logo
আপডেট : ১০ মে, ২০২৩ ১০:০০
ঋণের ফাদ: জিমেইল হ্যাক করে ব্ল্যাকমেইল
রুদ্র মিজান ও ইমরান খান

ঋণের ফাদ: জিমেইল হ্যাক করে ব্ল্যাকমেইল

রুদ্র মিজান ও ইমরান খান: হঠাৎ মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে সুন্দর আলীর। বিবস্ত্র, অর্ধনগ্ন কিছু ছবি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে অনলাইনে। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা পৌঁছে গেছে পরিচিতদের কাছে। নিজের স্ত্রীর ছবি এবং নিজের ছবি। বুঝতে বেগ পেতে হয় না প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়েছেন তিনি। শুরুটা ইন্টারনেটে ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।

 

গুগল। ইন্টারনেটভিত্তিক সেবা ও পণ্যে বিশেষায়িত একটি বহুজাতিক প্রযুক্তি কোম্পানি। নিরাপদ যোগাযোগের জন্য গুগলের জিমেইল ব্যবহার করেন না এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম। গুগল বা জিমেইল অ্যাকাউন্ট না থাকলে হাতে থাকা স্মার্টফোনও প্রায় অচল। কারণ বিভিন্ন অ্যাপস ডাউনলোড করতে জিমেইল অ্যাকাউন্টের প্রয়োজন হয়।

 

স্মার্টফোনে থাকা ছবি, ভিডিও এবং কন্ট্যাক্ট লিস্ট নিজের অজান্তেই সংরক্ষণ হয়ে যায় গুগল অ্যাকাউন্টে। অনলাইনে সহজে ঋণ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে গুগল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র।

 

অভিযোগ রয়েছে, রাজধানীর গুলশান, বনানী, ও বাড্ডাসহ বিভিন্ন এলাকায় পরিচালিত কিছু কথিত কল সেন্টার বন্ধ হওয়ার পর এখন ব্যক্তিগতভাবে এসব প্রতারণামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ভুয়া কল সেন্টার। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক কিছু বাংলাদেশি ও চীনা নাগরিক। এ চক্র মূলত অনলাইনে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সহজে ঋণ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের নাগরিকদের ফাঁদে ফেলত। শর্ত ছিল ঋণ পেতে হলে অনলাইনে ফরম পূরণ করতে হবে আগ্রহীদের। ওই ফরমের মাধ্যমে বিশেষ কৌশলে জেনে নিত মেইল সংক্রান্ত তথ্য।

 

ফরম পূরণ করলেই হ্যাক করা হতো জিমেইল অ্যাকাউন্ট। ব্যক্তিগত সব তথ্য চলে যেত প্রতারকদের হাতে। এরপর ব্ল্যাকমেইল করে বিভিন্ন উপায়ে তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিত লাখ লাখ টাকা।

 

সম্প্রতি র‌্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এসব ভুয়া কল সেন্টারের আড়ালে থাকা প্রতারণার মূল হোতাদের। বন্ধ হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান।

 

তথ্য বলছে, এসব কল সেন্টার বন্ধ হওয়ার পর থেকে আরো ভয়ংকর হয়ে উঠেছে এই চক্র। অনেকেই নিজ বাসা থেকে চালাচ্ছে প্রাইভেট কল সেন্টার। রাজধানীর মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে এসব ভুয়া কল সেন্টারের অবস্থান।

 

ভারতীয় ও পাকিস্তানিদের পর তাদের টার্গেট বাংলাদেশের সহজ-সরল মানুষ। ঋণ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে দেশের নাগরিকদের ফরম পূরণ করতে বলা হচ্ছে। এরপর তাদের গুগল অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে ব্ল্যাকমেইল করে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বর্তমানে ফার্স্ট ওয়ালেট লোন, ফার্স্ট লোন অ্যাপ্লিকেশন ও ফার্স্ট লোনসহ বিভিন্ন নামে গুগলের প্লে স্টোরে থাকা আ্যপের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে কথিত ঋণের ফাঁদে ফেলছে সাইবার অপরাধীরা।

