logo
আপডেট : ৮ মে, ২০২৩ ১০:৪৪
৫ সিটি নির্বাচন
বিএনপিতে ঘরে ঘরেই কি উকিল সাত্তার
এম সাইফুল ইসলাম

বিএনপিতে ঘরে ঘরেই কি উকিল সাত্তার

এম সাইফুল ইসলাম: আসন্ন পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ না নিতে দলের কঠোর অবস্থানের মধ্যেই ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হতে তৎপর বিএনপির স্থানীয় নেতারা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেতারা সরাসরি প্রার্থী না হয়ে দলীয় মোড়ক থেকে সরে এসে পরিবারের কাউকে করছে প্রার্থী।

 

ফলে অনেকেই এখন প্রশ্ন তুলছেন, বিএনপিতে কী এখন ঘরে ঘরে ‘উকিল আব্দুস সাত্তার’। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘স্বতন্ত্র’ বা যে নামেই হোক দলের সমর্থিতরা প্রার্থী হলে বেশ বেকায়দায় পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে বিএনপিতে।

 

তবে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা বলছেন বর্তমান সরকার ও ইসির অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তে তারা অনড়। তাই দলের কেউ এই ভোটে অংশ নিলে তাকে ছাড় দেয়া হবে না। সরকারের ফাঁদে তারা পা দেবেন না। এছাড়া কোনো নেতার পরিবারের কোনো আত্মীয় দলের সদস্য না হয়ে থাকলে তাকে দলীয় তকমা লাগিয়ে দেয়াও সমীচীন নয় বলেও মনে করছেন নেতারা।

 

জানা গেছে, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি এখন রাজপথে আন্দোলন করছে। দলটি বর্তমান ইসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতির সংলাপ, ইসি নিয়োগে গঠিত সার্চ কমিটিতে নাম না দেয়াসহ কোনো কর্মকান্ডে অংশ নেয়নি। চলমান ইসি দায়িত্ব নেয়ার পর বিএনপি আলোচনার জন্য চিঠি দিলে দলটি তাতে সাড়া দেয়নি। এই ইসির অধীনে স্থানীয় বা কোনো সংসদ উপনির্বাচনেও অংশ নেয়নি বিএনপি।

 

বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তও বেশ আগেই নিয়েছে বিএনপি। সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে বিএনপি যখন রাজপথের কর্মসূচিতে ঠিক সে সময় অনুষ্ঠিত হচ্ছে পাঁচ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনের আট মাস আগে পাঁচ সিটি নির্বাচনে বিশেষ দলের কেউ যেন ভোটে অংশ না নেয় সেটিই এখন বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

 

কিছুদিন আগে সংসদ উপনির্বাচনে ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় দলীয় সাবেক সংসদ সংসদ ‘উকিল আব্দুস সাত্তারে’র মতো কেউ জার্সি পরিবর্তন করবেন না তার নিশ্চয়তা নিয়েও দলটির শুরু থেকেই চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর খোদ দলের পদধারী নেতাদের নির্বাচন করার তৎপরতায় বিএনপির ওই চ্যালেঞ্জ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে।

 

গত ২৫ এপ্রিল মঙ্গলবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে নেতারা সবাই সিটি নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত দেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন।

 

বৈঠক সূত্র জানিয়েছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এই সিটি নির্বাচনকে দলটির নেতারা ফাঁদ হিসেবে অভিহিত করেন। দলীয় কোনো কোনো নেতাকে ‘উকিল সাত্তারে’র মতো মডেল বানোনোর জন্য সরকারি তৎপরতায় বিষয়টিও সামনে আনেন নেতারা।

 

নির্বাচনে দলীয় মোড়ক থেকে বের হয়ে এসে স্বতন্ত্র ভোট করার ব্যাপারে বিএনপির কয়েকজন নেতার আগ্রহের বিষয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে জানানো হয়। সবশেষ দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে অংশ নিলে তাদের আজীবন বহিষ্কারসহ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয় ওই বৈঠকে।

 

বিএনপি মনে করছে সরকার পাঁচ সিটির মধ্যে অন্তত যদি দুই বা তিন সিটিতেও বিএনপির পরিচিত কাউকে বাগিয়ে প্রার্থী করতে পারে, সেটি দলটির জন্য বেশ অস্বস্তি হয়ে দাঁড়াবে।

 

অর্থাৎ সরকার এটিই প্রমাণের চেষ্টা করবে যে, দলীয়ভাবে বিএনপি অংশ না নিলেও আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলটির অনেক নেতা অংশগ্রহণ করবে।

