এম. সাইফুল ইসলাম: রমজানে টানা কর্মসূচি বাস্তবায়নের পর এবার ঈদ-পরবর্তী কঠোর কর্মসূচিতে যাচ্ছে বিএনপি। বিভাগীয় লংমার্চ থেকে শুরু করে অবরোধের মতো কর্মসূচির কথাও ভাবছে দলটি। সরকারের বাধা ও বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা এলে বিএনপি তার কর্মসূচির গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন করবে বলেও জানা গেছে। কর্মসূচি পালনে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের পাশাপাশি যুগপৎ আন্দোলনে থাকা শরিকদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, আন্দোলনই তাদের এমমাত্র ভরসা। আগামীতে তারা এক দফা আন্দোলনের বিকল্প দেখছেন না। দিনক্ষণ ঠিক করে আন্দোলন না হলেও নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কমসূচির গতি-প্রকৃতির পরিবর্তন হয় বলেও জানান তারা। তাদের কথায় অনেকটাই স্পষ্ট যে, আগামীতে কঠোর কর্মসূচির দিকেই যাচ্ছে বিএনপি।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে হেরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়বরণ করে বিএনপি। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। যদিও বিএনপির অভিযোগ, ওই নির্বাচন ছিল একতরফা। ২০১৮ সালের নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর বেশ সতর্কভাবে পথ চলতে শুরু করে বিএনপি। অনেকটাই একলা চলো নীতিতে এগোতে থাকে বিএনপি। ২০২০ থেকে শুরু করে ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী করোনায় সরকারি বিধিনিষেধে অনেকটাই সংকুচিত হয়ে আসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। তবে ২০২১ সালের শেষ সময়ে এসে করোনাভাইরাসের প্রকটতা কমলে বেশ জোরেশোরে মাঠে নামে বিএনপি। বিশেষ করে অসুস্থ দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সুচিকিৎসায় বিদেশ পাঠানোর দাবি ও দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামে বিএনপি। তাতে দেশব্যাপী বশ সাড়া পায় দলটি।
২০২২ সালের শুরু থেকে বেশ জোরেশোরে বিএনপি দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে তৎপর হয়। কৌশলগত কারণে ২০ দলীয় জোটকে অকার্যকর করে বছরের শুরু থেকে মিত্রদের নিয়ে ‘বৃহত্তর ঐক্য’ গঠনে কাজ শুরু করে দলটি।
জানা গেছে, গত বছরের জুলাই মাসের শুরু থেকেই ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচিতে মাঠে আছে বিএনপি। বিশেষ করে জ¦ালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎসহ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে দৃঢ়ভাবে মাঠে বিএনপি। একই সঙ্গে ভোটাধিকার হরণসহ দলীয় নেতাকর্মীদের দমন-পীড়ন ইস্যুও রয়েছে। সারা দেশে বিএনপি এসব ইস্যুতে মহানগর, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, এমনকি ইউনিট ও হাট-বাজারে কর্মসূচি পালন করে। ওইসব কর্মসূচি পালনের পর নানা প্রতিকূলতার মাঝেও ঢাকাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি ১৬টি স্পটে ১৬ দিনের কর্মসূচি পালন করে। ঢাকার কর্মসূচি শেষ করে বিএনপি ১০ সাংগঠনিক বিভাগীয় শহরে সমাবেশের ঘোষণা দেয়। ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামে সমাবেশের মাধ্যমে এ কর্মসূচি শুরু হয়। ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর সমাবেশের মধ্যদিয়ে বিভাগীয় কর্মসূচি শেষ করবে বিএনপি। ওই সমাবেশে বিএনপি অফিসে পুলিশি হানা, জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তারসহ নানা ঘটনার সৃষ্টি হয়। ওই সমাবেশ থেকে দলটি বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিসহ ১০ দফার কর্মসূচি ঘোষণা করে। এরপর থেকে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনে থাকা দলগুলো যুগপৎভাবে কর্মসূচি পালন করে আসছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো বাকি প্রায় নয় মাস। তারপরও দেশের রাজনীতিতে শুরু হয়েছে নানা মেরুকরণ। আওয়ামী লীগ সংবিধানের কথা বলে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে অনড়। আর বিএনপি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে করার দাবিতে এখন আন্দোলনে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপি রমজানেও রাজপথে। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের পর বিএনপি কয়েক ধাপে বিভাগ, জেলা ও থানা পর্যায়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। পুরো রমজানজুড়েও দলটি মাঠের কর্মসূচিতে ছিল। বিএনপির সঙ্গে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ যুগপৎভাবে কর্মসূচিতে মাঠে রয়েছে। পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী, কর্নেল (অব.) অলি আহমদের এলডিপিসহ কয়েকটি দল ও সংগঠন বিএনপির ১০ দফা দাবির সমর্থনে কর্মসূচি পালন করছে। যদিও বিএনপি ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ থেকে দেয়া ১০ দফার প্রতি জামায়াত সমর্থন জানালেও গত কয়েক মাসের কর্মসূচিতে তারা যুগপৎ আন্দোলনে নেই।
বিএনপি এখন ব্যাপকভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। পাশাপশি দলটি এখন শরিকদের সঙ্গে যে বোঝাপড়ায় ব্যস্ত তা গত কয়েকদিনের কর্মতৎপরতায় স্পষ্ট। গত ২ এপ্রিল গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলটির নেতারা গণতন্ত্র মঞ্চের লিয়াজাঁ কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেন। ৭ এপ্রিল ১২ দলীয় জোটের লিয়াজোঁ কমিটি ও বিএনপি নেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গত ৮ এপ্রিল জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা। এসব বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। জোটগুলোর দায়িত্বশীল নেতারা অংশ নেন বৈঠকে। বৈঠকে অংশ নেয়া একাধিক নেতা ভোরের আকাশকে জানিয়েছেন, ঈদ-পরবর্তী কর্মসূচি ও আন্দোলনের নানা কৌশল নিয়ে এসব বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়। নিজেদের মধ্যে মান-অভিমান নিয়েও পরস্পরের আলোচনায় উঠে আসে।
শরিকদের সঙ্গে বৈঠক, রমজানে ইফতার পার্টি ও মাঠের কর্মসূচির মাধ্যমে দলটির ঈদের পর কঠোর আন্দোলনের বার্তা নেতাকর্মীদের মাঝে পৌঁছে দিয়েছে। জানা গেছে, ঈদের পর থেকে মাঠের কঠোর কর্মসূচি আসছে। দলটি জুলাই, আগস্ট মাসকে টার্গেট করে এগোলেও মূলত ঈদের পর থেকে টানা মাঠে থাকার চেষ্টা করবে। ঈদের এক সপ্তাহ পরে দলটি আবারো বিক্ষোভ সমাবেশের মতো কর্মসূচি ঘোষণা করে নেতাকর্মীদের মাঠে নামাবে। এরপর মে মাসের মধ্যেই বিভাগ টু বিভাগ লংমার্চের পরিকল্পনা করছে। পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কয়েক ঘণ্টার সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচির চিন্তা-ভাবনা করছে। এসব কর্মসূচিতে বাধা এলে কর্মসূচির কৌশল পরিবর্তন করে ভিন্ন কায়দায় আরো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হতে পারে।
এসব কর্মসূচিতে শরিকদের সর্বোচ্চ সমর্থন নিয়ে মাঠে থাকার নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপি। কর্মসূচি পালনে একই সময় বিভিন্ন স্থানে জড়ো হওয়া ও ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেয়ার ব্যাপারেও চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শরিকদের সঙ্গে শুরু হওয়া বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহীম বলেন, বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা অনেকটাই এখন চূড়ান্ত। এক দফার আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। তাই বিএনপি শিগগিরই যে আন্দোলনের ডাক দেবে সেখানে শরিকদের সর্বাত্মক মাঠে থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও জাপার (জাফর) নেতা মোস্তফা জামাল হায়দার বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে গত বৈঠকে কর্মসূচির ধরন ও কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সে অনুয়ায়ী ঈদের পর থেকে মাঠে নামা হবে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, বিএনপি ও তার মিত্ররা এক দফার আন্দোলনের কোনো বিকল্প দেখছে না। দিনক্ষণ দিয়ে আন্দোলন হয় না। আন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে তাই দ্রুত বিএনপির এক দফার আন্দোলনের কর্মসূচিতেও পরিবর্তন আসবে। ঈদের পর কর্মসূচির ব্যাপারে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরাম থেকে আলোচনার পর জানানো হবে।
ভোরের আকাশ/আসা