logo
আপডেট : ২৮ এপ্রিল, ২০২৩ ১৭:৪৩
প্রশান্তির খোঁজে যেতে পারেন নীলসাগর ও তিস্তার পাড়ে
নীলফামারী প্রতিনিধি

প্রশান্তির খোঁজে যেতে পারেন নীলসাগর ও তিস্তার পাড়ে

ঈদ, পূজা কিংবা সাপ্তাহিক ছুটিতে ভ্রমণের সুযোগ নিয়ে থাকেন অনেকে। ছুটির সময়টাকে উপভোগ করতে যে যার মতো বন্ধু, পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরতে বের হন। কর্মব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে এ সময় কিছুটা প্রশান্তির খোঁজ করেন ভ্রমণপিপাসুরা। উত্তরের জেলা নীলফামারী হতে পারে প্রকৃতিপ্রেমীদের পছন্দের স্থান।

 

এই জেলায় শতাধিক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এর মধ্যে সারা দেশে জনপ্রিয় নীল সাগর, তিস্তা ব্যারেজ, নীলকুঠির, চিনি মসজিদ ও কুন্দুপুকুর মাজার। এগুলোর ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও গুরুত্ব অনেক। এছাড়াও রয়েছে, ভিমের মায়ের চুলা, পাল রাজার বাড়ি, হরিশ্চন্দ্র রাজার বাড়ি এবং দেশের সর্ববৃহৎ সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা। সমুদ্র নয়, তবে সাগরের সঙ্গে মিল রেখে ১৯৮০ সালে বিন্নাদিঘির নামকরণ করা হয় নীলসাগর।

 

এর আয়তন ৯৩ দশমিক ৯০ একর। তবে এর গভীরতা এখনো কেউ মাপতে পারেনি। ধারণা করা হয়, ৭০ থেকে ৭৫ ফুট গভীর হবে। দিঘির পাড়ে আছে সুউচ্চ বৃক্ষরাজি, তরুলতা, মাটির পাড়বেষ্টিত বেতবন ও গুল্মলতা। শীতের সময় অতিথি পাখির কলতানে মুখর হয়ে ওঠে নীলসাগর।

 

জনশ্রুতি আছে, ২০০ বছর আগে এক রাজা স্থানীয় গৃহপালিত পশুদের পানি পানের কথা ভেবে দিঘিটি খনন করেন। সনাতন ধর্মাম্বলীদের মতে, মহাভারতে বর্ণিত বিরাট রাজা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মারা গেলে তার শেষকৃত্য হয় এই দিঘির পাড়ে। অনেকের ধারণা, রাজার একমাত্র কন্যা বিন্নাবতীর গোসলের জন্য এটি খনন করা হয়। এ জন্যই বিন্নাদিঘি নাম পেয়েছে এটি।

 

১৯৮০ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক এ দিঘির সংস্কারকাজের উদ্বোধন করেন। তখন তিনি এর আনুষ্ঠানিক নাম দেন নীলসাগর। এই নামে জেলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, পত্র-পত্রিকা, যানবাহন, এমনকি নীলফামারী-ঢাকাগামী আন্তঃনগর নীলসাগর ট্রেনের নামকরণ করা হয়। জেলা শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নীলফামারী-দেবীগঞ্জ-পঞ্চগড় সড়কের পাশে অবস্থিত নীলসাগর। শহর থেকে ভ্যান, অটোরিকশা, বাস, মাইক্রোবাস, ট্রেনে যোগাযোগের সুব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও আকাশপথে সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে বাস বা ট্রেনে যাওয়া যায়।

 

বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এখানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও অতিথি পাখির অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয়েছে। শিশুদের জন্য রয়েছে বিনোদনের ব্যবস্থা। চৈত্র মাসে বসে মেলা। পর্যটকদের জন্য আবাসিক সুবিধাসহ বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া নীলফামারী মিউজিয়ামের অবস্থান এখানে।

 

