logo
আপডেট : ২৪ মার্চ, ২০২৩ ১৫:১৫
যক্ষ্মা এখনো নীরব ঘাতক
নিখিল মানখিন

যক্ষ্মা এখনো নীরব ঘাতক

নিখিল মানখিন: যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক সফলতা দেখিয়েছে দেশ। ২০৩০ সাল নাগাদ নব্বই ভাগ যক্ষ্মা রোগীকে পরিপূর্ণ চিকিৎসার আওতায় আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু দেশে যক্ষ্মা এখনো নীরব ঘাতক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যক্ষ্মা নিয়ে সমাজে রয়েছে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। সমাজে এখনো যক্ষ্মা রোগীর পরিবারকে একঘরে করে রাখার ঘটনা ঘটে। অনেকে যক্ষ্মার লক্ষণ থাকলেও সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে রোগটি লুকিয়ে রাখে। এ আতঙ্কে উপসর্গ থাকার পরও টেস্ট করাতে যায় না অনেক মানুষ। ফলে রোগটি শতভাগ নির্মূল করা যাচ্ছে না। নীরবে সংক্রমণ এবং রোগীর মৃত্যু ঘটাচ্ছে এই নিরাময়যোগ্য ব্যাধি।

 

হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার লাখাই ইউনিয়নের মানপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. আবুল কালাম একজন যক্ষ্মা রোগী। গত চার বছর ধরে তিনি মাঝে মাঝে শুকনো কাশি ও জ্বরে ভুগলেও যক্ষ্মা পরীক্ষা করাননি। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, পরীক্ষা করোনার প্রয়োজনবোধ করিনি। আর যক্ষ্মার জীবাণু থাকার বিষয়টি কখনো ভাবিনি। স্বাভাবিক সর্দি-কাশি জ্বর ভেবেছি। নিজের এলাকায় যক্ষ্মা টেস্ট করাতে ভয় কাজ করছিল। বিষয়টি কেউ জেনে গেলে আমাদের বাড়িতে কেউ ঢুকবে না। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলবে না। এ আতঙ্কে টেস্ট করানো হয়নি। তিনি আরো জানান, ঢাকায় আমার ছোট মেয়ের পরিবার থাকে। জানুয়ারিতে ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলাম। সেই সুযোগে মহাখালীতে টেস্ট করানো হলে যক্ষ্মা ধরা পড়ে। আমি এখন নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছি। আমার পরিবারের আরো দুজনের শরীরেও যক্ষ্মা শনাক্ত হয়েছে বলে জানান মো. আবুল কালাম।

 

রাজধানীর মগবাজার এলাকায় থাকেন টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার দেউলাবাড়ি গ্রামের মো. সবুজ মিয়া। একটি গাড়ির গ্যারেজে কাজ করেন তিনি। পাঁচ বছর আগে তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, যক্ষ্মায় শনাক্ত হওয়ার কয়েক বছর আগেই আমার শরীরে যক্ষ্মার জীবন ঢুকেছিল বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন। সচেতনতার অভাবে টেস্ট করানো হয়নি। যক্ষ্মার জীবাণু নিয়ে আমি অন্যদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা, ওঠাবসা করেছি। আমার চার সদস্যের প্রত্যেকের শরীরে যক্ষ্মা শনাক্ত হয়। তবে এখন আমরা সবাই যক্ষ্মামুক্ত হয়েছি।

 

যক্ষ্মা পরিবারের তিক্ত অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, টানা ২৪ মাস চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছে। অর্থাৎ নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়েছে। যারা অবস্থা জানত, তারা আমাদের বাড়িতে পা রাখত না। কথা বলত অনেক দূরত্ব বজায় রেখে। অন্যদের সঙ্গে ওঠাবসা করতে পারিনি। আমাদের দেখলে দূরে সরে যেত। অসহনীয় ও দুর্বিষহ চিকিৎসা সময় পার করেছি। এমন নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে উপসর্গ থাকার পরও অনেকে টেস্ট করাতে চায় না বলে জানান মো. সবুজ মিয়া।

