logo
আপডেট : ৫ মে, ২০২৩ ১০:৫৪
প্রেস-পুলিশ স্টিকারযুক্ত গাড়িতে সয়লাব ঢাকা
ইমরান খান

প্রেস-পুলিশ স্টিকারযুক্ত গাড়িতে সয়লাব ঢাকা

ইমরান খান: নিষিদ্ধ হলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, সাংবাদিক, প্রেস, আদালত, বিচারক, আইনজীবী ও মুক্তিযোদ্ধার স্টিকার লাগিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার ও সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন। ব্যক্তিগত গাড়িতে আলগা স্টিকার ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও তা মানছেন না কেউ। খোদ পুলিশ কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও আইনজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ব্যক্তিগত গাড়িতে আলগা স্টিকার ব্যবহার করছেন।

 

এসব স্টিকারের কারণে চোরাই ও অনিবন্ধিত গাড়ি ধরতে গিয়ে বিভ্রান্ত হতে হয় ট্রাফিক পুলিশকে। আর এ সুযোগে স্টিকার লাগিয়ে সড়কে চলাচল করছে অনেক অনিবন্ধিত ও চোরাই গাড়ি। মাঝেমধ্যে এ ধরনের স্টিকারযুক্ত যানবাহন ব্যবহার করে মাদক সরবরাহ, খুন ও ছিনতাইসহ নানা অপরাধের ঘটনাও ঘটছে। তবে স্টিকারযুক্ত যান চলাচল রোধে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই ট্রাফিক পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

 

সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর বিজয় সরণি মোড়ের সিগন্যালের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকশ মোটরসাইকেল। এর মধ্যে দুটি মোটরসাইকেলের নম্বর প্লেটে প্রেস ও অন্য দুটি মোটরসাইকেলের সামনে পুলিশ এবং ছাত্রলীগের স্টিকার লাগানো। নম্বর প্লেটে প্রেস স্টিকার কেন জানতে চাইলে সুমন নামের মোটরসাইকেল চালক বলেন, আমার বড় ভাই গণমাধ্যমকর্মী। এটা তার গাড়ি। আমি জরুরি কাজে বাইক নিয়ে বের হয়েছি।

 

অপর একজনের কাছে পুলিশের স্টিকার লাগানোর কারণ জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। এছাড়া ছাত্রলীগের স্টিকার ব্যবহার করা রাফি নামের মোটরসাইকেল চালকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বাইকটি রেজিস্ট্রেশন করা। ডিজিটাল প্লেটও রয়েছে। সংগঠন করি। এজন্য শখের বসে স্টিকার লোগিয়েছি।

 

রাজধানীর শান্তিনগর এলাকায় চোখে পড়ে কুরিয়ার সার্ভিস ‘এস এ পরিবহন’-এর একটি কাভার্ডভ্যান। কাভার্ডভ্যানটির সামনের দিকে ও পেছনে রং দিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের নাম লেখা। কারণ জানতে চাইলে চালক বলেন, মাঝেমধ্যেই ট্রাফিক পুলিশের ঝামেলায় পড়তে হয়। এছাড়া এই স্টিকারের জন্য অনেক সময় চাঁদাবাজরাও ডিস্টার্ব করে না। এর বেশি কিছু জানতে হলে অফিসে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি।

 

ড্রাইভিং লাইসেন্স ও নিবন্ধন নেই এমন এক মোটরসাইকেল চালকের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, নিবন্ধন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স করার জন্য বিআরটিএ কার্যালয়ে গিয়ে তাদের হয়রানির শিকার হতে হয়। ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে রাখলেও লাইসেন্স ডেলিভারি হয়নি দীর্ঘ ৬ মাসেও। এজন্য ডেলিভারি স্লিপ দিয়েই গাড়ি চালাচ্ছি।

 

তথ্য বলছে, বেশিরভাগ মোটরসাইকেল ও মোটরযান পুলিশের ঝামেলা ও চাঁদাবাজদের হাত থেকে বাঁচতে বিভিন্ন স্টিকার ব্যবহার করেন। তবে এসব স্টিকারযুক্ত যানবাহন ব্যবহার করে খুন, মাদক পাচারসহ নাশকতা ও চোরাই গাড়ি পাচারসহ নানা অপরাধের ঘটনার সংখ্যাও কম নয়।

 

