এম বদি-উজ-জামান : টঙ্গীর জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ সাবেক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারকে উনিশ বছর আগে ২০০৪ সালের ৭ মে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করা হলেও এই মামলার চূড়ান্ত বিচার আজো সম্পন্ন হয়নি। ওই ঘটনায় করা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ, বাদীপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল সাত বছর ধরে বিচারাধীন দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগে। এ মামলার বিচার সম্পন্ন করতে নিহতের পরিবার, রাষ্ট্রপক্ষ কিংবা আসামিপক্ষ থেকে তেমন কোনো সাড়া নেই।
আপিল বিভাগে এ মামলায় বাদীপক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মমতাজউদ্দিন ফকির ভোরের আকাশকে বলেন, মামলার নথি প্রস্তুত হতে কিছুটা সময় গেছে। এরপর আসামিপক্ষ কয়েক দফা সময় নিয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণেও মামলাটির বিচার বিলম্বিত হয়েছে। এছাড়া আপিল বিভাগে আরো গুরুত্বপূর্ণ মামলা বিচারাধীন। এসব কারণে এই মামলার বিচার বিলম্বিত হয়েছে। তিনি বলেন, মামলাটি আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ছিল বেশ কয়েকবার। কিন্তু শুনানি করা যায়নি। রাষ্ট্রপক্ষ এবং আাসমিপক্ষকে শুনানির উদ্যোগ নিতে হবে। তারা যদি উদ্যোগ না নেয় তবে বিচারে কিছুটা সময় লাগবেই। তিনি বলেন, মামলাটি যাতে তাড়াতাড়ি শুনানি করা যায়, সেজন্য চেষ্টা করা হবে।
জানা যায়, এই মামলাটি শুনানির জন্য ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ছিল। এদিন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ শুনানি ৮ সপ্তাহ পিছিয়ে দেন। এরপর ৪ মার্চ মামলাটি আবারো কার্যতালিকায় আসে। কিন্তু এদিন নথি না আসায় শুনানি হয়নি। সেই থেকে বারবার শুনানি পিছিয়েছে। এরপর অতিমারি করোনোর কারণে সবকিছুর সঙ্গে থমকে পড়ে স্বাভাবিক বিচার কাজও। আইনজীবীরা বলছেন, করোনার প্রভাব পড়ে এই মামলাটির ওপরও। প্রায় দুবছর স্বাভাবিক বিচার কাজ পরিচালিত না হওয়ায় এ মামলাটিতেও শুনানি হয়নি।
বহুল আলোচিত এই হত্যা মামলায় বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকার এবং জাতীয় পার্টি নেতা নুরুল ইসলাম দিপুসহ ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০১৬ সালের ১৫ জুন হাইকোর্ট রায় দেন। এরপর একই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর খালাস আদেশের বিরুদ্ধে বাদীপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষ এবং খালাস চেয়ে আসামিপক্ষ পৃথকভাবে আপিল বিভাগে আপিল করে। এ আপিল এখন বিচারাধীন।
নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ২২ জনের মধ্যে ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে সাতজনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরো এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। বিচার চলাকালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুজন কারাগারে মারা যাওয়ায় তাদের বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাকি ৭ জনকে খালাস দেয়া হয়। এছাড়া যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ছয়জনের মধ্যে একজনের সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট। চারজনকে খালাস দেয়া হয়। আর একজন আসামি আপিল না করায় তার বিষয়ে হাইকোর্ট কোনো আদেশ দেননি। সবমিলে নিম্ন আদালতে সাজাপ্রাপ্ত ১১ জনকে খালাস দেন হাইকোর্ট। ২০০৫ সালের এপ্রিলে এ মামলায় নিম্ন আদালত থেকে ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনকরণ) পাঠানো হয় হাইকোর্টে। এছাড়া আসামিপক্ষে আপিল করা হয়। উভয় আবেদন একসঙ্গে হাইকোর্টে শুনানি শেষে রায় দেয়া হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- নুরুল ইসলাম সরকার, নুরুল ইসলাম দিপু, মাহবুবুর রহমান মাহবুব, শহিদুল ইসলাম শিপু, কানা হাফিজ এবং সোহাগ ওরফে সরু। এদের মধ্যে নুরুল ইসলাম দিপু শুরু থেকেই পলাতক। বাকিরা কারাবন্দি।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- মোহাম্মদ আলী, সৈয়দ আহমেদ মজনু, আনোয়ার হোসেন আনু, রতন মিয়া ওরফে বড় মিয়া, আবু সালাম, ছোট জাহাঙ্গীর (পিতা আবুল কাশেম) ও মশিউর রহমান মিশু। এছাড়া যাবজ্জীবন সাজা বহাল রাখা হয় নুরুল আমিনের। এ আটজনের মধ্যে সৈয়দ আহমেদ মজনু, আনোয়ার হোসেন আনু, ছোট জাহাঙ্গীর (পিতা আবুল কাশেম) ও মশিউর রহমান মিশু হাইকোর্টের রায় ঘোষণার সময় পলাতক ছিলেন।
খালাসপ্রাপ্তরা : নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আমির, বড় জাহাঙ্গীর (পিতা নূর হোসেন), ফয়সল, লোকমান হোসেন বুলু, রণি ফকির, খোকন এবং দুলাল মিয়াকে খালাস দেয়া হয়। এছাড়া যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে রাকিব উদ্দিন সরকার ওরফে পাপ্পু সরকার, আয়ুব আলী, জাহাঙ্গীর (পিতা মেহের আলী) ও মনিরকে খালাস দেয়া হয়।
নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অহিদুল ইসলাম টিপু পলাতক থাকায় তিনি আপিল করেননি। এ কারণে আদালত তার বিষয়ে কোনো আদেশ দেননি। আইনজীবীরা বলছেন, সে আপিল না করায় তার সাজা বহাল রয়েছে।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার আমলে ২০০৪ সালের ৭ মে টঙ্গীর নোয়াগাঁও হাইস্কুল মাঠে এক অনুষ্ঠানে আহসান উল্লাহ মাস্টার এমপিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে ২০০৪ সালে এসএসসি পাস করা ছাত্র ওমর ফারুক রতনও নিহত হয়। এছাড়া যুবলীগ নেতা মাহফুজুর রহমান মহল গুরুতর আহত হন। এ হত্যাকাণ্ডে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এরপর নিহত আহসান উল্লা মাস্টার এমপির ভাই মতিয়ুর রহমান বাদী হয়ে টঙ্গী থানায় মামলা করেন। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মাত্র এক বছরের মধ্যে বিচারিক আদালতে বিচার সম্পন্ন হয়। ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এ মামলায় রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারসহ ২২ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় দুজনকে খালাস দেওয়া হয়। আদালতের রায়ে স্কুলছাত্র রতনকে হত্যা করার দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত সব আসামিকেই আরো এক দফা অভিন্ন শাস্তি দেয়া হয়।
রাষ্ট্রপতির বাণী : বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের ১৯তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এক বাণীতে বলেছেন, গণতন্ত্রের বিকাশে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের মতো ত্যাগী, সংগ্রামী ও জনদরদি নেতৃত্ব নতুন প্রজন্মকে আলোর পথ দেখাবে। রাষ্ট্রপতি বলেন, শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল একজন জননন্দিত শ্রমিক নেতা। কৃষক-শ্রমিক তথা আপামর মেহনতি মানুষেরও তিনি ছিলেন অতি আপনজন। গণতন্ত্রকামী এই ত্যাগী নেতা শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সবসময় যেমন সোচ্চার ছিলেন, তেমনি মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়েও তিনি কখনো পিছপা হননি। এজন্য তাকে বহুবার নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। মেহনতি মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়সহ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
রাষ্ট্রপতি আরো বলেন, শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন ত্যাগী ও নিবেদিত নেতা। জাতীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের আগলে রেখেছেন, দিয়েছেন সাহস ও মনোবল। মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়সহ গণতন্ত্রের বিকাশে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের মতো ত্যাগী, সংগ্রামী ও জনদরদি নেতৃত্ব নতুন প্রজন্মকে আলোর পথ দেখাবে। রাষ্ট্রপতি শহীদ আহ্সান উল্লাহ মাস্টারের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।
প্রধানমন্ত্রীর বাণী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বাণীতে বলেছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শ্রমিক নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম এখনও চলছে। আশা করি বিচারকার্য চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়ে বিচারের রায় দ্রুত কার্যকর হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, শ্রমজীবী খেটে খাওয়া মানুষের সংগ্রামী জননেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের স্বপ্ন ছিল মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত টঙ্গী-গাজীপুর গড়ার। কালে কালে তিনি হয়ে ওঠেন জঙ্গি-সন্ত্রাসের মদদদাতা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পথের কাঁটা। হাওয়া ভবনের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতাদের নিশ্চিহ্ন করার নীল-নকশা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বিএনপি-জামায়াত মদদপুষ্ট একদল সন্ত্রাসী আহসান উল্লাহ মাস্টারকে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একজন প্রিয় শিক্ষককে সন্ত্রাসীদের গুলি থেকে বাঁচাতে সেদিন বুক পেতে দিয়েছিল ছাত্র ওমর ফারুক রতন, সেও মৃত্যুবরণ করে। শুধু তাই নয়, আহসান উল্লাহ মাস্টার নিহত হওয়ার পর শোকার্ত, বিক্ষুব্ধ, প্রতিবাদী জনতার ওপর গুলি চালিয়ে আরো দুইজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে জোট সরকারের পুলিশ, গ্রেপ্তার করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের হাজারো নেতাকর্মীকে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বাহিনী এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান সাক্ষীকেও বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে। তিনি শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন।
ভোরের আকাশ/আসা