logo
আপডেট : ১৬ এপ্রিল, ২০২৩ ১৮:০৩
ফেইসবুক ব্যবহারে নিম্ন আদালতের বিচারকদের প্রতি সুপ্রিম কোর্টের কড়া বার্তা
নিজস্ব প্রতিবেদক

ফেইসবুক ব্যবহারে নিম্ন আদালতের বিচারকদের প্রতি সুপ্রিম কোর্টের কড়া বার্তা

নিম্ন আদালতের বিচারকদের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (ফেইসবুক) ব্যবহারের ক্ষেত্রে কড়া বার্তা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাড়ে তিনবছর আগে ২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের দেয়া নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।

 

এতে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণ কর্তৃক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার দেশের প্রচলিত আইন ও বিধি-বিধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। অত্র কোর্ট কর্তৃক প্রচারিত এই নির্দেশনা অমান্য করলে তা 'অসদাচরণ' ((Misconduct) হিসেবে গণ্য হবে এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা, ২০১৭' এর পাশাপাশি প্রচলিত অন্যান্য আইন ও বিধি-বিধান প্রযোজ্য হবে।

 

ফেইসবুক ব্যবহারে কড়া বার্তা দিয়ে এবিষয়ে রোববার সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার (বিচার) এসকে. এম. তোফায়েল হাসানের স্বাক্ষরে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কতিপয় বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার কর্মকান্ডের ফলে বিচার বিভাগ সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি হচ্ছে, যা অপ্রত্যাশিত।

 

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, কতিপয় বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্র কোর্টের বিগত ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের সার্কুলার নং-০৪ জে. এ প্রদত্ত নির্দেশনাসমূহ প্রতিপালন করছেন না।

 

কোনো কোনো বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা বিচারিক কর্মঘন্টায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁদের চেম্বার অথবা কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বরত অবস্থায় তোলা ছবি বা ভিডিও আপলোড করাসহ নিজের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা ভঙ্গকারী ছবি পাবলিক পোস্ট হিসেবে আপলোড করছেন, অন্যের আপলোড করা ছবি, ভিডিও বা কন্টেট শেয়ার বা তাতে অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য করছেন।

 

এছাড়াও রাজনৈতিক ও স্পর্শকাতর বিষয়ে মন্তব্য/শেয়ার করছেন এবং ইউটিউব বা অন্যকোনো মাধ্যমে নিজ বা ছদ্মনামে চ্যানেল খুলে ভিডিও আপলোড করাসহ অপ্রয়োজনীয় ও গুরুত্বহীন অনুষ্ঠানের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করছেন।

 

কতিপয় বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার এরূপ কর্মকান্ডের ফলে বিচার বিভাগ সম্পর্কে জনমনে নেতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি হচ্ছে, যা অপ্রত্যাশিত। এমতাবস্থায় বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণ কর্তৃক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্র কোর্টের বিগত ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের সার্কুলার নং-০৪ জে এ প্রদত্ত নির্দেশনাসমূহ আবশ্যিকভাবে প্রতিপালন করার জন্য আদিষ্ট হয়ে নির্দেশ প্রদান করা হলো।’

 

জারি করা প্রজ্ঞাপনের সঙ্গে ২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর দেয়া নির্দেশনা সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে। ২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বরের প্রজ্ঞাপনে নিম্ন আদালতের বিচারকদের বিচারিক কর্মঘণ্টার পূর্ণ ব্যবহারের লক্ষ্যে অফিস চলাকালীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কঠোরভাবে পরিহার করতে বলা হয়। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের জন্য পরিহারমূলক ১১ দফা এবং অনুসরণমূলক ৮ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়।

 

এক্ষেত্রে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নের সুযোগে ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের মাত্রা অতীতের তুলনায় অনেক গুন বেড়েছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কম্পিউটার, স্মার্ট ফোন এবং অনুর যেকোনো ডিভাইসের মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তির তথ্য, ছবি, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি আদান-প্রদান করা যায়। তবে অতিমাত্রায় সা যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ফলে এক ধরনের আসক্তি তৈরি হয়, যা ব্যক্তি জীবন ও পেশাগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

 

