logo
আপডেট : ২৫ এপ্রিল, ২০২৩ ১২:৫৭
বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস আজ
কঠিন হচ্ছে ম্যালেরিয়া নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন
নিখিল মানখিন

কঠিন হচ্ছে ম্যালেরিয়া নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন

নিখিল মানখিন: ম্যালেরিয়া নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে ম্যালেরিয়া নির্মূল করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। বাহকদের অসচেতনতা, গতানুগতিক উপায়ে নির্মূল কার্যক্রম পরিচালনা এবং আন্তঃসীমান্ত সমন্বয়হীনতার কারণে গত ৫০ বছরেও ম্যালেরিয়ামুক্ত হতে পারেনি বাংলাদেশ। করোনা মহামারির সময় শনাক্ত (ডায়াগনসিস) কম হওয়ায় রোগীর সংখ্যা কমেছিল।

 

ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ নয়, চিরতরে ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচিতে নেমেছে বাংলাদেশ। ২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূলকরণে ম্যালেরিয়াজনিত স্থানীয় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। তবে এখনো দেশের প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে সাফল্য এলেও তিন পার্বত্য জেলা এখন পর্যন্ত ঝুঁকিতে রয়েছে। এখনো দেশের ১৩ জেলায় মশাবাহিত এ রোগের প্রকোপ রয়েছে। গত দুই বছরে যেসব জেলায় শূন্যের কোটায় নেমেছিল, আবারো সেখানে সংক্রমণ ঘটছে। যদিও আক্রান্তের সংখ্যা কম। তবে বাংলাদেশকে ম্যালেরিয়ামুক্ত ঘোষণা করতে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পাহাড়ি জেলা বান্দরবানের তিন উপজেলা। দেশে যত ম্যালেরিয়ার রোগী, তার ৮৫ শতাংশই জেলাটির লামা, আলীকদম ও থানচি উপজেলায়।

 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২১ সালে সারা দেশে যেখানে ৭ হাজারের সামান্য বেশি রোগী শনাক্ত হয়, সেখানে ২০২২ সালে এসে ১৮ হাজার ১৬৭ জনে দাঁড়িয়েছে; যা আগের বছরের তুলনায় আড়াইগুণ বেশি। শুধু আক্রান্ত নয়, গত এক বছরে প্রাণহানির সংখ্যাও বেড়েছে। ২০২১ সালে ৯ জনের মৃত্যু হলেও গত বছর মারা গেছেন ১৪ জন। যা আগের বছরের দেড়গুণ বেশি। ২০২২ সালে ডায়াগনসিস হয়েছে ৭৫ হাজার ২৩৭ জনের। প্রকোপ সবচেয়ে বেশি বান্দরবানে। এ জেলার তিন উপজেলায় ৮৫ শতাংশের বেশি রোগী। জেলার সবচেয়ে দুর্গম এলাকা হওয়ায় সেখানে ঠিক তো ডায়াগনসিস করা ও চিকিৎসা দিতে পারছেন না স্বাস্থ্যকর্মীরা। এছাড়া রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারও ম্যালেরিয়ার উচ্চঝুঁকির তালিকায়। আর সংখ্যায় কম হলেও এখনো ম্যালেরিয়া রয়েছে ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম, সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলায়।

 

করোনার সময়ের দুই বছরে কুড়িগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোয় শূন্যের কোটায় চলে এলেও আবারো সেখানে প্রকোপ বাড়ছে, যা রীতিমতো উদ্বেগের বলছেন সংশ্লিষ্টরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ) ডা. ইকরামুল হক ভোরের আকাশকে বলেন, আন্তঃসীমান্তের কারণে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ চ্যালেঞ্জের হয়ে দাঁড়িয়েছে। মশার আবাস্থল এখন পাহাড়ি জেলায়গুলো। বিশেষ করে বান্দরবান। এ জেলার তিনটি থানায় সবচেয়ে বেশি। এসব এলাকা মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত। এপারে কার্যক্রম চালালেও সীমান্তের ওপারে কতটুকু হচ্ছে, সেটাও নির্ভর করে। কিন্তু সেখানকার অবস্থা আমরা জানতে পারছি না। দেশটির ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা সেখানকার চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কোনো দেশের সঙ্গে কাজ করতে পারবে না বলে জানিয়েছে। তবে ভারতের সঙ্গে চারটি সভা হয়েছে। তারা একসঙ্গে কাজ করতে রাজি হয়েছে।

