logo
আপডেট : ৬ মে, ২০২৩ ১১:২৫
বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা

আমজনতার বাজেট বস্তুত জনগণের জন্য এবং জনগণের দ্বারা প্রণীত ও বাস্তবায়িত হওয়ার কথা। যাদের বাজেট তাদের মতামত সেখানে প্রতিফলিত হওয়া বাঞ্ছনীয় এজন্য যে, তাহলে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণে বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন উন্নয়ন কার্যক্রম দ্রæত বাস্তবায়ন এবং সম্পদের সুষম বণ্টন সম্ভব হয়। বাজেট বাস্তবায়নের দ্বারা সুফল প্রাপ্তিতে পক্ষপাতিত্ব, একদেশদর্শিতা, বৈষম্য ও বঞ্চনা বৃদ্ধি কিংবা কর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতিপক্ষতার পরিবেশ সৃষ্টি সমন্বিত উন্নয়ন সাধন ধারণার পরিপন্থি।

 

নির্বাহী বিভাগ থেকে যে নীতি-দৃষ্টিকোণ অবস্থা-ব্যবস্থায় বাজেট প্রস্তাব পেশ করা হয়ে থাকে তাতে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী আইন পরিষদের তেমন কিছু করার না থাকলে এটি মুখ্যত নির্বাহী বিভাগের বাজেট হয়ে যায়, ফলে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন একই পক্ষের হাতে থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে মৌলিক সমস্যা হলো বাস্তবায়নকারী (নির্বাহী বিভাগ) তার নিজস্ব দৃষ্টি দিয়েই যে নীতি প্রেসক্রাইব করে সবার সেটা অনুসরণ করা ছাড়া যেন গত্যন্তর থাকে না।

 

আইনপ্রণেতা বাজেট অনুমোদনকালে তাকে প্রদত্ত সাংবিধানিক ক্ষমতা ব্যবহার ও দায়িত্ব পালন না করলে, বাজেটকে জনগণের জন্য করার লক্ষ্যে যথা বিশ্লেষণ-ব্যবচ্ছেদে না গেলে বাজেট জনগণের বা অর্থনীতির জন্য টেকসই হতে পারে না। সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে বাজেট প্রস্তাব প্রণয়ন ও পরীক্ষা এবং বাজেট বাস্তবায়ন-উত্তর সম্পূরক বাজেট অনুমোদনে জবাবদিহিমূলক পন্থায় না গেলে একটি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ দেশের বাজেট তার সীমাবদ্ধতার বলয় থেকে বের হতে পারবে না।

 

অত্যন্ত অস্বস্তিকর যে, বাংলাদেশে পরোক্ষ কর রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায়। সবাই জানে ভ্যাট টাসেস এভরিবডি বাট ইনকাম ট্যাক্স ডাজ নট। পরোক্ষ কর ওরফে ভ্যাট কর সব জনগণ দিয়ে থাকে, ব্যবসায়ীরা সেই কর নিয়ে সরকারের খাজান্সিখানায় জমা দিচ্ছে কিনা সেটি সুনিশ্চিত হয় না। পক্ষান্তরে প্রত্যক্ষ কর বা ইনকাম ট্যাক্স যার আয় বেশি সেই দেয় এবং সরাসরি সরকারকে দেয়। বহুদিন যাবৎ সব পণ্য ও সেবার ওপর বিভিন্ন স্তরের ভ্যাট আরোপ এবং ‘ক্ষেত্র বিস্তৃতকরণ’ এবং কর আদায় প্রক্রিয়া সহজীকরণের জন্য ভ্যাট হিসাবায়নের ‘নতুন পদ্ধতি’ প্রেসক্রাইব করা হয়েছে বা হচ্ছে, যা অনলাইন পদ্ধতিতে সহজসাধ্য ও নিয়মনিষ্ঠ হবে।

 

ধরেই নেওয়া হয়েছে, সব প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে অনলাইনে অভ্যস্ত হয়েছেন বা হবেন। মোদ্দা কথা রাজস্ব আয় বাড়াতে সহজ উপায়ে পরোক্ষ করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। পদ্ধতির সংস্কার না করে বাড়তি কর বা ভ্যাট আরোপ হওয়ায় তা আহরণে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি বা অপপ্রয়োগের ফলে সুন্দর বিধিসমূহ অসুন্দর হয়ে যায়। ভ্যাটের ওপর গুরুত্ব বাড়াতে গিয়ে প্রত্যক্ষ করের (আয়কর) প্রতি মনোযোগ হ্রাস পায়।