 

এভাবে শুধু মো. আবুল কালাম, মো. সবুজ মিয়া নন, অনেক মানুষের দেহে বাসা বেঁধে আছে যক্ষার জীবাণু। অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ছোঁয়াচে রোগীর জীবাণু সংক্রমিত হচ্ছে অন্যদের দেহে। মরণঘাতক হয়ে উঠছে নীরবে। শতভাগ শনাক্ত করতে না পারার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গত মঙ্গলবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যক্ষ্মা নির্মূলে কিছু ক্ষেত্রে এগোলেও শতভাগ রোগী শনাক্ত করতে না পারায় বাংলাদেশ এখনো উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। সম্মিলিতভাবে কাজ করলে ২০৩৫ সালের আগেই দেশকে যক্ষ্মামুক্ত করা সম্ভব। ভারত-পাকিস্তানসহ উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ আটটি দেশের একটি বাংলাদেশ। এসব দেশে পৃথিবীর ৭০ শতাংশ যক্ষ্মা রোগী রয়েছে। বাংলাদেশ যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে বেশ সফল হলেও কিছু ক্ষেত্রে এখনো কাজ করতে হবে।

 

তবে জাতীয় যক্ষ্মা নির্মূল কার্যক্রমের কারণে রোগী সুস্থ হওয়ার হার ৯৫ শতাংশ জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা বিনামূল্যে ওষুধ-চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি। ২০১৫ সালে যেখানে প্রতি লাখে ৪৫ জন মানুষ মারা যেত, ২০২১ সালে তা ২৫ জনে নেমে এসেছে।

 

কিন্তু শতভাগ রোগী শনাক্ত করা যাচ্ছে না জানিয়ে জাহিদ মালিক বলেন, অনেকে যক্ষ্মার লক্ষণ থাকলেও সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে রোগটি লুকিয়ে রাখে। এ কারণে রোগটি শতভাগ নির্মূল করা যাচ্ছে না বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা (এমডিআর)। আর শনাক্তের বাইরে রয়ে যাচ্ছে অসংখ্য যক্ষ্মা রোগী। এক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে পড়া রোগীরা।

 

জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনটিসিপি) জানায়, যক্ষ্মা রোগীদের প্রথম ছয় মাসের চিকিৎসায় কেউ অনিয়মিত ওষুধ সেবন করলে অথবা চিকিৎসা পদ্ধতিতে ভুল হলে এমডিআর যক্ষ্মা হয়। এমডিআর রোগীর ছোঁয়ায় আরেকজনের এ রোগ হতে পারে। এ রোগ ধরা পড়লে টানা ২৪ মাস চিকিৎসাধীন থাকতে হয়। প্রথম ছয়-সাত মাস ঢাকা বক্ষব্যাধি হাসপাতালে এবং পরবর্তী ১৮ মাস সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সেবিকার আশ্রয়ে ওষুধ সেবন করতে হয় বলে জানায় জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি (এনটিসিপি)।

 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, যক্ষ্মা একটি জীবাণুঘটিত মারাত্মক সংক্রামক রোগ, যা মাইকো-ব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস নামক জীবাণু দিয়ে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকে। একনাগাড়ে তিন সপ্তাহের বেশি কাশি, জ্বর ও বুকে ব্যথা এ রোগটির প্রধান লক্ষণ। কফ পরীক্ষা করাই হচ্ছে এ রোগ নির্ণয়ের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উপায়।

 

যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন সাবেক ডিরেক্টর এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্তমান পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, এটি একটি কমিউনিকেবল ডিজিজ এবং আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসা না নিলে তার দ্বারা আরো দশজন পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মনে রাখতে হবে, অঞ্চল বিবেচনায় আমরা একটি যক্ষ্মাপ্রবণ এলাকায় বাস করছি। তাছাড়া মানুষের আয়ু বাড়ছে। ডায়াবেটিস বা বার্ধক্যজনিত সমস্যা নিয়ে আছেন অনেকে। খোলা জায়গা কমে যাচ্ছে এবং বাড়ছে বায়ুদূষণÑ যা যক্ষ্মার ঝুঁকি বাড়াতেও সহায়তা করছে। রোগ নির্ণয়ে দেরি করাটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