২০২২ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে বরিশালগামী একটি লঞ্চে এক যাত্রীর মানিব্যাগ চুরির অভিযোগে মো. রিপন নামের এক ব্যক্তিকে পুলিশের স্টিকারযুক্ত একটি মোটরসাইকেলসহ আটক করে নৌ পুলিশ। এ সময় তার কাছ থেকে পুলিশের একটি ব্যাগও উদ্ধার করা হয়।

 

পরে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তার বিরুদ্ধে মির্জাগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা রয়েছে। পুলিশের স্টিকার ও ব্যাগ ব্যবহার করার বিষয়ে সে জানায়, তার পরিবারের কেউ একজন পুলিশে কর্মরত। তার কাছ থেকেই সে স্টিকার ও পুলিশের ব্যাগ পেয়েছে।

 

এছাড়া ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি প্রাইভেটকারে জাতীয় সংসদ সদস্যের স্টিকার ব্যবহার করে মাদক পাচার করার সময় নারায়ণগঞ্জ থেকে ভুয়া সংসদ সদস্যসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-১১-এর সদস্যরা। এ সময় বিপুল পরিমাণ ফেনসিডিল ও ইয়াবাসহ মাদক পাচারের কাজে ব্যবহৃত প্রাইভেটকারটি জব্দ করা হয়।

 

একসময় হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করতেও প্রেস (সাংবাদিক) স্টিকার লাগানো মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হতো। এ ধরনের স্টিকার লাগানো মোটরসাইকেল পুলিশ আটক করে না বলেই শিবির ক্যাডাররা এই কৌশলের আশ্রয় নিয়ে দ্রুত নিরাপদে পালাতে পারত। ২০১২ সালে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ শিবির নেতাদের প্রেস স্টিকার লাগানো ৫টি মোটরসাইকেল আটক করার পর চাঞ্চল্যকর এই তথ্য সামনে আসে।

 

এছাড়া প্রেস-পুলিশের স্টিকারযুক্ত গাড়ি থেকে মাদক উদ্ধারের ঘটনাও হরহমেশাই ঘটছে।

 

২০১৬ সালে যানবাহনে পুলিশ, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ কোনো পেশার নাম উল্লেখ করে ‘আলগা স্টিকার’ ব্যবহার করা যাবে না বলে পুলিশের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। ওই সময় নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিশ্চিত করে তৎকালীন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ( ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানিয়েছিলেন, যানবাহনে পুলিশ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, সিটি করপোরেশন, আইনজীবী ইত্যাদি স্টিকার ব্যবহার করা হবে না। এ ধরনের আলগা স্টিকার সন্ত্রাসীরা ব্যবহার করে অপরাধ করতে পারে। এ জন্যই এমন নিষেধাজ্ঞা।

 

এমন ঘোষণার পর স্টিকারযুক্ত যানবাহনের বিরুদ্ধে জোরেশোরে অভিযান চালায় ট্রাফিক পুলিশ। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে অনেক মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন আটক করে জরিমানা করা হয়। কিন্তু অজানা কারণে কিছুদিনের মধ্যেই থেমে যায় ট্রাফিক পুলিশের কড়াকড়ি।

 

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, গত ছয় বছরে দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়েছে ২৬ লাখের বেশি। দেশে যে পরিমাণ নিবন্ধিত মোটরসাইকেল আছে, তা মোট যানবাহনের ৭০ শতাংশ। আর শুধু ঢাকা শহরেই নিবন্ধিত মোটরসাইকেল সাড়ে ১৩ লাখের মতো।

 

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল নিবন্ধন হয়েছে ২০১৯ সালে। ওই বছর ৪ লাখ ৬ হাজার ৮৯৭টি মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হয়েছে। তবে এর বাইরেও রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে লক্ষাধিক অনিবিন্ধত মোটরসাইকেল।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) এ কে এম হাফিজ আক্তার দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, বেআইনিভাবে অবশ্যই কোনো যানবাহন সড়কে চলতে দেয়া হবে না। এ বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশও কাজ করছে। প্রয়োজনে তাদের এ বিষয়ে আরো বেশি কঠোর হওয়ার জন্য বলা হবে।

 

সাংবাদিক, পুলিশ বা অন্য কোনো পরিচয়ে গাড়ি চালানো ঠিক না। এছাড়া বিআরটিএর নিবন্ধন ছাড়া কোনো যানবাহন সড়কে চলতে পারে না।

 

ভোরের আকাশ/নি