 

অথচ প্রত্যক্ষ করই কর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায়। বিগত কয়েক বছরে আয়কর ক্রমেই অন্যতম উৎস হিসেবে উঠে আসতে থাকলেও ভ্যাট লক্ষ্যমাত্রার থেকে আয়করের লক্ষ্যমাত্রা কম নির্ধারণ করা হয়। আয়কর সংস্কার ও আহরণে কার্যকর জোর পদক্ষেপ গ্রহণে গুরুত্ব আরোপের দৃষ্টিভঙ্গি নড়বড়ে বা বিলম্ব হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।

 

রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং সম্পদের বণ্টন-বৈষম্য দূরীকরণে প্রত্যক্ষ করের গুরুত্ব লঘু করে পরোক্ষ কর ভ্যাটের ওপর ভরসা করে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে না পারায় পরোক্ষ করের ওপর চাপ বাড়ছে। রাজস্ব আহরণের পদক্ষেপসমূহকে বাস্তব ও যুক্তিসম্মত করার বিকল্প নেই। আইএমএফ এসে বললে তাই করা হবে এটা লজ্জাকর ও অবাঞ্ছিত বৈকি।

 

বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত খাত, বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত দৃশ্যত শাখের করাতের পর্যায়ে রয়েছে। তাদের ভর্তুকি কমানোর কথা আইএমএফ বলছে এমন এক সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিতে বাধ্য হওয়া যা সরাসরি জনগণের ওপর, দ্রব্যমূল্য, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিজনিত কারণে দারুণ দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ পরিস্থিতি কেন এমন হলো জাতীয় সংসদে জনগণের প্রতিনিধিদের বিচার-বিশ্লেষণে যাওয়া এবং সমন্বয়ধর্মী পদক্ষেপে না গেলে বাজেটকে উন্নয়ন অভিমুখী ও জনতুষ্টি করা যাবে না।

 

বাজেটে শিক্ষায় যে বরাদ্দ দেয়া হয় তার বড় অংশই যাবে বেতন-ভাতা ও ভবন নির্মাণে। সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে বা হবে জিডিপির ন্যূনতম শতাংশ। অথচ রেলওয়ে ও ভৌত নির্মাণ জনপ্রশাসন প্রভৃতি খাতে স্বাস্থ্য খাতের চেয়ে অনেক বেশি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে বা হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মৌলিক অধিকার। মানসম্মত শিক্ষার পরিবর্তে পাসনির্ভর পরীক্ষায়, ন্যায়নীতিনির্ভর শিক্ষা ও চিন্তা-চেতনা বিকাশের পরিবর্তে দেশে অদক্ষ শিক্ষিতের হার বাড়লে, স্বাস্থ্যের কারণে কেউ দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠে যাবে, আবার অসুখ হলে তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে আসবেন এটা দুঃখজনক।

 

বড় বড় মেগা প্রকল্পের দ্বারা অর্থনীতিতে আয় বৈষম্য বাগিয়ে যে উন্নয়ন অবকাঠামো গড়ে উঠছে তা ব্যবহার করবে কে কীভাবে?

 

এসব ক্ষেত্রে উপযুক্ত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের তো কোনো বিকল্প নেই। বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ব্যাংক কমিশন গঠন না করে, ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম-দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে বরং রিফাইন্যানসিংয়ের মাধ্যমে সরকারি এমনকি বেসরকারি ব্যাংকের অনিয়ম-অদক্ষতার ঘাটতি পূরণ করা হচ্ছে, ফলে ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম উৎসাহিত হচ্ছে কিনা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। নন-এনবিআর এবং নন-ট্যাক্স রেভিনিউ খাতে (যা সরকারি সংস্থা প্রদেয়) অর্জন লক্ষ্যমাত্রা ক্রমেই কমানো হচ্ছে আর এ কারণে এনবিআর রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করতে হচ্ছে।

 

নানান বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হচ্ছে, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির আত্মতুষ্টি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলছে। প্রবৃদ্ধির আত্মতুষ্টির বড় কুফল হচ্ছে, বাজেটে এক ধরনের বাহাদুরির আকার দেখানো অথচ সব খাতকে অন্তর্ভুক্তিকরণে যেখানে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার, সেটি করা হচ্ছে না।

 

