logo
আপডেট : ২৫ মার্চ, ২০২৩ ১৩:২৭
হুমকির মুখে উপকূলীয় অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা ও জীববৈচিত্র্য
এজাজ কায়েস, খুলনা

হুমকির মুখে উপকূলীয় অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা ও জীববৈচিত্র্য

ফেটে চৌচির হয়ে গেছে খুলনার কয়রার ফসলি জমি

গত ৩০ বছর লবণপানি ও চিংড়ি চাষের বিরূপ প্রভাবে খুলনা বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তায় চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বিলুপ্তপ্রায় ৬০ প্রজাতির মাছ ও বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি।

 

চরম আকারে হ্রাস পেয়েছে কৃষি উৎপাদন। গাছপালা না থাকায় পরিবেশ বিপর্যয়সহ হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য।

 

কর্মসংস্থানের অভাবে গত এক দশকে কাজের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন হাজার হাজার শ্রমজীবী। চিংড়িবিরোধী আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন একাধিক ব্যক্তি। 

 

একসময়ের কৃষি অধ্যুষিত উপকূলীয় অঞ্চল খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরার নদনদীগুলোয় ষাটের দশকে তৎকালীন সরকার ওয়াপদার বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলে এ অঞ্চলে কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটে। সবুজ গাছপালায় উপকূলীয় এলাকা পরিণত হয় মিনি অরণ্য। প্রতিটি বাড়িতে ছিল গোয়ালভরা গরু, গোলাভরা ধান ও পুকুরভরা মাছ।

 

এলাকার চাহিদা পূরণ করে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হতো। কালের বিবর্তনে আশির দশকে এ অঞ্চলের কৃষিজমিতে লবণপানি উত্তোলন করে শুরু হয় পরিবেশবিধ্বংসী চিংড়ি চাষ। প্রথম দিকে ধান এবং মাছের উৎপাদন ভালো হওয়ায় এলাকার আর্থসামাজিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

 

পরে এ অঞ্চলের হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি প্রভাবশালী ঘের মালিকদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং এসব ঘের মালিকরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় ধান চাষ বন্ধ করে জমিতে সারা বছর লবণপানি ধরে রেখে শুধু চিংড়ি চাষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।

 

বর্তমানে উপকূলীয় খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, রূপসা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, দেবহাটা, আশাশুনি, বাগেরহাটের শরণখোলা, রামপাল, মোরেলগঞ্জ, মংলায় প্রায় দেড় লাখ হেক্টর কৃষিজমিতে লবণপানির চিংড়ি চাষ হচ্ছে।

 

প্রভাবশালী ঘের মালিকরা এসব চিংড়ি ঘেরে ধান চাষের সুযোগ না দেয়ায় বিপাকে পড়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকরা। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিপত্রের কাছে জিম্মি আয়ের উৎস না থাকায় কয়েক বছরের হাড়ির টাকা অগ্রিম নিয়ে খরচ করে অভাব অনাটনের কারণে অনেক নিম্ন ও মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবার তাদের জায়গা জমি বিক্রি করে ভূমিহীন হয়েছে।

 

আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর পড়েছে বিরূপ প্রভাব। কর্মসংস্থানের অভাবে এ অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ কাজের সন্ধানে প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন স্থানে পাড়ি জমিয়েছেন। অন্যদিকে একই জমিতে দীর্ঘদিন চিংড়ি চাষের ফলে মাটি ও পানির সব গুণাগুণ নষ্ট হওয়ায় চিংড়িতে দেখা দিয়েছে ভাইরাসসহ নানাবিধ রোগবালাই।

 

সম্প্রতি ভাইরাসের কারণে বিনিয়োগকৃত মূলধন ফেরত না আসায় ঋণগ্রস্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে অনেক চিংড়ি চাষি। এছাড়া লবণপানির প্রভাবে ধান চাষ ব্যাহত হওয়ায় গত দুই দশক ধরে এ অঞ্চলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে প্রভাব পড়েছে পরিবেশের ওপর। অভ্যন্তরীণ নদনদী ও পানি নিষ্কাশনের সরকারি খালগুলো বাঁধ দিয়ে চিংড়ি চাষের ফলে পলি পড়ে অধিকাংশ নদনদী ও খাল ভরাট হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।

 

চলতি বছর সাতক্ষীরাসহ এ অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা স্থায়ী জলাবদ্ধতার কারণে প্রায় ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ওয়াপদার বেড়িবাঁধ কেটে ঘেরের পানি সরবরাহের স্লুইসগেট নির্মাণ করায় ষাটের দশকে নির্মিত পুরোনো বাঁধগুলো অসংখ্যা জায়গা নিচু ও দুর্বল হয়ে পড়েছে।

 

ফলে জলোচ্ছাস ও জোয়ারের উপচেপড়া পানি ভেতরে প্রবেশ করে বিস্তীর্ণ এলাকা প্রাবিত হয়ে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে। বিচারণ ক্ষেত্র ও গো-খাদ্যের অভাবে এ অঞ্চলের মানুষ, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া লালন-পালন ছেড়ে দিয়েছেন অনেকেই। গাছপালা নেই বললেই চলে। ফলে চরম জ¦ালানি সংকট দেখা দিয়েছে।

 

আবাসস্থলের অভাবে ময়না, টিয়া, দোয়েল, শ্যামা, ঘুঘু, শালিকসহ অসংখ্য পাখি, বন্যপ্রাণী ও অনেক উভচর প্রাণী এ অঞ্চল থেকে বিলুপ্তপ্রায়। কমেছে প্রাকৃতিক উৎসে মাছের উপস্থিতি। বিলুপ্ত হয়েছে শোল, টাকি, বাইম, মলা, চেলা, দাঁড়কিনাসহ ৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে হুমকির মুখে পড়বে উপক‚লীয় অঞ্চল ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য।

 

খুলনা জেলা কৃষি অফিসের উপপরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বছরের পর বছর উপক‚লীয় অঞ্চলের কৃষিজমি লবণপানিতে তলিয়ে রাখায় জমির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পেয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে ফসলের উৎপাদন ধীরে ধীরে কমে আসবে।

 

বাগেরহাট চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কেন্দ্র প্রধান নীলুফা বেগম বলেন, গত তিন দশকে লবণপানির প্রভাবে উপক‚লীয় অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছ। এ অঞ্চলে চিংড়ি ঘেরগুলো সনাতন পদ্ধতিতে দীর্ঘদিন চাষাবাদের ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পেয়েছে এবং পচনশীল বস্তু মাটিতে মিশে যাওয়ায় বিভিন্ন রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে।

 

উর্বরতা শক্তি কমে যাওয়ায় পানির তলদেশে শ্যাওলাজাতীয় উদ্ভিদ বৃদ্ধি পেয়েছে।

 

এতে করে চিংড়ির উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের মাছের উৎপাদন বাড়াতে হলে সনাতন পদ্ধতিতে নির্ভরশীল না হয়ে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/নি