logo
আপডেট : ১১ মে, ২০২৩ ১১:৩৭
শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি
মজিবর রহমান

শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি

মহান মে দিবস পালিত হয়েছে বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশে উদযাপনের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলি’। উনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্ত শ্রমিকদের প্রকৃতপক্ষে অধিকার বলতে কিছু ছিল না। না-ছিল মজুরির নিশ্চয়তা, না কর্মঘণ্টার সীমা। ১২-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো একেকজনকে। অমানবিক এমন পরিস্থিতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো শুরু হয় ১৮৭৭ সাল থেকে।

 

ন্যায্য মজুরি, কর্মদিবস ৮ ঘণ্টা নির্ধারণ ও অন্যান্য দাবিতে শ্রমিকশ্রেণি ব্যাপক ধর্মঘট শুরু করে, নির্যাতিতও হয়। ১৮৮৬ সালের ১ মে ঘটে বিস্ফোরণ। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেট বিক্ষোভের তরঙ্গে উত্তাল হয়ে ওঠে। লাখ লাখ শ্রমিক কারখানার কাজ বন্ধ রেখে নেমে আসেন পথে। ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়।

 

দমন করতে গিয়ে পুলিশ গুলি চালায়, তাতে ওইদিনই অন্তত ১০ জন বিক্ষোভকারী নিহত হন, আহত হন কয়েক হাজার। বিক্ষোভ গড়ায় ৩ ও ৪ মে তারিখেও। পুলিশের গুলিতে ওই ২ দিনও হতাহতের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে পুলিশের কয়েকজন সদস্যও প্রাণ হারান।

 

প্রতিবাদ-প্রতিরোধের এ কর্মসূচি বৃথা যায় না, দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মঘণ্টার দাবি বাস্তবায়িত হয়। ১৯৮৯ সালে ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনের ঘোষণা অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

 

বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এদিন শ্রমিকরা পথে নামেন, মিছিল করেন; জীবনমান ও কর্মপরিবেশ উন্নয়নের শ্লোগান দেন। তবে আগের সেই জৌলুস আর নেই। বিগত শতকের ষাট-সত্তর-আশির দশকে যতটা উন্মাদনা লক্ষ করা যেত এখন আর তেমনটি দেখা যায় না। শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে বাম রাজনীতির সংশ্লেষ বেশ জোরালো ছিল একসময়।

 

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সেই রাজনীতি দুর্বল হয়েছে, সেই সঙ্গে শক্তি হারিয়েছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। শ্রমিক রাজনীতি এখন দলীয় রাজনীতির লেজুড়ে পরিণত, পৃথক সত্তা বলতে গেলে নেই-ই। নেতৃত্বে এসেছে বিচ্যুতি, ভোগ-বিলাসের মানসিকতা জেঁকে বসেছে। সমষ্টির পরিবর্তে ব্যক্তির স্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলে শ্রমিকদের মাঝে দেখা দিয়েছে নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা।

 

তাদের একতাবদ্ধ হওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। সরকার ও মালিকশ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করছে শ্রমিকশ্রেণির জীবনমান। সরকার ফিরে তাকালে কিংবা মালিকশ্রেণির সুনজর থাকলে সুযোগ-সুবিধা কিছুটা বাড়ে। নয়তো ক্লিষ্টতার পীড়ন সয়ে যেতে হয়।

 

প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক মোটাদাগে এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায় দেশের শ্রমজীবী মানুষকে। সরকারি কলকারখানা বা সরকারি প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করেন তারা নিয়মিত বেতনভাতা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা পান। কর্মঘণ্টা মেনে কাজ করার সুযোগ আছে সেখানে। বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানাদিতে এমন সুযোগ আছে খুব কমই। করপোরেট কালচার গড়ে উঠেছে এমন প্রতিষ্ঠান সংখ্যায় নগণ্য।

 

গড়পড়তায় বেতনভাতা কম, প্রভিডেন্ট ফান্ড-পেনশন-গ্র্যাচুইটির সুবিধা বলতে গেলে নেই-ই। কর্মঘণ্টাও মেনে চলা হয় না। গার্মেন্টস সেক্টরের বিভিন্ন কারখানাসহ অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৮ ঘণ্টা কাজের পর ওভারটাইম করার সুযোগ আছে।

 

নিম্ন মজুরির কারণে শ্রমিকরা এই সুযোগ নিতে বাধ্য হন, দৈনিক ১২ ঘণ্টা কাজ করেন। এতে বাড়তি কিছু অর্থ মিললেও তাদের জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এই বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় আনা উচিত। শ্রমিকের কাজ মানেই তো কায়িক শ্রম। ১২ ঘণ্টা কিংবা তদূর্ধ্ব সময় কায়িক শ্রম কতটা দুরূহ অনুমান করা কঠিন নয়।

 