 

ঈদুল ফিতরের প্রায় এক সপ্তাহ আগে ফেসবুকে সহজে ঋণ পাওয়া যাবে এমন বিজ্ঞাপন দেখে পাঁচ হাজার টাকার ঋণ নেয়ার জন্য ‘ফার্স্ট লোন আ্যপ্লিকেশন’ নামের একটি অ্যাপে আবেদন করেন মিরপুর বাউনিয়া বাঁধের বাসিন্দা শুভ। পরে সেখান থেকে এক হাজার টাকা ঋণ দেয়া যাবে বলে জানানো হয়। ওই অ্যাপে ফরম পূরণের সময় তিনিও জিমেইল আইডি ব্যবহার করেছিলেন।

 

এক সপ্তাহ পর তাকে ফোন করে জানানো হয়, তার ঋণ পরিশোধের সময় হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে ২ হাজার ৫০০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। এটা শুনে তিনি হতভম্ব হয়ে যান। ক্ষুব্ধ হয়ে ফোনের সংযোগ কেটে দেন।

 

পরবর্তীতে তাকে হোয়াটসঅ্যাপে অজ্ঞাত এক নম্বর থেকে ভয়েস মেসেজ পাঠানো হয়।

 

বলা হয়, টাকা না দিলে তার ব্যক্তিগত ছবিগুলো ভাইরাল করে দেয়া হবে। তবে বিষয়টি নিয়ে শুভ মোটেও গুরুত্ব দেননি। এমনই এক চক্রের ফাঁদে পা দিয়ে এখন দিশেহারা পল্লবীর ১১ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা সুন্দর আলী। দেড় মাস আগে হঠাৎ এক ফোনকলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তার ।

 

ইমেইল আইডি হ্যাক হওয়ায় তার ব্যক্তিগত অনেক ছবি ও কন্ট্যাক্ট লিস্ট চলে গেছে প্রতারকদের হাতে। সুন্দর ও তার স্ত্রীর কিছু একান্ত ব্যক্তিগত ছবিও ছিল গুগল অ্যাকাউন্টে। ফোনকলে কোনো এক ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। তবে এ ঋণ সম্পর্কে কিছুই জানেন না সুন্দর আলী। বিষয়টি কীভাবে হয়েছে সে চিন্তার চেয়ে বড় দুশ্চিন্তা পরিবারের কোনো ছবি সুপার এডিট করে ছড়িয়ে দেয়া হয় কিনা। সুন্দর আলী যখন এমন দুশ্চিন্তা করছিলেন, তার কিছুদিন যেতেই পরিবারের সদস্যদের বিকৃত ছবি পাঠাতে শুরু করে প্রতারকরা। হুমকি দেয় অন্তর্জালে সব ভাইরাল করে দেয়ার। সুন্দর আলী তখন দিশেহারা।

 

এর কিছুদিন পরই প্রতারকরা নিজের খোলস বদলায়। জানায়, এক লাখ টাকা দিলে এ যাত্রায় বেঁচে যাবেন সুন্দর আলী। এমন আশ্বাস দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে ভয়েস চ্যাট এবং একাধিকার কলও দেয় প্রতারকরা। টাকা না দেয়ায় সুন্দর আলী ও তার স্ত্রীর ছবিগুলো বিকৃত করে পাঠানো শুরু করে প্রতারকরা।

 

ভুক্তভোগী সুন্দর আলীকে পাঠানো প্রতারকদের বিকাশ ও নগদ নম্বর নিয়ে অনুসন্ধান করে ভোরের আকাশ। বিকাশের ওই নম্বরটি মোহাম্মদপুরের রিংরোডের মনির টেলিকম নামে নিবন্ধিত। দোকানটিতে যিনি ব্যবসা পরিচালনা করেন হোয়াটসঅ্যাপে তার দেয়া ছবি দেখেও বিভ্রান্ত হতে হয়।

