মোতাহার হোসেন: শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের সবকটি বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর। দিনে মাছি, রাতে মশা, অপরিষ্কার ও দুর্গন্ধময় শৌচাগারের অবস্থা, লাগেজ ব্যবস্থাপনায় রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম।
সম্প্রতি একটি গবেষণায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের অন্যান্য বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ বিমানসেবা ও বন্দরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, শৌচাগার ও লাগেজ ব্যবস্থাপনায় অসন্তোষের বিষয়ে উঠে এসেছে যাত্রীদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পরিচালিত গবেষণা জরিপে। পাশাপাশি লাগেজ চুরি, বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদের লাগেজ কেটে স্বর্ণ, গয়নাসহ অন্যান্য মূল্যবান প্রসাধনী ও সামগ্রী চুরির অভিযোগও দীর্ঘদিনের।
উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ১৯৯৬ পর্যন্ত দেশে উড়োজাহাজ খাতের একক সংস্থা হিসেবে ব্যবসা চালায়। বিভিন্ন সময়ে উড়োজাহাজ বহর ও গন্তব্য বৃদ্ধির চেষ্টা অব্যাহত রাখলেও দুর্নীতি আর অদক্ষতার জন্য বিমান বারবার পিছিয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ বিমান তার সুসময়ে সর্বোচ্চ ২৯টি গন্তব্যে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিশ্বের প্রায় ৭০টি দেশের সঙ্গে বিমানের বিমান সেবা চুক্তি রয়েছে। ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রæয়ারি অভ্যন্তরীণ সেবার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে বিমান। ভারত থেকে নিয়ে আসা ম্যাকডনেল ডগলাস ডিসি-৩ ছিল প্রথম সংযোজন, যেটি ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম, যশোর এবং সিলেটের যোগাযোগ স্থাপন করেছিল।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গড়ে প্রতিদিন ২৭টি এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা করে। আসা-যাওয়া মিলিয়ে প্রতিদিন ১০০টি ফ্লাইট ওঠানামা করে এবং সব মিলিয়ে প্রতিদিন ১৫ হাজারের বেশি যাত্রী আসা-যাওয়া করে।
এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে মিডিয়ার সঙ্গে প্রদত্ত বক্তব্যে যাত্রীদেরও অভিযোগ, অসন্তোষের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া এ ধরনের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের অন্যান্য বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ পরিবশ পরিচ্ছন্ন রাখতে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, মশা-মাছি তাড়াতে স্প্রে করা হচ্ছে, বার্থরুম পরিষ্কর রাখতে সুইপার, ঝাড়–দার নিয়মিত কাজ করছে। তিনি বলেন, নির্মাণাধীন থার্ড টার্মিনাল চালু হলে যাত্রীদর আরো বেশি সেবা দেয়া সম্ভব হবে এবং বিদ্যমান সমস্যা কমে আসবে।
সম্প্রতি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ) কর্তৃক পরিচালিত গবেষণায় এই বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ফারজানা রহমান নেতৃত্ব দেন। অ্যানালাইজিং সার্ভিস কোয়ালিটি অব ডমেস্টিক এয়ারলাইন্স ইন অ্যান ইমার্জিং কান্ট্রি বাংলাদেশ বাই স্ট্রাকচারাল ইকুয়েশন মডেলস শীর্ষক এ গবেষণায় সহযোগী ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মাহমুদুর রহমান।
অভ্যন্তরীণ এয়ারলাইন্সে কমপক্ষে একবার ভ্রমণ করা ৬০০ যাত্রীর ওপর তথ্য সংগ্রহ করে এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে। গবেষকরা ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দুটি দলে বিভক্ত হয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে গবেষণার জন্য যাত্রীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
জরিপের জন্য যাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া তথ্য ২৩টি আলাদা ভাগে ভাগ করেছেন। পরে বিভিন্ন মডেলে এসব তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে তারা অভ্যন্তরীণ এয়ারলাইন্সের সিস্টেম পারফরম্যান্স ও সার্ভিস ফিচার নিয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন। যাত্রীরা এয়ারলাইন্স সেবার বিভিন্ন বিষয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।
প্রতিবেদনে বিমানে সেবা নিয়ে যাত্রীদের সবচেয়ে বেশি পর্যবেক্ষণ ছিল পাইলটের দক্ষতা, কারিগরি নিরাপত্তা, স্বস্তির মাত্রা, এয়ারক্রাফট ফিটনেস, ফিজিক্যাল কন্ডিশন, সময়ানুবর্তিতা, টিকিটের দাম, ফ্লাইট সেবা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, লাগেজ ব্যবস্থাপনা ও টিকিট সিস্টেমের ওপর। গবেষকরা মনে করেন, এসব বিষয়ের ওপর নজর দিয়ে এয়ারলাইন্স সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তাদের যাত্রীসেবার মান বাড়াতে পারবে। একই সঙ্গে যাত্রীদের সন্তুষ্টিও পাওয়া যাবে।
এছাড়া গবেষকরা তাদের প্রশ্নপত্র তৈরিতে পাঁচটি বিষয়ের ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। এসবের মধ্যে ছিল কোয়ালিটি অব সার্ভিস, কোয়ালিটি অব এয়ারপোর্ট, সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যবহার। এসব বিষয়ে আবার উপবিভাগ করে ২১টিতে জরিপ কার্যক্রম চালানো হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা শৌচাগারের মান নিয়ে অসন্তুষ্ট হলেও বিমানের ক্রুদের সেবায় সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন।
তবে এয়ারলাইন্সের ৫১ শতাংশ যাত্রী সার্বিকভাবে বিমান পরিবহন ব্যবস্থার সেবা ভালো বলে অভিমত দিয়েছেন। গবেষণার বিষয়ে এর পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ড. ফারজানা রহমান বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ বিমানসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এ গবেষণার তথ্যকে কাজে লাগিয়ে এর মান উন্নত করতে পারবে। আমাদের গবেষণার মডেল থেকে পাওয়া তথ্যগুলো পরবর্তী সময়ের মধ্যে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গ্রেড অনুযায়ী দেখানো হয়েছে।
যাত্রীসেবার মান উন্নত করতে হলে আমাদের দেয়া গ্রেড অনুযায়ী গুরুত্ব দিতে হবে। যেসব জায়গায় সেবার ঘাটতি আছে, সেখানে গুরুত্ব দেয়া হলে সর্বোপরি আমাদের বিমান পরিষেবায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।’ ১৯৯৯ সালের বাংলাদেশ বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) এক গবেষণায় উঠে আসে, দেশে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে যাত্রীর হার ২২ দশমিক ৮ শতাংশ।
২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেখা গেছে প্রত্যেক বছর যা ৬ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়ছে।
ভোরের আকাশ/নি