শাহীন রহমান: সিটি নির্বাচনে আচরণবিধি রক্ষা করা নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৫ সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। কোথাও কোথাও গুরুতর আকার ধারণ করছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারছে না ইসি। সম্প্রতি আচরণবিধি প্রতিপালনের অনুরোধ জানিয়ে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে আচরণবিধি রক্ষায় ইসির অসহায়ত্বের বিষয়টি ফুটে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনে ব্যবস্থা নিতে ইসির হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা রয়েছে। সরকারের সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিরুদ্ধেও আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ প্রমাণিত হলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু অতীতে এর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ইসি শুধু চিঠি দিয়ে দায় সারছে। ব্যবস্থা না থাকায় বারবার আচরণবিধি লঙ্ঘনের এ ঘটনা ঘটছে।
আইন অনুযায়ী সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবে না। এছাড়াও নির্বাচনে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে নির্বাচনী এলাকায় এমন সব ধরনের কার্যক্রমও আচরণবিধি লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে। অথচ সম্প্রতি গাজীপুর সিটি নির্বাচনে সরকারের একজন মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে নির্বাচন কমিশন। সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যাতে দলীয় বা অন্য যেকোনো কর্মকান্ডে আচরণবিধি মেনে চলেন, তার জন্য পরামর্শ প্রদানের জন্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় পার্টির মহাসচিবকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানানোর কথা জানিয়েছে ইসি।
অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন অনুযায়ী নির্বাচনী আচরণবিধি মান্য করতে সবাই বাধ্য। লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ইসি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে। আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু চিঠি দিয়ে পরামর্শ দেয়া ইসির এক ধরনের অসহায়ত্ব ছাড়া আর কিছু নয়।
ইসির চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্রমণসূচি জারি করেন। বিষয়টি রিটার্নিং অফিসার জ্ঞাত হয়ে মাননীয় মন্ত্রীদ্বয়ের একান্ত সচিবগণকে নির্বাচনী আচরণবিধির বিষয়টি অবগত করেন। একই সঙ্গে তিনি পত্র মারফত সংশ্লিষ্ট মাননীয় মন্ত্রীদ্বয়ের একান্ত সচিবগণকে অবহিত করেন। তদসত্ত্বেও মাননীয় মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন।’
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ইসির এ ধরনের চিঠি আত্মপক্ষ সমর্থন ছাড়া আর কিছুই নয়।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাও বলেছেন ইসি মো. আলমগীর। তার কথায়ও সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আচরণবিধি না মানার প্রবণতার বিষয়টি উঠে এসেছে। তিনি বলেন, নির্বাচনী এলাকায় আচরণবিধি না মানার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ইসি থেকে বিজ্ঞপ্তি দেয়ার পরও প্রার্থী ও তাদের শুভাকাক্সক্ষীদের মধ্যে আচরণবিধি লঙ্ঘনের এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
গত ২৭ এপ্রিল গাজীপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী আজমত উল্লাহ খানের বিরুদ্ধেও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। ইসির পক্ষ থেকে আজমত উল্লাহ খানকে চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে ৭ মে ইসিতে উপস্থিত হয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় কোনো ধরনের মহড়া করা যাবে না। রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে প্রার্থীর সঙ্গে পাঁচজনের বেশি লোক থাকতে পারবে না।
কিন্তু মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময় আওয়ামী লীগের এই প্রার্থীর সঙ্গে ছিলেন কমপক্ষে ১০ নেতাকর্মী। পাশাপাশি সড়কেও ছিল নেতাকর্মীদের মহড়া।
যদিও আজমত উল্লাহ খান দাবি করেছেন, তিনি আচরণবিধি ঠিক রেখেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। শোডাউনের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
ইসির দেয়া সতর্ক নোটিশে আজমত উল্লাহর আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে কেন তার প্রার্থিতা বাতিল করা হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু অতীতেও এ ধরনের ঘটনায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আজমত উল্লাহর বিরুদ্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে, তা ৭ তারিখেই বোঝা যাবে।
ইসির চিঠিতে আরো বলা হয়েছে ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সরকারি সুবিধাভোগী অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যাতে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণকালে নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলেন, তার জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে মাননীয় নির্বাচন কমিশন বিশেষভাবে নির্দেশনা প্রদান করেছেন।’
এতে আরো বলা হয়েছে, সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নির্বাচন-পূর্ব সময়ে নির্বাচনী এলাকায় প্রচারণায় বা নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ না করার জন্য সিটি করপোরেশন (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালা, ২০১৬-এর ২২ বিধিতে বিধান রয়েছে। তাছাড়া আচরণ বিধিমালার বিধি ৭, বিধি ১৩, বিধি ২০, বিধি ২৫ অনুযায়ী সভা-সমিতি অনুষ্ঠান, যানবাহনসহকারে মিছিল বা মশাল মিছিল, ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রচার, প্রকল্প অনুমোদন, ফলক উন্মোচন ইত্যাদি না করার বিষয়ে বিধান রয়েছে।
আগামী ২৫ মে গাজীপুর, ১২ জুন খুলনা ও বরিশাল, ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এসব সিটিতে নির্বাচনের জন্য মনোনয়পত্র জমার কাজ চলছে। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা ও বাছাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর থেকেই এসব সিটিতে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠছে। ইসি শুধু একের পর এক নোটিশ দিয়েই দায় সারছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করতে মাঠ প্রশাসনকেও একই নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
ইসির নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার উপসচিব মো. আতিয়ার রহমান জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও জেলা প্রশাসককে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনায় বলা হয়, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বশর্ত নির্বাচনী আচরণবিধি যথাযথভাবে প্রতিপালন। আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলো নির্বাচনী এলাকার আচরণবিধির যথাযথ প্রয়োগ ও প্রতিপালন নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপার যথাযথ দায়িত্ব পালন করবেন।
ইসি চিঠি দিয়ে দায় সারলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইসির হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা রয়েছে। এমপি-মন্ত্রী, সুবিধাভোগী বা অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান করে আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে শাস্তির ক্ষমতা আইনে রয়েছে। এক্ষেত্রে ছয় মাসের জেল অথবা ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ড দেয়ার নির্দেশনা আছে। এমনকি ওই ব্যক্তিরা আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর সংশ্লিষ্টতা থাকলে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা দেয়া আছে।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনের হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইসির প্রায়ই অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে দেখা যায়। এটা ভালো লক্ষণ নয়। এতে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় হতাশা ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারে।
ভোরের আকাশ/নি