বিনিয়োগ, বাস্তবায়ন অদক্ষতা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিশ্বাস যোগ্য ও দক্ষ কোনো নীতি-কৌশলের অবর্তমানে সর্বভুক এক ধরনের বিশেষ চক্র তৈরি হচ্ছে, বড় বাজেট, বড় প্রকল্পমুখী হচ্ছে দেশ ও অর্থনীতি। যে অর্থের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে জনগণের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। অর্থনীতির আন্তঃসহায়ক শক্তিকে (রেজিলিয়েন্ট পাওয়ার) অন্তর্ভুক্তির পরিবর্তে বিচ্যুতির পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।

 

অনেক দিন ধরেই মেগা প্রকল্পের নামে মেগা খরচের পথে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতি। প্রকল্প খরচ অযৌক্তিকভাবে বাড়ছে। এসবের ব্যয় সাশ্রয়ে যথা নজরদারির পরিবর্তে অবকাঠামো নিয়ে প্রচারমুখী প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ অবকাঠামোর সুফল নিশ্চিত করতে যে ধরনের সুশাসন দরকার তা নিশ্চিত করা অনিবার্য হয়ে উঠছে। অন্যান্য প্রকল্পের টাকা কেটে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হলেও স্বচ্ছতার সঙ্গে তা খরচ করার আবশ্যকতা থেকেই যাচ্ছে।

 

বাজেট বাস্তবায়নে অর্থায়ন ও অর্থ ব্যয় সঠিকভাবে করতে না পারায় প্রতিবছরই বাজেট সংশোধন করতে হয়। তাই বাজেট বাস্তবায়নে বছরের শুরু থেকেই সুষ্ঠু তদারক করা জরুরি। বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। সম্পূরক বাজেট পাসের সময় সংসদে জোর আলোচনা হওয়া উচিত। কর আদায়, উন্নয়ন বাজেট ও বিদেশি অর্থায়ন তিনটি ক্ষেত্রে উচ্চাভিলাষকে বাস্তবতার অবয়বে আনতে হবে।

 

উচ্চাভিলাষ না থাকলে বড় লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হয় না এটাও যেমন ঠিক, আবার পরপর এমন বড় বাজেট বাস্তবায়িত না হওয়ায় বাজেটের বিশ্বাসযোগ্যতা ও উপযোগিতা হারিয়ে যায় সেটাও বিবেচ্য। শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে বাজেট বাস্তবায়ন করা যায় না। বাজেট সফলভাবে বাস্তবায়ন করার একটা রাজনৈতিক অর্থনীতি আছে। তা হলো জনপ্রতিনিধিদের যুক্ত করা।

 

প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ স্থবিরতা, বাজেট বাস্তবায়ন অপারগতা বা অদক্ষতা ও কর্মসংস্থানের খরা; দুর্নীতি ও ব্যবসার বৈরী পরিবেশের কারণে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। সবশেষে সরকারি হিসাবেই দেখা যাচ্ছে কর্মসংস্থানের হার কমছে। কর্মসংস্থান না হলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট ডেমোগ্রাফিক ডিজিস্টারে পরিণত হতে পারে।

 

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতি কর্কট রোগের মতো ক্রমবর্ধমান ভয়াবহতার দিকে। খেলাপি ঋণ, সংস্থান ও মূলধন ঘাটতি, মুনাফা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতার কারণে ঋণ ব্যবস্থাপনায় আপস এবং সর্বোপরি সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন অন্তরায় ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে একটা নাজুক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

 

দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এই খাতটিকে শক্ত ভিত্তির ওপর তুলে আনতে না পারলে দেশের যাবতীয় অর্থনৈতিক অর্জন হুমকির মুখে পড়বে, এটি বিবেচনায় রেখেই সব পক্ষকে উপলব্ধি করতে হবে যে, একটি দুর্বল ব্যাংকিং খাত নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী টেকসই উন্নয়নের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।

 

সরকারি-বেসরকারি দুই ধরনের ব্যাংক থেকেই পুকুর নয়, সাগর চুরির ঘটনা ঘটছে। রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। নানান যৌক্তিক কারণে যাবে। ক্রমেই রপ্তানি আয় কমছে। প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি পণ্যের (বিশেষ করে গার্মেন্টস) বহির্বাজারকরণের ওপর নানান বাধা আসছে। বিষয়গুলো যথা বিবেচনায় নিয়ে রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণের ওপর জোর দিতে হবে, নতুন বাজার খুঁজতে হবে। রপ্তানি খাতকে কার্যকর পরিপোষণ ও শুল্ক কর প্রণোদনা সমন্বয়ের বিকল্প নেই।

 

লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

 

ভোরের আকাশ/নি