 

কারণ হোয়াটসঅ্যাপের প্রোফাইলে পুলিশ কর্মকর্তার পোশাক পরা ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। দোকানটি রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায়। কিছুদিন সরজমিনে হোয়াটসঅ্যাপে ব্যবহৃত ছবির ওই ব্যক্তির সন্ধানে দোকানটিতে নজর রাখা হয়। পরে জানা গেছে, তাজমহল রোডেও একই ব্যক্তির আরো একটি দোকান রয়েছে।

 

কাক্সিক্ষত ব্যক্তিকে না পেয়ে সরাসরি তাজমহল রোডের দোকানে থাকা মামুন নামের ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়।

 

তিনি প্রথমে অস্বীকার করে বলেন, এটি তার নম্বর নয়। পরবর্তীতে স্বীকার করলেও তিনি দোষ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন সোহাগ নামের নগদের এক এসআরের কাঁধে। সোহাগকে বারবার ফোন করে সেখানে আসার অনুরোধ করেন মামুন। তবে কোনোভাবেই তিনি ঘটনাস্থলে আসেননি।

 

তিনি জানান, তার দোকানে ব্যবহৃত বিকাশ ও নগদের নম্বর ভিন্ন। নগদ ও বিকাশের এজেন্ট মামুন জানান, কে বা কারা তার ট্রেড লাইসেন্স ব্যবহার করে বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্ট করেছে। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপে ব্যবহৃত ছবির ব্যক্তিকে চেনেন না তিনি। এ বিষয়ে তিনিও আইনের আশ্রয় নেবেন বলে জানান।

 

ভুক্তভোগী সুন্দর আলী বলেন, আমাকে একেক সময় একেক নম্বর থেকে প্রতারকরা কল করেছে। আমি বিষয়টি নিয়ে ততটা সিরিয়াস ছিলাম না। কারণ তখন ঈদকে কেন্দ্র করে ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। তবে সে যখন আমার ও আমার স্ত্রীর ছবি বিকৃত করে আমাকে পাঠায়, তখন আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। এরপর সে আমার পরিচিতদের সেই ছবিগুলো পাঠানো শুরু করে। শেষ পর্যন্ত এলাকার মুরব্বিদের পরামর্শে থানায় জিডি করি। এটি তদন্ত করছে ডিবির সাইবার ক্রাইম ইউনিট। কিন্তু এখন পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বলে জানান তিনি।

 

তিনি বলেন, আমার পরিবারের লোকজন আমাকে অবিশ্বাস করছে। তারা ভাবছে আমি সত্যি সত্যি কোথাও থেকে ঋণ নিয়েছি। ছবিগুলো এলাকার পরিচতি ও পাড়া-প্রতিবেশীদের অনেককেই পাঠানো হয়েছে। এতে সামাজিকভাবে আমাদের স্বামী-স্ত্রীকে হেয় প্রতিপন্ন হতে হচ্ছে। বাসার বাইরে বের হলে লজ্জা পাচ্ছি। আমার স্ত্রী তো বাসার বাইরে বের হওয়াই ছেড়ে দিয়েছে।

 

বিষয়টি তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। দ্রুত সময়ের মধ্যেই প্রতারকদের চিহ্নিত করা হবে বলে বলে দাবি তাদের।

 

এ বিষয়ে সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ডিভিশন বিভাগের পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম বলেন, সাইবার ক্রাইম নিয়ে কাজ করার জন্য তিনটি আইন রয়েছে। আমাদের ডিপার্টমেন্ট এই তিন আইনের ওপর ভিত্তি করেই কাজ করে। তবে পুলিশ সেজে প্রতারণা করাটা ভয়ংকর বিষয়। বিষয়টি আমাদের টিম খতিয়ে দেখছে। দ্রুত সময়ের মধ্যেই এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

 

ভোরের আকাশ/নি