তিস্তা বাংলাদেশের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্র‏হ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তিস্তা নদীর দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১১৫ কিলোমিটার লালমনিরহাটে পড়েছে। দর্শনীয় ব্যারেজটি তিস্তা সেচ প্রকল্পের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত বৃহত্তম সেচ প্রকল্প।

 

প্রকল্পটি নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে। খরা মৌসুমে কৃষকরা সেচ দিয়ে থাকে। অঞ্চলটিতে খরা লেগে থাকায় ১৯৩৭ সালে তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। পরে মূল পরিকল্পনা হয় ১৯৫৩ সালে।

 

ব্যারেজ এলাকা প্রতিদিনই দর্শনার্থীদের ভিড়ে মুখর থাকে। বিশেষ করে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও বগুড়া থেকে স্থানীয় পর্যটকরা প্রতিদিনই আসেন এখানে। এখানে আছে ৫২টি স্লুইস গেট। এর মধ্যে মূল জলকপাট রয়েছে ৪৪টি।

 

নীলসাগর ছাড়িয়ে নীলফামারী ঘুরলে পাবেন ব্রিটিশ আমলের নীলকুঠিও। কৃষক বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ নীলফামারীর ইতিহাসে অন্যতম অধ্যায়। ১৮০০ সালে জেলা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে নটখানায় নীলচাষের একটি বড় খামার ছিল। ১৮৫৯-৬০ সালে কৃষকদের ব্যাপক আন্দোলনের ফলে নীলচাষ বন্ধ হয়। সে সময় এলাকা ছেড়ে নীলকররা পালিয়ে যায়। নীলখামার থেকেই আজকের নীলফামারী। আজো সেই নীলকুঠি দেখতে আসে ইতিহাসপ্রেমীরা।

 

জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা, বুড়িতিস্তা, বুড়িখোড়া, ইছামতি, চাঁড়ালকাটা, সর্বমঙ্গলা, যমুনাশ্বরী, সালকী, কুমলাই নদ-নদী। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, জেলা শহরের উপকেন্দ্রে সর্বমঙ্গলার তীরে ছিল শাখা ও মাছা নামের দুটি বন্দর। ওই বন্দর থেকে নীলকরদের মালামাল আমদানি-রপ্তানি হতো। ১৮৭৫ সালের ১৮ মে জেলার ডিমলায় বাগডোকরা নামক স্থানে প্রথম মহকুমার কার্যক্রম শুরু হয়। ১৮৮২ সালের ১৯ মে মহকুমা স্থানান্তর করে বর্তমান জেলা প্রশাসকের বাসভবন সংলগ্ন সুউচ্চ টিনের ভবনটিকে মহকুমা দপ্তর বানানো হয়। এখনও ঘরটির ছবি তুলতে আসেন আলোকচিত্রীরা।

 

ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সৌন্দের্যের অপার সমন্বয় ঘটেছে সৈয়দপুর শহরে গোলাহাটের চিনি মসজিদে। তিনটি বড় গম্বুজ ও ৩২টি মিনারের মসজিদটি উজ্জ্বল পাথরে আবৃত। চিনামাটির টুকরায় বিভিন্ন ফুল ও গাছের নকশা ভ্রমণপিপাসুদের নজর কাড়ে। ১৮৬৮ সালে উপজেলার গোলাহাট এলাকায় বানানো হয় মসজিদটি। শুরুতে ছিল দোতলা টিনের ঘর। ১৯২০ সালে এলাকার হাজি হাফেজ আব্দুল করিম মসজিদটি পাকা করার উদ্যোগ নেন। জেলা শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে কুন্দুপকুর ইউনিয়নে অবস্থিত কুন্দুপুকুর মাজার। এ এলাকায় ইসলাম প্রচার করতে আসা শাহ সুফি হযরত মীর মহিউদ্দিন চিশতির (রহ.) মাজার এটি।

 

ভোরের আকাশ/ আসা