বাবলুর রহমান বারী, রংপুর: বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের চাহিদা অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ধাপ। খাদ্যের চাহিদা পূর্ণ হলে অন্য চাহিদাগুলো পূরণ করার আর দরকার হয় না। মানুষের জীবনের মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য অন্যতম। মানুষের পেটে খাদ্য থাকলেই কেবল অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের প্রয়োজন হয়। যদি পেটে খাদ্য না থাকে, তাহলে অট্টালিকা তো দূরের কথা, সামান্য বস্ত্র পরিধানের কথাও মনে পড়ে না। অনাহারি পেটে খাদ্যটাই যেন প্রধান চাহিদা হিসেবে পায়, বাসস্থান নয়। বর্তমানে কৃষি জমিতে ঘরবাড়ি নির্মাণের কারণে আগামীতে খাদ্য সংকট ও পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশে জনসংখ্যার অনুপাতে কৃষি জমির পরিমাণ খুব বেশি নয়। বাংলাদেশ যে পরিমাণ জনসংখ্যা নিয়ে স্বাধীন হয়েছে, বর্তমান জনসংখ্যা তারচেয়ে অনেক বেশি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি হলেও বাড়েনি দেশের আয়তন, বেড়েছে খাদ্যের চাহিদা, কমেছে কৃষি জমির পরিমাণ, দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। খাদ্য সংকট মেটাতে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে খাদ্য আমদানি করতে হয় সরকারকে।
প্রতিটি উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও রাজধানীতে চলছে শহর সম্প্রসারণের কাজ। প্রতিদিন নির্মিত হচ্ছে ঘরবাড়ি বহুতল ভবন ঘরবাড়ি। সারা দেশে রাস্তার দুপাশে কৃষি জমিতে হাউজিং সোসাইটি কিংবা বড় বড় শিল্প-কলকারখানার নামে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সরকার প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য হাজার হাজার একর কৃষি জমি ব্যবহার করছে। সুযোগসন্ধানী কিছু হাউজিং কোম্পানি সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দখল করে নিচ্ছে। হাজার হাজার হেক্টর কৃষি জমি ক্রয় করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করছেন। কৃষি জমির ওপর নির্মাণ হচ্ছে নতুন নতুন রাস্তাঘাট। প্রতিবছর ১২ হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। বাংলাদেশে গড়ে ৫৫ হাজার হেক্টর কৃষি জমি কমে যাচ্ছে।
তথ্যমতে, ২০০৭ সালে কৃষি জমির পরিমাণ এসে ঠেকেছে ৬৮ লাখ ২৭ হাজার হেক্টরে। তবে কমে যাওয়ার এই ধারাবাহিকতা থাকলে আগামী ২০ বছর পর চাষযোগ্য জমি ৫০ হাজার হেক্টরে নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
একজন মানুষের জন্য বা একটি পরিবারের জন্য একটি ঘর বা বাড়ি নির্মাণ করা মৌলিক চাহিদার একটি অংশ। কিন্তু একজন মানুষ বা একটি পরিবার যখন প্রয়াজনের অতিরিক্ত বাড়ি নির্মাণ করেন, তখন তাদের এই অতিরিক্ত বাড়িগুলো মোটেই মৌলিক চাহিদার মধ্যে পড়ে না। কিছু ব্যক্তি আছেন, যারা গ্রাম থেকে থানা, জেলা, বিভাগসহ পর্যায়ক্রমে রাজধানী ঢাকা শহর পর্যন্ত একাধিক ঘরবাড়ি আছে। তাদের পক্ষে এতগুলো বাড়িতে বসবাস করাও সম্ভব হয় না।
রংপুর সদর উপজেলার রহিম মিয়া জানান, তার চাহিদা আছে ৫টি ঘরের কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে আরো ৩টি বেশি করতে হচ্ছে। এ কারণে কৃষি জমিতে বাড়িঘর নির্মাণ করতে হচ্ছে। তিনি আরো জানান, ৪ ছেলে একসঙ্গে না থাকায় কৃষি জমিতে তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করে দিতে হচ্ছে।
একই কথা বললেন জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, সন্তানরা ভাগাভাগি হওয়ার কারণে কৃষি জমির ওপর চাপ পড়ে। ফলে দিন দিন আবাদি জমি কমে যাচ্ছে, খাদ্যের অভাবও হতে পারে। রংপুর সিটি করপোরেশনের নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম জানান, বর্তমানে যেভাবে ঘরবাড়ি বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে তাতে কৃষি জমির ওপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে। আমরাও চেষ্টা করছি কিন্তু সরকারি পুরোপুরি নির্দেশনা না থাকায় সঠিকভাবে আইনটি প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না।
একটি ইটভাটা নির্মাণ করতেও ত্রিশ বিঘা জমি দরকার হয়। প্রতিটি ইটভাটা বর্তমানে কৃষি জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে। কৃষি কর্মকর্তাদের দেখভালের দায়িত্ব দিলেও তারা মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিমিয় অনুমোদন দিচ্ছেন। এই ইটভাটার কারণেও হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। এদিকে কলকারখানা নির্মাণ করতে অনেক জমি দরকার হয়। তারা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কৃষিজমিতে কলকারখানা তৈরি করছেন। ফলে কমে যাচ্ছে কৃষিজমি।
এ বিষয়ে রংপুর বিভাগীয় সহকারী পরিচালক রায়হান হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি বাইরে আছি। এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না, বড় স্যারের সঙ্গে কথা বলেন।
নিয়ন্ত্রণহীনভাবে কৃষি জমিতে ঘরবাড়ি, কল-কারখানা, ইটভাটা, সড়ক ইত্যাদি নির্মাণের কারণে ভবিষ্যতে কৃষি জমির ওপর প্রভাব অধিক পরিমাণ পড়ার আশঙ্কাজনক হারে কমে যাবে, আবাদি জমি খাদ্য সংকটে পড়বে দেশ। এ কারণেই এখন থেকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে কৃষি জমি রক্ষার জন্য।
ভোরের আকাশ/আসা