যক্ষ্মাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. আবু রায়হান বলছেন, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে যক্ষ্মা এখনো বড় একটি সমস্যা। আগে মনে করা হতো, নিম্ন আয়ের মানুষের যক্ষ্মা হয়। তবে এ ধারণা সঠিক নয়। ধনী-গরিব যে কারো যক্ষ্মা হতে পারে। অনেকেই মনে করেন, যক্ষ্মা হলে রক্ষা নেই, মৃত্যু অবধারিত। তবে এ কথার ভিত্তি এখন আর নেই। সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেলে যক্ষ্মা রোগী পুরোপুরি সেরে ওঠে। যক্ষ্মায় সংক্রমিত ব্যক্তির কাছাকাছি থাকেন বা সংস্পর্শে আসেন, এমন মানুষের (পরিবারের সদস্য, চিকিৎসক, নার্স) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি দেখা যায়।

 

গত মঙ্গলবার অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (টিবি-এল এবং এএসপি) ডা. মো. মাহফুজার রহমান সরকার বলেন, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এবং সহযোগী সংস্থাগুলোর তৎপরতায় গত ৯ বছরে দেশে প্রায় ২৩ লাখ মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। সরকার ২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে যক্ষ্মা নির্মূলে যক্ষ্মা শনাক্তকরণ, নোটিফিকেশন, সেবার সহজলভ্যতা, প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং সর্বস্তরের অংশগ্রহণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

 

মাহফুজার রহমান বলেন, ২০১৫ সালে যেখানে প্রতি ১ লাখে প্রায় ৪৫ জন লোকের মৃত্যু হতো, সেখানে ২০২১ সালে যক্ষ্মায় মৃত্যু প্রতি লাখে ২৫ জনে নেমে এসেছে। দীর্ঘমেয়াদি ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রচলিত কষ্টকর চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ মুখে সেবনযোগ্য স্বল্পমেয়াদি ওষুধ-প্রতিরোধী চিকিৎসা পদ্ধতি যক্ষ্মা চিকিৎসায় একটি বড় পরিবর্তন এনেছে।

 

তিনি বলেন, ওষুধ-প্রতিরোধী যক্ষ্মার পরিষেবাকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে যক্ষ্মাবিষয়ক স্বাস্থ্যসেবা জনসাধারণের হাতের নাগালে পৌঁছে দেয়ায় এটি সম্ভব হয়েছে। এসব প্রচেষ্টা আর অর্জন সত্ত্বেও বাংলাদেশ এখনো যক্ষ্মার উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি হিসেবে পরিগণিত, যেখানে প্রতি মিনিটে একজন ব্যক্তি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্বে ২০২১ সালে প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার লোক যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় এবং ৪২ হাজার মৃত্যুবরণ করে। অর্থাৎ প্রতি ১২ মিনিটে যক্ষ্মার কারণে একজনের মৃত্যু হয়েছে।

 

যক্ষ্মা শনাক্তের ওপর গুরুত্ব দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেন, যক্ষ্মা প্রতিরোধে সরকারের নানা উদ্যোগ থাকলেও এখনো বছরে ১৫ শতাংশ রোগী শনাক্তের বাইরে থেকে যান। তারা একটা পর্যায় পর্যন্ত চিকিৎসা নেন না। জেনে-না জেনে অন্যদের মাঝে যক্ষ্মা ছড়ান। তাই আমাদেরকে অবশ্যই শনাক্তের সংখ্যা বাড়াতে হবে। নয়তো আরো বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হবে। অনেক রোগী মাঝপথে ওষুধ ছেড়ে দেয়ার কারণে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। শনাক্তের পর সুচিকিৎসাও নিশ্চিত করতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/আসা