logo
আপডেট : ৩১ মার্চ, ২০২৩ ১৪:৩৭
বিশ্ব দুর্যোগ মোকাবিলা দিবস আজ
বেড়েছে ঝুঁকি প্রশমন সক্ষমতা
নিজস্ব প্রতিবেদক

বেড়েছে ঝুঁকি প্রশমন সক্ষমতা

নিখিল মানখিন: বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবিলায় সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে একটি রোলমডেল। বেড়েছে ঝুঁকি প্রশমন ক্ষমতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের যে ১০টি দেশ সবচেয়ে বেশি দুর্যোগ-আক্রান্ত হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ নবম। দুর্যোগ সহনশীল দেশ গড়তে কার্যকর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। ঝুঁকিহ্রাসে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে দুর্যোগের দ্বারা ক্ষয়ক্ষতি এবং এর সম্ভাব্য নেতিবাচক ফলাফল বহুগুণে কমিয়ে আনা সম্ভব বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

 

বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় অনেক আগেই আন্তর্জাতিক সুনাম কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনে তা বেরিয়ে এসেছে। করোনাভাইরাসজনিত দুর্যোগ সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছে দেশ। বর্তমানে দেশটি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধজনিত মানবসৃষ্ট আন্তর্জাতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে যাচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জানায়, দুর্যোগ বলতে এমন একটি অবস্থা বুঝায়, যা মানুষকে মন্দ বা অকল্যাণকর পরিস্থিতির সম্মুখীন করে। দুর্যোগ বলতে এমন একটি বিপর্যয় বুঝায়, যা কোনো নির্দিষ্ট এলাকার জনগণের বেশির ভাগ মানুষকে বিপদাপন্ন করে তোলে এবং ওই জনগোষ্ঠীর তা মোকাবিলা করার ক্ষমতা সাধ্যের বাইরে চলে যায়। এসব দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে মানুষকে অনেক মূল্য দিতে হয়।

 

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জানায়, পৃথিবীব্যাপী যেসব দুর্যোগ সংঘটিত হয়, তা প্রধানত দুই ধরনেরÑ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ।

 

প্রাকৃতিক কারণে সংঘটিত দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে- ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, নদীভাঙন, তুষারপাত, লবণাক্ততা ইত্যাদি।

 

মানবসৃষ্ট দুর্যোগসমূহের মধ্যে রয়েছে- যুদ্ধ, পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ, রাসায়নিক দূষণ, খাদ্যে কীটনাশক ব্যবহার, অপরিকল্পিত ও ত্রুটিপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণ ইত্যাদি।

 

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহ : দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর জানায়, পৃথিবীর প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এদেশে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহের মধ্যে রয়েছে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, কালবৈশাখী ঝড় ও টর্নেডো, বন্যা, নদীভাঙন, লবণাক্ততা, খরা, আর্সেনিক, ভূমিকম্প ও সুনামি ইত্যাদি। বেলজিয়ামভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অন দ্য এপিডেমিওলজি অব ডিজাস্টারস (সিআরইডি) এবং জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইউএন অফিস ফর ডিজাস্টার রিস্ক রিডাকশন (ইউএনডিআরআর) যৌথভাবে মানবসৃষ্ট দুর্যোগের ওপর একটি গবেষণা করেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি শতকের ২০ বছরে বিশ্বের যে ১০টি দেশ সবচেয়ে বেশি দুর্যোগ-আক্রান্ত হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ নবম। আগের ২০ বছরের তুলনায় গত ২০ বছরে বিশ্বে সব ধরনের দুর্যোগ, প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বেড়েছে। এ সময়ে যে ১০টি দেশ সবচেয়ে দুর্যোগের শিকার হয়েছে, তার ৮টিই এশিয়ার। গত ২০ বছরে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭ হাজার ৩৪৮টি বড় ধরনের দুর্যোগের ঘটনা ঘটেছে। বড় ধরনের দুর্যোগের মধ্যে ছিল খরা, বন্যা, ভূমিকম্প, সুনামি, দাবানল ও অতিরিক্ত তাপমাত্রা।

 

টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন : বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা ও প্রস্তুতি নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাণহানি কমানো, দুর্যোগ মোকাবিলার একটি কাঠামোবদ্ধ মডেল প্রস্তুত করা এবং তা অনেক দেশ কর্তৃক অনুসরণসহ বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবিলায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করলেও এ খাতে এখনো যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধনের সুযোগ আছে এবং এখনই আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। কারণ ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এখনো বছরে জাতীয় আয়ের বড় অংশ ক্ষতি হয়।

 

