নিখিল মানখিন: দেশে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে সিজারে সন্তান জন্মদান। অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য একশ্রেণির চিকিৎসক অপ্রয়োজনে সন্তানসম্ভবা মায়েদের সিজারিয়ান পদ্ধতিতে ডেলিভারি করাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সদের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করতে হয় গর্ভবতী মা ও স্বজনদের। থানা পর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রে সিজার করার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয় না। অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ানের খপ্পরে পড়ে অনেক গর্ভবতী মা অকাল মৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। আর বেঁচে থাকা অনেকে পড়ছেন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিজারিয়ান সেকশন এখন দেশের বেশিরভাগ প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকের বড় ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এ প্রবণতা রোধ তো করা যাচ্ছেই না, বরং দিন দিন প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। কোনো প্রসূতি পেলেই প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর একশ্রেণির চিকিৎসক থেকে শুরু করে সবাই বিভিন্ন অজুহাতে রোগীকে নরমাল ডেলিভারির বিষয়ে কৌশলে মানসিকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। এমনকি সিজার না হলে মা কিংবা নবজাতকের ক্ষতি হওয়ার ভয়ও দেখানো হয় অনেক ক্ষেত্রে। নিরুপায় হয়ে প্রসূতি ও তার স্বজনরা নিরাপদ মাতৃত্ব ও সুস্থ সন্তানের স্বার্থে হাসপাতালের প্রত্যাশায় সায় দেয়। আর সিজারিয়ানের মাধ্যমে প্রসব পদ্ধতিতে রাজি হলেই শুরু হয় টাকা হাতানোর হিসাব কষাকষি।
অভিযোগ উঠেছে, নরমাল ডেলিভারির চেয়ে সিজারিয়ানে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বেশি টাকা পান। হাসপাতাল বা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষেরও এতে ব্যবসা বেশি। কারণ বেশি সময় হাসপাতালে থাকতে হয়, ওষুধ বেশি লাগে, অপারেশন থেকে শুরু করে অন্যান্য খরচও বেশি আদায় করা হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশনের পর প্রসূতির অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের জীবাণুর আক্রমণ দেখা দেয়। এতে হাসপাতালের ব্যবসা বেড়ে যায়। আর নরমাল ডেলিভারি হলে রোগী এক-দুদিনের মধ্যে বাসায় চলে যেতে পারে। কিন্তু সিজারিয়ান হলে আগে-পরে মিলিয়ে রোগীকে প্রায় এক সপ্তাহ থাকতে হয়। এতে হাসপাতালের কেবিন বা বেডভাড়া ও বিভিন্ন সার্ভিস চার্জের নামে বেশি টাকা আদায় করা সম্ভব। প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিকের দেখাদেখি এখন সরকারি ও বিভিন্ন এনজিওর হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোয়ও সিজারিয়ানের প্রবণতা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর হোটেল রেডিসন ব্লুতে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (নিপোর্ট) এ সভার আয়োজন করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালকেন্দ্রিক প্রসব বাড়ার কারণে সি-সেকশন বা সিজারিয়ানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সিজারের ঘটনা বেড়ে ৩৪ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সিজারের বেশিরভাগই হয়ে থাকে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। ২০২২ সালে এসে দেশের মোট সিজারে জন্মদানের ৮৪ শতাংশই হয়েছে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। এছাড়া ১৪ শতাংশ হয়েছে সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বাকি ২ শতাংশ হয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় (এনজিও)।
