চুয়াডাঙ্গার মাঠে মাঠে এখন কয়েক হাজার কোটি টাকার ফসল রয়েছে। ভারি বৃষ্টিপাত, শিলাবৃষ্টি ও কাল বৈশাখী ঝড়ে এসব ফসল বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে পারে। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ভুট্টা, ধান ও আম।
এসব ফসলের ক্ষতির ঝুঁকি এড়াতে ফসলের বাড়তি যত্ন ও করণীয় কী কী কাজ সে বিষয়ে পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চুয়াডাঙ্গায় এ বছর ব্যাপকভাবে ভুট্টার আবাদ হয়েছে। এ বছর আবহওয়া অনুকুলে থাকায় ফলনও হয়েছে প্রচুর। চুয়াডাঙ্গায় চলতি মৌসুমে ভুট্টার আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৩৮ হাজার ৫৩০ হেক্টর থাকলেও তা ছাড়িয়ে ৪৯ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ করা হয়েছে।
এসব জমিতে ভুট্টা উৎপাদন হবে প্রায় ৫ লাখ ৫৫ হাজার টন। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
এ জেলার চার উপজেলায় ধানের ইরি-বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৩৬ হাজার ৭১০ হেক্টর জমিতে ধরা হয়েছিল এবং আবাদ হয়েছে ৩৪ হাজার ৩৯৭ হেক্টর। এসব জমিতে ধান উৎপাদন হবে ২ লাখ ১০ হাজার টন। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।
এ জেলায় আমের লক্ষ্যমাত্রা ২ হাজার ১৯১ হেক্টর জমিতে ধরা হয়েছিল এবং আবাদ হয়েছে ২ হাজার ৪৬৫ হেক্টর। এসব জমিতে আম উৎপাদন হবে ৩৪ হাজার ৫১০ টন। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ১৬০ কোটি টাকা। এ জেলায় লিচুর লক্ষ্যমাত্রা ২৫৫ হেক্টর জমিতে ধরা হয়েছিল এবং আবাদ হয়েছে ২৫৫ হেক্টর।
এসব জমিতে লিচু উৎপাদন হবে ৯৪০ টন। এ জেলায় গম আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৯৬৬ হেক্টর জমিতে ধরা হয়েছিল এবং আবাদ হয়েছে ১ হাজার ৭ হেক্টর। এ জেলায় আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ২ হাজার ৩০৪ হেক্টর জমিতে ধরা হয়েছিল এবং আবাদ হয়েছে ২ হাজার ১৫০ হেক্টর। এ জেলায় সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৩ হাজার ৮৫ হেক্টর জমিতে ধরা হয়েছিল এবং আবাদ হয়েছে ৩ হাজার ১৩৫ হেক্টর।
এ জেলায় পান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে ধরা হয়েছিল এবং আবাদ হয়েছে ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর। এ জেলায় তরমুজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৪৫০ হেক্টর জমিতে ধরা হয়েছিল এবং আবাদ হয়েছে ৪৫০ হেক্টর। এ জেলায় বিভিন্ন সবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৮ হাজার ৪৫৭ হেক্টর জমিতে ধরা হয়েছিল এবং আবাদ হয়েছে ৮ হাজার ৪৬০ হেক্টর।
আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, দেশের সব জেলায় হালকা থেকে ভারি বৃষ্টিপাতসহ শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ সময় কোথাও কোথাও কালবৈশাখী ঝড়ও হতে পারে। এর মধ্যে চুয়াডাঙ্গা জেলাও মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মধ্যে আছে। দীর্ঘদিন এ জেলায় বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে শিলাবৃষ্টির আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চুয়াডাঙ্গা গত বছর জানুয়ারি মাসের ১২ তারিখ থেকেই বৃষ্টির দেখা মিলেছে। ২০২২ সালের ফেব্রæয়ারি মাসের শুরু থেকেই ধারাবাহিকভাবে বৃষ্টি দেখা গেছে পুরো মাসজুড়েই। গত বছরের ফেব্রæয়ারি মাসেই এক দিনে সর্বোচ্চ ২৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় একাধিকবার।
গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারিতে স্মরণকালের ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি হয়। মাত্র ২০ মিনিটের এ শিলা বৃষ্টিতে শুধু চুয়াডাঙ্গার কৃষিপণ্য ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা বলে জানিয়েছে চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান বলেন, এ বছর চুয়াডাঙ্গাতে বৃষ্টির পরিমাণ খুবই কম। গত বছর জানুয়ারি মাসের শুরু থেকেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছিল। আর ফেব্রæয়ারি মাসে প্রচুর বৃষ্টিপাত ছিল।
কিন্তু এ বছর বৃষ্টির দেখা মিলেছে মার্চের শেষের দিকে। আমাদের রেকর্ড অনুযায়ী, সেটাও মাত্র ৩ দশমিক ৬ মিলিমিটার। সাধারণত এতদিন বৃষ্টি বন্ধ থাকে না। কিন্তু এ বছর চুয়াডাঙ্গায় বৃষ্টি নেই বললেই চলে। আগামী এক সপ্তাহের আবহওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী চুয়াডাঙ্গায় ভারি বর্ষণ ও কালবৈশাখীর কোনো আশঙ্কা নেই। তারপরও আশংকা থেকেই যায়।
কালবৈশাখীর তেমন কোনো পূর্বাভাস থাকে না। হঠাৎ মেঘ জমা হয়ে ঝড়ের শঙ্কা তৈরি হয়। শিলাবৃষ্টির ক্ষেত্রেও একই। অনেক আগে থেকে এগুলোর সঠিক পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ২৭ তারিখে আমরা দেখেছি চুয়াডাঙ্গায় হঠাৎ শিলাবৃষ্টি হতে। যা স্মরণকালের ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি ছিল। কৃষি ছাড়াও চুয়াডাঙ্গায় মানুষের ও পশুপাখির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, কিছুদিন আগেও ঝড়বৃষ্টি ও কালবৈশাখীর ঝড়ের পূর্বাভাস ছিল। তবে পূর্বাভাস ছাড়া ঝুঁকি নেই তা বলা যাবে না। এ জেলার মাঠে মাঠে রয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার ফসল।
এখন যেকোনো সময়ই কোনো ধরনের পূর্বাভাস ছাড়াই ঝড়-বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি ও ভারি বর্ষণও হতে পারে। কৃষকদের ক্ষতি এড়াতে ও ঝুঁকি কমাতে সচেতন থাকতে হবে।
এ বিষয়ে আমাদের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা সবসময় মাঠে কাজ করছেন। কৃষকেদের নানাভাবে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। যেসব আবাদে পানি কম লাগে সেসব জমিতে যেন পানি জমে থাকতে না পারে সেজন্য নিষ্কাশন নালা পরিষ্কার রাখতে বলা হচ্ছে। বোরো ধানের জমির আইল উঁচু করে দিতে বলা হবে।
দন্ডায়মান কলাগাছ, আখ ও উদ্যানতাত্বিক ফসলের জন্য খুঁটির ব্যবস্থা করতে বলা হচ্ছে। পরিপক্ব যেসব ফসল আছে ঘরে তোলার মতো তা দ্রুত সংগ্রহ করে শুকনো ও নিরাপদ জায়গায় রাখতে বলা হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ভুট্টা, ধান, আম, তরমুজ, পান বরজ, কলা, পেপে, বিভিন্ন প্রকার সবজি। ইতোমধ্যে এ জেলায় ভুট্টা আহরণ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ আহরণ হয়ে গেছে।
অন্যান্য বছরের তুলনায় ভুট্টায় এ বছর ফলনও অনেক বেশি হয়েছে।
ভোরের আকাশ/নি