অবশ্য সরকারি খাতেও সমস্যা আছে। পাটকল, বস্ত্রকল, কাগজকল, ম্যাচ ফ্যাক্টরি, সুগারমিল ইত্যাদির অনেকটিই এখন আর চলছে না। শ্রমিকরা নিয়মিত বেতনভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পান না। বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলেও সমস্যার সুরাহা হচ্ছে না। কিছুদিন যেতে না যেতেই অচলাবস্থা দেখা দেয়। শ্রমিকরা পড়ে যান ফাফরে। সরকারি কলকারখানা না চলার কোনো কারণ ছিল না যদি না এগুলো পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চালানো হতো।

 

এমন অবস্থা চলে আসছে স্বাধীনতার পর জাতীয়করণ কর্মসূচির সূচনা থেকে। বিন্দুমাত্র ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা নেই এমন ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত হচ্ছে পরিচালনভার। প্রশাসক হিসেবে আমলারা নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছেন। ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলো। শ্রমিকরা হচ্ছেন কর্মচ্যুত।

 

আবার ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেয়ার বেলায় এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বেছে নেয়া হচ্ছে, যাদের অভিপ্রায় মিল চালানো নয়, মিলের মেশিনপত্র ও জায়গাজমি হস্তগত করা।

 

অনেকের অভিমত, এভাবে ছেড়ে না দিয়ে অচলাবস্থায় পড়া মিলগুলোকে আধুনিক করে সঠিক লোকের ওপর পরিচালনভার অর্পণ দ্বারা পেশাদারত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারলে মিলগুলো চলতে পারত, শ্রমিকরাও চাকরিচ্যুত হতো না। সরকারি জুটমিলগুলো অচলাবস্থার শিকার, অথচ ব্যক্তি উদ্যোগে যেসব জুটমিল ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেগুলো ভালো চলছে।

 

শ্রমজীবী মানুষের গরিষ্ঠ অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। তাদের একদিন কাজ থাকে তো অন্যদিন থাকে না। দিন আনি, দিন খাইয়ের মতো অবস্থা এই শ্রেণিটির। কৃষি শ্রমিকদেরও একই অবস্থা। মৌসুমে কাজ থাকে, মৌসুম গেলে বেকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বেকারত্বের প্রান্তিকভিত্তিক জরিপের ফল প্রদান শুরু করেছে।

 

জরিপ অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ প্রান্তিকে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মানদন্ড অনুসরণ করে এ জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। ওই মান্দন্ড অনুযায়ী সপ্তাহে এক দিনও কাজের সুযোগ নেই যাদের তাদের বেকার ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় আইএলওর এই সংজ্ঞা গ্রহণযোগ্য নয়।

 

সপ্তাহে মাত্র এক দিন কাজ করে জীবনধারণ অসম্ভব। নীতিনির্ধারকরা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে গিয়ে সস্তা শ্রমের প্রাপ্যতার কথা বলেন। এটি লজ্জার। শ্রম এত সস্তা থাকা উচিত নয়। এতে ক্ষুধা মেটানো ছাড়া জীবনযাপনের অন্য উপকরণ সংগ্রহ কঠিন।

 

গত তিন বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যধিক বেড়েছে। হেন পণ্য নেই যার মূল্য উচ্চ মাত্রায় বৃদ্ধি পায়নি। মধ্যবিত্তের অবস্থা যেখানে নাজুক সেখানে শ্রমিকের অবস্থা যাচাইয়ের জন্য আলাদা পরিসংখ্যানের প্রয়োজন নেই, বাস্তববুদ্ধি প্রয়োগ করলেই বোঝা যায় তারা কেমন দুর্বিষহ অবস্থা মোকাবিলা করছেন।

 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদনের ভাষ্য, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ন্যূনতম মজুরি সবচেয়ে কম। শুধু তাই নয়, এ অঞ্চলের দেশগুলোর ভেতর বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে ন্যূনতম মজুরি আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার নিচের স্তরের চেয়েও কম। পোশাকশিল্প দেশের সুসংগঠিত খাত।

 

২০১৮ সালে এ খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপর ৫ বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়েছে, কিন্তু মজুরি বাড়েনি।

 

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেম (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) এক গবেষণায় দেখিয়েছে, খাদ্য-বাসস্থান-চিকিৎসাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণে পোশাকশিল্পের শ্রমিকরা যে আয় করেন তা চাহিদার তুলনায় অর্ধেক। একই রকম বা তারচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি বিরাজমান বেসরকারি খাতের অন্যত্র। টেকসই উন্নয়নের জন্য শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতি অপরিহার্য। সরকার ও মালিকপক্ষকে তা অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

 

বাংলাদেশের শ্রমিকদের আরেক গন্তব্য বিদেশ। লাখ লাখ লোক কাজের সন্ধানে বিদেশ যাচ্ছেন। প্রতারণার ফাঁদে পড়ছেন অনেকেই। তাদের দেখভালের দায়িত্বও সরকারের। বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলোর এ মুহূর্তে প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত প্রবাসী শ্রমিকদের ভালোমন্দ বিষয়ে খোঁজখবর রাখা। তারা যাতে কোথাও প্রতারিত না হন এবং উপার্জিত অর্থ বৈধ পথে দেশে পাঠান সে ব্যাপারে দূতাবাসকর্মীদের সতর্কতা জরুরি।

লেখক : কলামিস্ট

ভোরের আকাশ/নি