প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, ২০২২ সালে ঘরে শিশু জন্মদান হয়েছে ১২ লাখ ৬২ হাজার ৩২৪ জন, সরকারিতে ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৪৩৮ জন, বেসরকারি হাসপাতালে ১৬ লাখ ৩১ হাজার ২৫৫ জন ও এনজিওতে ৬১ হাজার ৪৮৯ জন। আর এদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে সিজার হয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৮ জনের। বেসরকারিতে ১৩ লাখ ৫৩ হাজার ৯৪২ জনের সিজার হয়েছে। এছাড়া এনজিওতে সিজার হয়েছে ২২ হাজার ১৩৬ জনের।
এদিকে, সরকারি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিকনির্দেশনা হচ্ছে- একটি দেশে অপারেশন বা সিজার ১৫ শতাংশ হতে পারে। কিন্তু ২০১৭-১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে সেটি ৩২ দশমিক ২২ শতাংশ। যেটি ২০০৩-২০০৪ সালের দিকে ছিল ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলে ওই সময়ে সিজার করে বাচ্চা হওয়ার হার ছিল ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ, যেটি ২০১৭-১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ১৮ শতাংশে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক ডা. আছমা খাতুন অরোরা ভোরের আকাশকে বলেন, গর্ভবতী মায়ের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রয়োজনে সিজারিয়ানের দরকার হতেই পারে। কিন্তু অপ্রয়োজনে সিজারে সন্তান জন্মদান অবশ্যই কাম্য নয়।
তিনি বলেন, বাস্তবে ১৫ থেকে ২০ ভাগের বেশি সিজারিয়ান পদ্ধতির দরকার নেই। কিন্তু এখন ঢাকার বাইরেও সিজারের প্রবণতা বাড়ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, এটা করলে হাসপাতালগুলোর আয় বেশি হয়। এটাই আয়ের প্রধান খাতে পরিণত হচ্ছে। গর্ভবতী মা ও পরিবারের মধ্যে এক ধরনের মনোভাব তৈরি হয়েছে যে, সিজারিয়ান পদ্ধতি নিরাপদ। কিন্তু অপ্রয়োজনে সিজার মায়ের মৃত্যুঝুঁকি এবং নানা ধরনের শারীরিক জটিলতার আশঙ্কা অনেক বাড়িয়ে দেয়।
ডা. আছমা খাতুন আরো বলেন, এটি শুধু একটি অপারেশন নয়। রোগীকে অজ্ঞান করতে হয়। ফলে তার ঝুঁকি বেড়ে যায়। একবার সিজার করলে পরবর্তীতেও সিজার করতে হয়। অনেক সময় জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হয়। প্রসবের থলিও ফেটে যায়। অনেক সময় এত রক্তপাত হয় যে, মাকে আর রক্ষা করা যায় না। সিজার কমাতে হলে সবাইকে সচেতন করতে হবে। আর এই সচেতনতা রোগী ও চিকিৎসক সবার মাঝেই তৈরি হতে হবে বলে জানান ডা. আছমা খাতুন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, সিজার বাড়ার পেছনে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি ছাড়াও এটা এখন অনেকের কাছে একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। তারা মনে করছেন, স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে সিজার মায়ের শরীর এবং অন্যান্য বিষয়ের জন্য ভালো। এই ভুল ধারণা দূর করতে হবে।
তিনি বলেন, নিরাপদ মাতৃত্ব শুধু সন্তান প্রসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মায়ের গর্ভধারণ থেকে শুরু করে সন্তান প্রসব এবং প্রসব-পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবাÑ সবকিছুই এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। মায়ের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিশ্চিতের ওপরই নির্ভর করে নবজাতকের স্বাস্থ্য এবং পুষ্টি।
প্রয়োজনীয় সিজার বন্ধে হাইকোর্টে রিট : ২০১৯ সালে ওই বিশ্লেষণ প্রকাশের সপ্তাহখানেক পর হাইকোর্টে দুটি রিট আবেদন হয়। প্রথমটি করেছিলেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। দ্বিতীয়টি বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইন উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিম।
ওই বছর জুন মাসের শেষ দিকে রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ ছয় মাসের মধ্যে সিজারিয়ান সেকশন (সি-সেকশন) নজরদারিতে নীতিমালা চেয়ে আদেশ দেয়। হাইকোর্টের আদেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি নীতিমালার খসড়া তৈরি করে আদালতে জমা দেয়।
ভোরের আকাশ/আসা