নিখিল মানখিন: রোগীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ব্যয়ের প্রায় ৭৬ শতাংশ ব্যয় হয় ওষুধ ও ল্যাবরেটরির খরচ মেটাতে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধ ও ল্যাবরেটরির খরচ আকাশচুম্বী হওয়ায় ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা। অপ্রয়োজনীয় বড় বড় টেস্ট দিয়ে রোগীদের হয়রানি এবং একই ওষুধ দোকানভেদে ভিন্ন ভিন্ন দাম রাখার ঘটনাও ঘটছে। টাকার অভাবে মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে অনেক রোগীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
হেলথ ইকোনমিকস ইউনিট জানায়, রোগীরা তাদের স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত ব্যয়ের ৬৪.৬ শতাংশ ওষুধের জন্য, ১১.৭ শতাংশ ল্যাবরেটরির খরচ মেটাতে, ১০.৪ শতাংশ ডাক্তারের ভিজিটে, ২.৪ শতাংশ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্র্যাকটিশনার, ০.৩ শতাংশ ডেন্টিস্টদের খরচে, ১০.১ শতাংশ হাসপাতালে এবং ০.১ শতাংশ চিকিৎসা পণ্য কিনতে ব্যয় করেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার। নানা অজুহাতে ঘন ঘন বাড়ছে ওষুধের দাম। অনেক সময় একই ওষুধ দোকানভেদে ভিন্ন ভিন্ন দাম রাখার ঘটনাও ঘটছে। গত বছরের শেষদিকে ২৪ পদের ওষুধের মূল্য প্রকারভেদে ৫ থেকে ১২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। দেশে এখনো মানুষের চিকিৎসা বাবদ মোট খরচের বড় অংশই ওষুধের পেছনে ব্যয় হয়, সেখানে ওষুধভেদে বড় ব্যবধানে দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
ওষুধের দাম বাড়ানোর কারণ হিসেবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিকে দুষছেন ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান। তিনি বলেন, ডলার সংকট, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, ওষুধের কাঁচামাল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছিল ৮০ টাকা ডলারে।
শিপমেন্ট পৌঁছানোর পর ডলারের দাম উঠেছে ১১০ টাকায়। মোড়ক, পরিবহন, বিপণন ব্যয় বাড়ার প্রভাবও ওষুধের বাজারে দেখা যাচ্ছে। এ কারণে ওষুধের দাম বাড়ানোর আবেদন করা হয়। মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া আমাদের কোনো উপায় ছিল না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্যমতে, দেশে একজন মানুষের মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ ওষুধ বাবদ খরচ হয় এবং এ খরচ করতে হয় রোগীর পকেট থেকেই। হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে গিয়ে ওষুধেই মানুষের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে। অন্যান্য দেশে সরকার এ ব্যয়ের একটি বড় অংশ বহন করে, বাংলাদেশে এখনো এটি করা সম্ভব হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, দেশে সব নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। গত জুনে ওষুধের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে ওষুধের এই বাড়তি দাম রোগীর ওপরে চাপ আরো বাড়াবে। সরকার চাইলে অন্য কোনো উপায়ে ওষুধ কোম্পানিগুলো সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারত। তবে এ সময়ে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হবে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে ১৫০টিরও কম জেনেরিক ব্র্যান্ডের ২৭ হাজারের বেশি ওষুধ তৈরি হয়। এর মধ্যে মাত্র ১১৭টি ওষুধের দাম সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদনসাপেক্ষে বাকি ওষুধের দাম ওষুধ কোম্পানিগুলোই নির্ধারণ করে।
নিয়ন্ত্রণে নেই মেডিকেল টেস্ট ফি: চিকিৎসা করাতে গিয়ে এখন সবচেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে মেডিকেল টেস্টের পেছনে। এই টেস্ট নিয়েও রয়েছে বাণিজ্যের অভিযোগ। একই টেস্টে একেক হাসপাতালে একেক রকম ফি। আইন না থাকায় নিজেরাই ফি নির্ধারণ করে বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো। বড় বা নামি হাসপাতালগুলোতে এই ফি কয়েকগুণ বেশি।
বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মেডিকেল টেস্টের ফি নির্ধারণ করতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বহুবার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু এ ঘোষণা এখন পর্যন্ত বাস্তবে রূপ নেয়নি। গত বছর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, ক্যাটাগরি অনুযায়ী ফি নির্ধারণ করা হবে, যা হাসপাতালের দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন করতে হবে।
মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হবে বলে সতর্ক করেছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। কিন্তু বিষয়টি এখন পর্যন্ত আলোচনার মধ্যেই রয়ে গেছে।
অপ্রয়োজনীয় বড় বড় টেস্ট দিয়ে রোগীদের হয়রানি না করতে ডাক্তারদের প্রতি আহব্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। গত ১৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব কনভেনশন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বড় ডাক্তার হয়ে অপ্রয়োজনীয় বড় বড় টেস্ট দিয়ে রোগীদের হয়রানি করবেন না... অসুস্থ ও অসৎ প্রতিযোগিতা পরিহার করতে হবে।’
তিনি চিকিৎসাসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও সেবার মনোভাব নিয়ে দায়িত্বশীল আচরণ করার জন্যও জোর তাগিদ দেন।
গবেষকদের অন্যতম এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ড. আবদুর রাজ্জাক সরকার জানান, গবেষণায় মূলত রাজধানীর নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবার বাড়তি ব্যয় দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। সরকারিভাবে যে সুবিধা রয়েছে, তার বাইরে চিকিৎসা, ওষুধ, রোগ নির্ণয় ও যাতায়াত খরচ ওই বাড়তি ব্যয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। হতদরিদ্র পরিবারেরই আয়ের অনুপাতে খরচের হার সবচেয়ে বেশি।
ওইসব পরিবার আয়ের এক-তৃতীয়াংশই স্বাস্থ্যসেবায় বাড়তি খরচ হয়। আর হতদরিদ্র পরিবারগুলো খরচ মেটাতে গিয়ে প্রায়ই বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছে। চিকিৎসাসেবা গ্রহণের পদে পদে তাদের প্রতিক‚ল পরিস্থিতিরি মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব জানান, সামাজিক অবস্থান ও শ্রেণিবৈষম্যের কারণে ধনী ও দরিদ্ররা সরকারি ব্যবস্থাপনায় একই ধরনের সেবা পায় না। অনেক ক্ষেত্রেই সব শ্রেণির মানুষের সরকারি ব্যবস্থাপনার সেবা পাওয়ার ধরন ও মান এক নয়।
আবার ওই দরিদ্ররা অর্থের অভাবে বেসরকারি সেবাও পাচ্ছে না। সামাজিক বৈষম্যের কারণে দরিদ্র পরিবারে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বেশি হতে পারে। যার আর্থিক অবস্থা ভালো, সব ব্যবস্থাপনার সেবা তার জন্য ভালো। যার আর্থিক অবস্থা খারাপ, তার জন্য কোনো ব্যবস্থাপনা নেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ব বিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টের তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে বছরে ৬৪ লাখ মানুষ গরিব থেকে আরো গরিব হচ্ছে।
এদের মধ্যে ১৫ শতাংশ চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছে। কারণ বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ নিজের পকেট থেকেই ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে মানুষ স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে দিন দিন আরো গরিব হয়ে পড়ছে। অপ্রয়োজনীয় টেস্ট না দেয়ার জন্য তিনি চিকিৎসকদের প্রতি আহব্বান জানান।
ভোরের আকাশ/নি