 

বিশ্ব  স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো এলাকায় পরপর তিন বছর ম্যালেরিয়ার স্থানীয় সংক্রমণ না থাকলে, সেই এলাকাকে ম্যালেরিয়ামুক্ত ঘোষণা করা যেতে পারে। সে অনুযায়ী গত চার বছরে ম্যালেরিয়াপ্রবণ ১৩ জেলার দুই-তৃতীয়াংশ উপজেলায় কোনো ম্যালেরিয়া রোগী পাওয়া যায়নি। বাকি ৫১ জেলা আগে থেকেই ম্যালেরিয়ামুক্ত। সংশ্লিষ্টরা জানায়, নানা কর্মসূচির পরও কাক্সিক্ষত পর্যায়ে ম্যালেরিয়া নির্মূল করতে না পারায় কারণ উদ্ঘাটনে সরেজমিন তদন্তে নামে অধিদপ্তরের ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির কর্মকর্তারা। তদন্তে বেরিয়ে আসে আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যারা বনে যান, কৃষিকাজ করেন এবং স্থানীয় মোরো সম্প্রদায়ের জীবনাচারের কারণে সেখানে অন্যান্য এলাকার চেয়ে প্রকোপ বেশি। অধিক সময়ে তারা ছোট পোশাক পরায় এবং ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন করায়ও সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে সেখানে। এজন্য নতুন কর্মকৌশল নির্ধারণ করেছে সরকার। আক্রান্তদের অন্যান্য চিকিৎসা দেয়ার পাশাপাশি মশারিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। দেয়া হবে ভ্যাকসিনও। আগামী মে মাসের দিকে বান্দরবানের অধিক সংক্রমণ এলাকাগুলোর জনগোষ্ঠীর ওপর পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এসব কার্যক্রম বেশিরভাগ বাস্তবায়ন করে থাকে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। সংস্থাটির নিজস্ব স্বাস্থ্যকর্মীরা মাঠপর্যায়ে সরসারি এ কাজে সম্পৃক্ত। পাহাড়ের মানুষের হাতের কাছে হাসপাতাল না থাকায় ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মীরা এ দায়িত্ব পালন করেন। শনাক্তকরণে আলাদা ল্যাবরেটরি, স্বাস্থ্যসেবিকা, স্বাস্থ্যকর্মী ও প্রোগ্রাম অফিসার রয়েছে ব্র্যাকের। ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির উপদেষ্টা ডা. মুশফিকুর রহমানের। তার নেতৃত্বে নতুন কর্মকৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে।

 

ডা. মুশফিক বলেন, ‘ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের প্রধান চ্যালেঞ্জ বান্দরবান। তাই আলাদা করে সেখানে গবেষণা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জিআইএস পদ্ধতি ব্যবহার করে দশজনের একটি টিম তৈরি করা হয়েছে। আমরা দেখেছি, আক্রান্তদের মধ্যে যারা নিয়মিত বনে যান, জুম ও কৃষির সঙ্গে জড়িত, তাদের মাধ্যমেই মূলত ট্রান্সমিশন বেশি হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে যাতে এটি না হয়, সেজন্য এ শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রথম গ্রাম চিহ্নিত করেছি। এ বছর চারটি গ্রামে ম্যালেরিয়ার ওষুধের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো ভ্যাকসিন ট্রায়ালের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী ২২ মার্চ এ ব্যাপারে একটি সভা হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানেই দিনক্ষণ ও টিকা প্রদানের প্রক্রিয়া ঠিক করা হবে। একই সঙ্গে প্রতি দুই সপ্তাহ পরপর সেখানে ডায়াগনসিস করা হবে।’

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক (সংক্রামক) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, দেশকে ম্যালেরিয়ামুক্ত করা একটি কঠিন কাজ। তবে ম্যালেরিয়া নির্মূলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ প্রত্যেক নাগরিককে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করলে তা অসম্ভবও নয়। ডোবা, গর্ত, নর্দমা ইত্যাদি যেখানে মশা ডিম পাড়ে ও বংশ বিস্তার ঘটায় সেসব জায়গা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব জাতীয় ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নয়। এটি আরেকটি মন্ত্রণালয়ের কাজ। অর্থাৎ সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া ম্যালেরিয়া নির্মূল করা যাবে না। তবে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে বেশ সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশ একা সফল হলেই চলবে না। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারেও ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সফলতা আসতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/আসা