এম সাইফুল ইসলাম: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে আবারো উত্তপ্ত হচ্ছে রাজনীতির মাঠ। রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ব্যস্ত নির্বাচনী প্রস্তুতি ও বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলায়। গত কয়েকদিন থেকে নির্বাচন সামনে রেখে দুই দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের বক্তব্যে পরস্পরকে ‘ছাড়’ না দেয়ার বিষয়টি স্পষ্ট। এ অবস্থায় দেশের প্রধান দুটি দলের শীর্ষ নেতাদের দেয়া বক্তব্যের পর নির্বাচকালীন ‘সংকট উত্তরণে’ সংলাপ বা সমঝোতার সম্ভাবনা আরো ক্ষীণ হয়ে এসেছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজন।
তবে বিশিষ্টজনের বেশিরভাগই নির্বাচনকালীন সংকট থেকে বের হতে বড় দুই দলের মধ্যে কার্যকরী সংলাপ ও সমঝোতার বিকল্প দেখছেন না। তারা আশাবাদী, শেষ পর্যন্ত দেশের স্বার্থে একটা সংলাপ ও সমঝোতা হবে। তা না হলে সেটি দেশের জন্য ভালো হবে না বলে তারা মনে করেন।
জানা গেছে, কাতার সফর নিয়ে গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিদেশিদের কোনো চাপের কাছে তিনি মাথানত করবেন না। নির্বাচন নিয়ে ‘কার সঙ্গে সংলাপ’ করবেন এমন প্রশ্নও করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বিএনপির সঙ্গে সংলাপের ব্যাপারে নেতিবাচক কথা বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পর মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কথা ঠিক রাখেন না। তাই তার সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আর কোনো সংলাপে বিএনপি বসবে না।
আগামী নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতির মাঠ এখন বেশ সরগরম। সংবিধান অনুযায়ী আগামী সংসদ নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনে করতে অনড় অবস্থানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আর বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না জানিয়ে নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এখন রাজপথে। এছাড়া আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণ ও নিরপেক্ষ করতে বেশ কিছুদিন থেকে কূটনৈতিক পাড়াও বেশ আলোচনায়। বিশেষ করে পশ্চিমারা চাইছেন, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন। বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলাও শুরু করেছেন পশ্চিমা দেশের রাষ্ট্রদূতরা। তবে রাজপথে সভা-সমাবেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা যাই বলুক না কেন, নির্বাচনের আগে একটা সংলাপ বা সমঝোতা হবে বলে অনেকের প্রত্যাশা রয়েছে। কিছুদিন আগেও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, প্রয়োজনে তিনি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ফোন দেবেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত সংলাপে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিএনপির কোনো নেতাকর্মীকে পুলিশি হয়রানি ও গ্রেপ্তার করা হবে না। অথচ বাস্তবে হয়েছে তার উল্টো। এছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি যাবে না বলেও তিনি স্পষ্ট করেছেন। আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের কোনো বিকল্প নেই বলেও জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব।
এতদিন সভা-সমাবেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতারা নির্বাচন প্রসঙ্গে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিলেও সাধারণ মানুষ তা বেশি একটা আমলে নেয়নি। তবে গত দুদিনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যের পর বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কাছে আগামী দিনের রাজনীতির প্রেক্ষাপট বা পরিস্থিতি নিয়ে কী বার্তা গেল? এমন প্রশের জবাবে বিশেষজ্ঞরা যার যার মতো করে বিশ্লেষণ করেছেন। তবে তারা সবাই বলছেন, শেষ পর্যন্ত একটা কার্যকরী সংলাপ দরকার।
বিষয়টি নিয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ ভোরের আকাশকে বলেন, নির্বাচন কেমন হবে তা কমিশনের ওপর নির্ভর করলেও সেখানে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা থাকে। সম্প্রতি বর্তমান সিইসির ভোটের দিন ইন্টারনেটের গতি কমানো নিয়ে বক্তব্যের রেফারেন্স দিয়ে তিনি বলেন, এটা সিইসি ঠিক বলেছেন। এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটে ভোটকে কেন্দ্র করে। এটা তো মোটেও ঠিক না। ভোট হতে হলে তো সুষ্ঠু পরিবেশ লাগে। পরিবেশ না থাকলে নির্বাচন নিয়ে কথা উঠবে এটা স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, রাজনীতিকরা কথা বলেন দলীয় স্বার্থ চিন্তা করে। তারা যাই বলুক না কেন, শেষ পর্যন্ত একটা সমঝোতা বা কার্যকরী সংলাপ অবশ্যই দরকার আছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ ভোরের আকাশকে বলেন, নির্বাচন প্রশ্নে দেশের বড় দল দুটির মানসিকতা হচ্ছে তাদের অবশ্যই জয়ী হতে হবে। জয়ী হয়ে আসার জন্য যে রাজনৈতিক শক্তি দারকার, তা বিএনপির এ মুহূর্তে নেই। সেই জায়গা থেকে তারা ‘হস্তক্ষেপমূলক’ নির্বাচন করতে চাইবে বা নির্বাচন ঠেকাতে চাইবে। যে কারণে তারা বিদেশি শক্তির সাহায্য কামনায় ধরনা দিচ্ছে। এছাড়াও বিশ্বে এখন বিভিন্ন ধরনের ভূ-মেরুকরণ আছে। সেই জায়গা থেকেই বহির্বিশ্ব নিজেদের স্বার্থের কারণে নির্বাচনের মতো একটা ব্যাপার নিয়ে কোনো দেশকে প্রভাবিত করতে আসবে বলে আমার মনে হয় না।
তিনি বলেন, বিগত দুবারের সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির যে অভিযোগ, সেটির ব্যাখ্যা বা অভিযোগ খণ্ডানোর দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। এক্ষেত্রে আমাদের নির্বাচন কশিনের যথেষ্ট অবহেলা আছে। তারা সঠিক জবাব না দেয়ায় রাজনৈতিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কোনো সমঝোতা না হলে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটবে বলে মনে করেন তিনি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, স্পষ্টত দেশ একটা সংঘাতমময় পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছে। কার্যকরী একটি সংলাপের মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা গেলে সে পরিস্থিতি এড়ানো যাবে। অন্যথায় দেশ আরো সংকটে পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষ ভোট দিতে পারবে- এমন একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন সম্ভব না হওয়া পর্যন্ত দেশের চলমান সংকটের সমাধান হবে না।
ভোরের আকাশ/আসা