logo
আপডেট : ৩০ মার্চ, ২০২৩ ১১:১৮
আলোচনার কেন্দ্রে নির্বাচনকালীন সরকার
নিখিল মানখিন

আলোচনার কেন্দ্রে নির্বাচনকালীন সরকার

নিখিল মানখিন: জাতীয় নির্বাচনী বছরের প্রায় তিন মাস শেষ হতে চলেছে। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতি এখন পুরোপুরি নির্বাচনমুখী। এমতাবস্থায় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যু। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের চুড়ান্ত পর্যায়ে দলীয় ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়েই প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে চুড়ান্ত দরকষাকষির খেলা হবে।

 

এ পর্যন্ত বিএনপির নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার দাবিটি নাকচ করে চলেছে আওয়ামী লীগ।

 

জাতীয় সংসদ নির্বাচনী বছর পার করছে দেশের মানুষ। আর নির্বাচনী হিসাব-নিকাশ কষতে শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। তবে নির্বাচনে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাগ্যুদ্ধ ও মাঠযুদ্ধে ঘুরেফিরে নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতির ইস্যুটি সামনে চলে আসছে।

 

নির্দলীয় সরকার পদ্ধতি প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগকে লক্ষ্য করে হুমকি প্রদান অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। তারা দাবি আদায়ে পালন করে যাচ্ছে একের পর এক নতুন কর্মসূচি। আর বিএনপির হুমকির জবাবে নির্বাচনী মহাসড়কে দাঁড়িয়ে শান্তির সমাবেশ করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে চায় আওয়ামী লীগ। আর সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দিয়ে চলেছে বিএনপি।

 

২০২২ সালের শেষ দিকে ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি করে বিএনপি। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত নানা কৌশলে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মাঠে সরব রয়েছে দলটি। বিএনপির নেতৃত্বে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি শুরু হয় গত ২৩ ডিসেম্বর গণমিছিলের মধ্য দিয়ে।

 

পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বাতিল, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফা এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানি-নিত্যপণ্যের মূল্য কমানোর দাবি জানানো হচ্ছে যুগপৎ আন্দোলনে। এরপর ধারাবাহিকভাবে তারা অবস্থান কর্মসূচি, বিক্ষোভ সমাবেশ, বিভাগীয় সমাবেশ করেছে।

 

গত ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রার কর্মসূচি করে। এরপর থানা, জেলা ও মহানগরে পদযাত্রার ধারাবাহিক কর্মসূচি শেষ করেছে ৪ মার্চ। সারা দেশে গত ১১ মার্চ মানববন্ধন কর্মসূচি এবং ১৮ মার্চ সারা দেশে সব মহানগরে প্রতিবাদ সমাবেশ করে দলটি।

 

এছাড়া যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে গণতন্ত্র মঞ্চ, গণফোরাম, বাংলাদেশ পিপলস পার্টি, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য ও পেশাজীবী গণতান্ত্রিক জোট রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত মানবন্ধন কর্মসূচি থেকে এই অভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করে।

 

নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না। রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমেই এ দাবি আদায় করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে দলটি।

 

সম্প্রতি রাজধানীতে দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে একই হুঁশিয়ারি বার্তা দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার খায়েশ জেগেছে। সেই নীলনকশা নিয়েই তারা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো একই কায়দায় ২০২৩ সালের নির্বাচন করতে চায়।

 

কিন্তু মানুষ এবার তা হতে দেবে না। উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি করে জনগণ এদের পরাজিত করবে। পরিষ্কার ভাষায় বিএনপি এ সরকারের অধীন, হাসিনা সরকারের অধীন, এই নির্বাচন কমিশনের অধীন কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে জানিয়ে দেন বিএনপি মহাসচিব।

 

এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, বিএনপির হুমকি ও দাবিগুলো আমলে নিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। বিএনপিকে আন্দোলনে ব্যস্ত রেখে পুরোপুরিভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনমুখী হয়ে পড়েছে তারা।

 

বিএনপির যেকোনো কর্মসূচির বিপরীতে তারা ‘শান্তি সমাবেশ’ কর্মসূচি পালন করে সময় পার করছে। এভাবেই তারা পার করবে নির্বাচনী বছর। আওয়ামী লীগের পুুরো রাজনীতি এখন নির্বাচনমুখী। তাদের দল গোছানোর কাজ অনেকটা শেষ পর্যায়ে। দলীয় জেলা-উপজেলা সম্মেলন ও কমিটি গঠন শেষদিকে।

 

সুরাহা হওয়ার শেষ পর্যায়ে তৃণমূল কোন্দলও। জোটভুক্ত রাজনৈতিক দলসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলছে আলোচনা ও দেনদরবার। আওয়ামী লীগের মূল আলোচনাতেও ‘নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি’ মূল ইস্যু হিসেবে স্থান করে নিয়েছে বলে জানান রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

 

নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি প্রশ্নে বিএনপির দাবি বরাবরই নাকচ করে চলেছে আওয়ামী লীগ।  বুধবার সচিবালয়ে মতবিনিময়কালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধানের বাইরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফেরা সম্ভব নয়।

 

বিএনপি যতই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দিবাস্বপ্ন দেখুক, তা কখনো পূরণ হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আর ফিরতে পারব না আমরা, ইইউসহ সবাই চায় দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, অবশ্যই সংবিধান মেনে নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে।

 

তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসুক বা না আসুক তা নিয়ে তো আমাদের উদ্বেগের কিছু নেই, কারণ আমরা সংবিধান মেনেই নির্বাচন করব, তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে নষ্ট করেছে বিএনপি, এখন আর কেয়ারটেকারের প্রয়োজন নেই বলে জানিয়ে দেন ওবায়দুল কাদের।

 

এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ এবং দেশের অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে পারে সরকার। আওয়ামী লীগ রাজপথে আধিপত্য বিস্তারে বিএনপির আন্দোলনের পাল্টা কর্মসূচি দিলেও নির্বাচনে অংশ নেয়া নিশ্চিত করতে বিরোধী দলের সঙ্গে পর্দার আড়ালে আলোচনা করার কথা বিবেচনা করছে।

 

আগামী এপ্রিলের কোনো এক সময় বিএনপিকে আলোচনার টেবিলে আনার উদ্যোগ নেবে আওয়ামী লীগ। আর আলোচনার টেবিলে একমাত্র ইস্যু হবে ‘নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি ’।

 

এদিকে, গত ১৬ মার্চ নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, দলীয় সরকার থাক কিংবা নির্দলীয় সরকার, তা নির্বাচন কমিশনের কাজে কোনো প্রভাব ফেলবে না। আমরা শুধু এটুকু বলতে পারি, যে ধরনের সরকারই থাকুক না কেন, বর্তমান ইসি শতভাগ সৎ, নিরপেক্ষ নির্বাচন করবে।

 

তিনি আরো বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই প্রায় দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। এটা নির্ভর করে নির্বাচন কমিশন কতটা সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে। আমরা যদি আমাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি এবং সেটা আমাদের ইচ্ছা আছে, অবশ্যই একটা সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।

 

নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, সে বিষয়ে কিছু বলার বা করার এখতিয়ার ইসির না থাকার কথা বলেন আলমগীর। পাশাপাশি দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে এই বিরোধে কমিশনের করার কিছু নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

 

আলমগীর বলেন, এটা রাজনৈতিক সমস্যা, রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে। এ বিষয়টাতে আমাদের কিছু করার নেই। সংবিধানও সে দায়িত্ব আমাদের দেয়নি।

 

ভোরের আকাশ/নি