 

গত ৩ এপ্রিল ইসি ৫ সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরপরই বিএনপি নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী লন্ডনে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করতে লন্ডনে যান। সেখান থেকে দেশে ফিরে আরিফুল নির্বাচনে অংশ নেয়ার ‘আভাস’ দিয়েছিলেন। নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে তার ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য ছিল।

 

তিনি আগামী ২০ মে জনসভার মাধ্যমে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করবেন বলেও স্পষ্ট জানিয়েছেন। নির্বাচনে অংশ না নিতে দলের কঠোর বার্তার পরেও তার অংশ নেয়ার আগ্রহ এখন দলটিকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে বলে জানা গেছে।

 

বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে তিনি হাইকমান্ডকে অনেকটাই ‘আলটিমেটাম’ দিয়েছেন। কাক্সিক্ষত পদ না পেলে তিনি শেষ পর্যন্ত দল থেকে পদত্যাগ করে ‘স্বতন্ত্র’ ভোট করবেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে।

 

বিগত খুলনা সিটি নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী ও দলের মহানগরের সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জুও প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।

 

দলে পদে না থাকলেও তিনি বলছেন, আওয়ামী লীগকে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেয়া যায় না। তার বক্তব্যে স্পষ্ট যে, তিনি ভোট করতে চান। যদিও তিনি ব্যাপক হাঁকডাক দিয়ে মাঠে এখনো নামেননি।

 

রাজশাহী সিটি নির্বাচনেও দলের নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফার ভাই সাঈদ হাসান প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। নাদিম মোস্তফা বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ছাড়াও জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য। আর সাঈদ হাসান আশির দশকে ছাত্র রাজনীতি করতেন। সে সময় তিনি রাজশাহী কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জিতে ভিপিও হয়েছিলেন।

 

পরে রাজশাহী মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি হন। তবে বিএনপিতে সাঈদের এখন আর কোনো পদ নেই। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে সাঈদ হাসান কয়েকদিনের মধ্যে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানোর ঘোষণা দিয়েছেন।

 

এছাড়া রাজশাহীতে মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ ও নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সভাপতি জাকির হোসেন রিমনের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছেন।

 

গাজীপুরে দলীয় নেতা নূরুল ইসলাম সরকারের ছেলে সরকার শাহ নূর ইসলাম মেয়র প্রার্থী হয়েছেন। এই সিটিতে বিএনপির ২৪ জন নেতাকর্মী কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন বলে জানা গেছে। বরিশালে বিএনপি দলীয় সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালের ছেলে কামরুল আহসান রূপন মেয়র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে তৎপরতা শুরুর খবর পাওয়া গেছে।

 

দলের কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করার পরও নেতাদের বা তাদের পরিবারের সদস্যদের ভোট করায় ঘোষণা দেয়ায় ক্ষুব্ধ সাধারণ নেতাকর্মীরা। তাদের অনেকের মাঝে এখন প্রশ্ন দলে কী এখন ঘরে ঘরে ‘উকিল সাত্তার’ রয়েছে?

 

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কামিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন বর্তমান সরকার ও ইসির অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। যদি কেউ অংশ নেয় তার বিরুদ্ধে দল কঠোর ব্যবস্থা নেবে। বিএনপি এখন দলনিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে আন্দোলনের বিকল্প কিছু ভাবছে না। এছাড়া কোনো নেতার আত্মীয়স্বজন যদি বিএনপি না করে থাকেন তবে তাকে কেন বিএনপির তকমা দিতে হবে।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, দলের সিদ্ধান্ত হচ্ছে বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়া। আমরা মনে করছি না কেউ দলীয় সিদ্ধান্ত না মেনে ভোটে যাবে। যদি কেউ দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে যায় তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেবে দল।

 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, উকিল সাত্তার মডেল নির্বাচন করতে সরকার তৎপরতা চালাবে এটি অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। সে বিষয়ে দল সতর্ক আছে।

 

ইসির ঘোষিত তফসিলে আগামী ২৫ মে গাজীপুর, ১২ জুন খুলনা ও বরিশাল এবং ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেটে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তফসিল ঘোষণার পর থেকে দলীয় চাওয়া থেকে সরে এসে বিএনপির অনেক নেতা নির্বাচনে অংশ নিতে নানামুখী তৎপরতা শুরু করে।

 

ভোরের আকাশ/নি