গবেষণা প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো- বিদ্যমান সতর্কবার্তা প্রদান পদ্ধতি হালনাগাদ করে সাধারণ জনগণের বোধগম্য ভাষায় প্রচার করা; ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলসমূহকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে যথাসময়ে পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা প্রদান করা; অধিকতর বিপদাপন্ন পরিবার ও এলাকাকে প্রাধান্য দিয়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনা করা; ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত তথ্য জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে তথ্য বাতায়নের মাধ্যমে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা; আপদকালীন পরিস্থিতি ও দুর্যোগের সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ের কমিটি, স্বেচ্ছাসেবক দল ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনের কার্যকর অংশগ্রহণে দুর্যোগ প্রস্তুতি গ্রহণ করা; নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ সুবিধা সংবলিত এবং এলাকাভিত্তিক পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নিশ্চিত করা; আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত খাদ্য, পানি, পয়ঃনিস্কাশন ও জরুরি চিকিৎসাসেবার প্রস্তুতি গ্রহণ এবং তা সরবরাহ নিশ্চিত করা; স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বাধীন ‘অংশগ্রহণমূলক’ পদ্ধতিতে দুর্যোগ সহনশীল এবং টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ, সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করা ইত্যাদি।

 

দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার : গত ২৩ মার্চ বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিজয় সরণিতে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরের মাল্টিপারপাস হলে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আয়োজিত আলোচনা সভায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় এখন বিশ্বের কাছে রোলমডেল বাংলাদেশ। অনেক দেশের তুলনায় আমাদের দেশে দুর্যোগজনিত কারণে মৃত্যুর হার খুব কম। বাংলাদেশ প্রযুক্তিতে অনেকাংশেই এগিয়েছে। তবে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়লে উন্নত বিশ্বের মতো এগিয়ে যেতে পারব। সঠিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মানুষের জীবনের ঝুঁকির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব।

 

ডা. মো. এনামুর রহমান আরো বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলায় দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা, পরিশ্রম আর দূরদর্শী পরিকল্পনা এবং নতুন নতুন কৌশলকে কাজে লাগিয়ে বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে আজ সারা বিশ্বের কাছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অনুকরণীয় মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা, ভারি বর্ষণ, শৈত্যপ্রবাহসহ সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে।

 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের সবাইকে সমন্বিতভাবে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কাজ করতে হবে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে বিশ্বে অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।

 

পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত ভোরের আকাশকে বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য স্থানীয় সংগঠন এবং মানুষকে এক করতে হবে। এতদিন যে ধরনের দুর্যোগ আমরা দেখছি, সেটি বদলে যাবে। নতুন ধরনের দুর্যোগ আসবে। ভবিষ্যতের দুর্যোগ মোকাবিলায় গতিশীলতা আনতে গেলে জলবায়ু পরিবর্তনের যে হঠাৎ ওলট-পালট দেখা যাচ্ছে সেটি হবে এবং এটি বাংলাদেশের একেক জায়গায় একেক রকম হবে। শহর এবং গ্রামকেন্দ্রিক আলাদা হতে পারে। অপ্রত্যাশিত যে দুর্যোগগুলো আসছে। আগামী সময়ের দুর্যোগ যে বিশ বছর অপেক্ষা করবে, সেটিও কিন্তু বলা যাচ্ছে না। সামনের বছরও হতে পারে। তাই এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।

 

তিনি আরো বলেন, এখন থেকে আগামী ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে এমন মাত্রার ঘূর্ণিঝড় হবে, যা আজো হয়নি। বাংলাদেশে ক্যাটাগরি-৫-এর ঘূর্ণিঝড় এখনো হয়নি। আইলা সিডর ১২০, ১৩০, ১৪০ এগুলো ক্যাটাগরি এক দুই। ক্যাটাগরি পাঁচ মানে ২৫০ গতির ঘণ্টায়। আমাদের দেশে ১৯৯১ সালের যে বড় ঘূর্ণিঝড় রেকর্ড আছে সেটি ধারণা করা হয় ২৫০ কিলোমিটার। এসব বিষয়ে মন্ত্রণালয়কে ভাবতে হবে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক শামীমা প্রধান ভোরের আকাশকে বলেন, দুর্যোগ প্রস্তুতিতে গতিশীলতা আনার জন্য আমাদের শুধু জাতীয় পর্যায়ের প্রস্তুতি সেটা নয়, আমাদের প্রস্তুতি শুরু করতে হবে ঘর থেকে। আমার নিজেকে ইমপাওয়ার করতে হবে, আমাকে জানতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে হবে। একটি মেয়ে ও ছেলের সমানভাবে সবার জন্য কাজের ভার থাকবে।

 

ভোরের আকাশ/আসা