এই পরিপ্রেক্ষিতে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষ বিভাগ সকল সরকারি কর্মচারীদের জন্য 'সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার সংক্রান্ত নির্দেশিকা, ২০১৮ প্রকাশ করেছে।

 

বাংলাদেশের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের কোনো নীতিমালা বা নির্দেশিকা গ্রহণ করা হয়নি। বর্ণিতাবস্থায়, Supreme Court Special Committe for Judicial Reforms এর সুপারিশক্রমে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি অনুসরণীয় নির্দেশনা প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

 

পরিহারমূলক ১১ দফা-

 

১. জাতীয় ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থি কোনো প্রকার তথ্য, মন্তব্য ও অনুভ‚তি প্রকাশ ও প্রচার;

 

২. কোনো সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভ‚তিতে আঘাত লাগতে পারে এমন কোনো তথ্য, মন্তব্য বা অনুভ‚তি প্রকাশ ও প্রচার;

 

৩. রাজনৈতিক মতাদর্শ বা আলোচনা সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য, মন্তব্য বা অনুভ‚তি প্রকাশ ও প্রচার;

 

৪. কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক বা হেয়প্রতিপন্নমূলক কোনো তথ্য, মন্তব্য বা অনুভ‚তি প্রকাশ ও প্রচার;

 

৫. কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রকে হেয়প্রতিপন্ন করে কোনো তথ্য, মন্তব্য বা অনুভূতি প্রকাশ ও প্রচার;

 

৬. লিঙ্গ বৈষম্যমূলক কোনো তথ্য, মন্তব্য বা অনুভূতি প্রকাশ ও প্রচার; ৭. জনমনে অসন্তোষ ও অপ্রীতিকর মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে এমন কোনো তথ্য, মন্তব্য বা অনুভূতি প্রকাশ ও প্রচার;

 

৮. কোনো মামলা সংক্রান্তে বিরূপ মন্তব্য বা ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ বা প্রচার;

 

৯. নিয়ন্ত্রণকালীণ কর্তৃপক্ষ বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোনো বিরূপ মন্তব্য বা ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশ বা প্রচার;

 

১০. বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের ছবি বা ভিডিও ক্লিপ প্রকাশ ও প্রচার; এবং ১১. অপ্রাসঙ্গিক, অপ্রয়োজনীয়, মানহানিকর এবং নৈতিকতা পরিপন্থি কোনো স্ট্যাটাস, পোস্ট, লিংক, ছবি ইত্যাদি অন্যজনকে সংযুক্তকরণ, আদান-প্রদান, প্রকাশ ও প্রচার।

 

যে ৮ দফা অনুসরণ করতে বলা হয়েছে-

 

১. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিতব্য লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও ইত্যাদি নির্বাচন ও বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে;

 

২. প্রকাশিত তথ্য ও উপাত্তের যথার্থতা ও নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে;

 

৩. ব্যক্তিগত ও পারিবারিক তথ্য আদান-প্রদান, প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে অবশ্যই সতর্কতা এবং বিচারক সুলভ মনোভাব অবলম্বন করতে হবে;

 

৪. অপ্রয়োজনীয় ও গুরুত্বহীন বিষয়ে তথ্য, স্ট্যাটাস বা পোস্ট দেওয়া যাবে না;

 

৫. বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের জন্য একটি পোর্টাল, গ্রুপ থাকতে পারে যেখানে বিচারাধীন মামলার বিষয় এবং ব্যক্তিগত বিষয় ব্যতীত কেবল আইনগত বিষয়ে আলোচনা ও তথ্য আদান-প্রদান করা যাবে;

 

৬. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ও বিচারক সুলভ আচরণ করতে হবে এবং রাষ্ট্রীয় অনুশাসন মেনে চলতে হবে;

 

৭. তথ্য আদান-প্রদান ও বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নিজ কর্মক্ষেত্রে মামলার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বা মামলা পরিচালনার সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না এবং

 

৮. বাস্তব ও স্বাভাবিক অবস্থায় সহকর্মীদের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়া সংক্রান্ত নিয়ম-নীতি, করণীয় ও বর্জনীয় দিকগুলোর প্রতিফলন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নিশ্চিত করতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/নি