাহকে লাইফ সাপোর্টে রেখে দ্রুত হাসপাতাল ত্যাগ করেন। ল্যাবএইড হাসপাতালের চিকিৎসকদের চরম অবহেলায় ও দায়িত্বহীনতায় শিশুটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
অভিযোগে আরো বলা হয়, আমার মেয়ে সুস্থ অবস্থায় হেঁটে হাসপাতালে গেছে। ২৬ নভেম্বর দুপুরে তার জ্বর আসে। ওইদিন এক চিকিৎসকের পরামর্শে ডেঙ্গু পরীক্ষা করলে ফল নেগেটিভ আসে। পরের দিন আবারো পরীক্ষা করা হলে ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। স্কয়ার হাসপাতালের দুজন চিকিৎসকের অধীনে রাইদাহর নিয়মিত চিকিৎসা করা হতো। কিন্তু তারা দুজনেই দেশের বাইরে থাকায় ল্যাবএইড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার অধ্যাপক এফএম সিদ্দিকীর সহকারী জানান, আমার স্যার দেশের সবচেয়ে ভালো ডাক্তার। তার অধীনে কোনো রোগীর মৃত্যুর তথ্য নেই। এসব কথার পরিপ্রেক্ষিতে তার অধীনে রোগী ভর্তি করা হয়। কিন্তু শুরু থেকেই তিনি রোগীর প্রতি ছিলেন উদাসীন। ভর্তির দিন বিকেলে তিনি একবার এলেও দূরে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যান। জ্বর কামাতে সাপোজিটরি দেয়া হলে মেয়ে ৪-৫ বার টয়লেটে যায়।
এ বিষয় চিকিৎসকের নজরে আনলে রোগীকে সব ধরনের খাওয়া বন্ধ করে দেন অধ্যাপক সিদ্দিকী। ভর্তির সময় মেয়েটির প্ল্যাটিলেট কাউন্ট ছিল ১ লাখ ২৭ হাজার। মাত্র দুদিনের মধ্যে সেটি ৩০ হাজারে নেমে আসে। কিন্তু তারপরও চিকিৎসকেরা ছিলেন নির্বিকার। একপর্যায়ে ঠোঁট ফেটে রক্ত আসতে শুরু করলে (হেমোরেজিক) চিকিৎসকদের দ্রুত ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তখনো তারা বিষয়টির গুরুত্ব না দিয়ে ঠোঁটে ভেসলিন দিতে বলেন।
এ পরিস্থিতিতে তারা তাদের পরিচিত অন্য ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলেন। সেই চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গু রোগীর প্রধান চিকিৎসা ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট। কিন্তু এ চিকিৎসকরা আমার মেয়েকে প্রয়োজনীয় ফ্লুইড থেকে বঞ্চিত করেছেন। বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা মেয়েটির রিপোর্ট দেখে যথাযথ চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা নেননি।’
ভোরের আকাশ/আসা