দেশবরেণ্য চিকিৎসক। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক মহাসচিব এবং স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) বিএসএমএমইউ শাখার সাবেক সভাপতি।
আন্তর্জাতিক চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ব বিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি নিয়ে ভোরের আকাশের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ প্রতিনিধি নিখিল মানখিন ও নিজস্ব প্রতিবেদক আরিফ সাওন।
দৈনিক ভোরের আকাশ : বিশ্বে বাংলাদেশ আজ স্বাস্থ্যসেবার রোল মডেল বলে দাবি সরকারের। এমন দাবির যৌক্তিকতা কতটুকু?
অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ: আপনারা জানেন যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পিতা বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করে দেশ শাসন করছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ৯ মাসের মধ্যে যে সংবিধান তৈরি করেন, তার মধ্যে স্বাস্থ্য খাতকে তিনি গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
তারই ফলশ্রুতিতে দেশে কোনো রোড, কালভার্ট, স্কুল-কলেজ, ঘরবাড়ি ছিল না, সেগুলো মেরামত করার পাশাপাশি বিএমডিসি, বিএমআরসি, ৩৯৭টি হেলথ কমপ্লেক্স তখন তৈরি করেন। আর জনে জনে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য তিনি দেশে ইপিআই প্রোগ্রামটি চালু করেন। নিউট্রিশন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। এমনকি ১৯৭২ সালের ২৮ অক্টোবর আইপিজিএমআর উদ্বোধন করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন ‘শুধু করতে দিলে হবে না এর ওপর গবেষণা করতে হবে।’
সে সময় তিনি নুরুল ইসলাম স্যারকে বলেছেন, আপনারা আইপিজিএমআরকে এমনভাবে গড়ে তোলেন যাতে দেশের রোগীকে বিদেশে যেতে না হয়। তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই আইপিজিএমআরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করলেন।
আজ তার ২৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে। আমার জন্য সৌভাগ্য যে, উনার হাতে উদ্বোধন এবং উনি প্রতি বছর এই পূর্তি উৎসব আমার সঙ্গে পালন করবেন। তিনি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে বহুমুখী কর্ম সম্পাদন করেছেন এবং করে যাচ্ছেন।
উপাচার্য আরো বলেন, ২০০৬ এবং ২০২৩ সালের দুই-তিনটি ইনডেক্সে যদি আমি এভাবে বলি, ২০০৬ সালে বিশ্বে আমাদের অর্থনীতির অবস্থান ছিল ৬৩ এবং এখন আমরা ৩৫তম স্থানে। দারিদ্র্যসীমা ছিল ৪২ এবং এখন তা ১৮। শিক্ষার হার ছিল ২৬ এবং এখন তা ৭৫।
ভেবে দেখুন, তিনি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) দেশকে কোথায় নিয়ে গেছেন। মাথাপিছু আয় ৪০০ ডলার থেকে বেড়ে ৩ হাজার ডলারে উন্নীত হয়েছে। এবার আসি, স্বাস্থ্য সেক্টরের বিষয়ে। ৮ হাজার ৩১২ জনের স্বাস্থ্য ক্যাডার ছিল।
এখন তা বেড়ে উন্নীত হয়েছে ৩৫ হাজারে। করোনা মোকাবিলায় সফলতার বিবেচনায় সারাবিশ্বে আমাদের অবস্থান পঞ্চম এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আমরা প্রথম হয়েছি।
প্রথমদিকে প্রধানমন্ত্রী করোনা মোকাবিলার সময় ৪১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দিলেন। পরবর্তীতে তিনি এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছেন। তিনি অর্থনীতিকে সচল রেখেছেন। আপনারা প্রত্যক্ষ করেছেন যে, এক দিনে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি করোনা টিকা প্রদান করে বিশ্বে ইতিহাস গড়েছি। পৃথিবীর কোনো দেশ এক দিনে এমন জটিল দায়িত্ব সম্পাদন করতে পারেনি।
আমি যদি এভাবে বলি যে, ৪৬০ জেলায় মডেল মসজিদ, প্রতিটি গৃহহীনকে ঘর দেয়া হচ্ছে। আমরা কী কখনো এভাবে ভেবেছি।
উপাচার্য আরো বলেন, আপনার-আমার স্বপ্নও ছিল না যে, দেশে পদ্মার ওপর সেতু হবে, মেট্রোরেল হবে, পায়রা বন্দর হবে, কর্ণফুলী টানেল হবে। কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখেন এবং বাস্তবায়ন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ব বিদ্যালয় সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল তিনি নিজের হাতে তৈরি করে উদ্বোধনও করলেন।
তিনি বলেছেন, ‘তোমরা এখানে এমনভাবে চিকিৎসা ব্যবস্থা তৈরি করবা যেন দেশের রোগীকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে না হয়।’ প্রমাণ তো হয়েই গেছে। করোনাকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকেও বাইরে যেতে হয়নি।
সকল মানুষের চিকিৎসাসেবা দেশেই হয়েছে। প্রমাণ করেছি যে, আমরা সব রোগের চিকিৎসা করতে পারি, যোগ্যতা আছে। সুপার স্পেশালাইজড হওয়ার পর আমি আরো বেশি উজ্জীবিত হলাম। ক্যাডেবেরিক ট্রান্সপ্লান করলাম, লিভার ট্রান্সপ্লান করলাম, এবার রবোটিক সার্জারি আনার ব্যবস্থা করছি। ভবিষ্যতে আমি এখানে বোনমেরো ট্রান্সপ্লান করব, স্ট্যামসেল থেরাপি দেব, জিন থেরাপি করব। আমি গবেষণায় বরাদ্দ ৪ কোটি থেকে ২২ কোটিতে উন্নীত করেছি।
আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতায় এলেন তখন থেকে সব ক্ষেত্রেই যেমন উন্নয়ন হয়েছে, স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও আমরা পিছিয়ে নেই, ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে আজ অনেকেই আমাদের দেশে চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। ভবিষ্যতে আমাদের উচিত দেশে হেলথ ট্যুরিজমের ক্ষেত্র বাড়ানো।
আমরা যদি আরো বেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করতে পারি, আরো ফ্যাকাল্টি তৈরি করতে পারি তাহলে সারা দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাওয়া যাবে, আর দেশের রোগীরাও বিদেশে যাবে না। বাইরের বেশি সংখ্যক লোককে এখানে হেলথ ট্যুরিজম করে চিকিৎসা করানো সম্ভব হবে। ভুটান, নেপালের রোগীদেরও আনা যাবে। তারা চিকিৎসা গ্রহণ করবেন, চলে যাবেন।
দৈনিক ভোরের আকা: দেশের স্বাস্থ্য সেক্টরের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটলেও বিদেশে রোগী যাওয়া থেমে নেই। রোগীরা কেন বিদেশি যাচ্ছেন?
ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথমত বলি, বঙ্গবন্ধু যেমন ৩২৭টি হেলথ কমপ্লেক্স করেছিলেন তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলার মাধ্যমে মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থসেবা পৌঁছে দিয়েছেন।
আপনাকে একটা সত্য কথা বলি, এদেশের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। সরকার ১৬ কোটি মানুষের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে। তারপরও কিছু লোক দেশের বাইরে যায়। কেন যায়? দেশে পাওয়া গেলেও অনেকে বিদেশে বিয়ের বাজার করে ভাব দেখায়। পর্যাপ্ত টাকা আছে বলেই তারা যায়। তেমনি চোখের মধ্যে একটা বালু পড়া সমস্যা নিয়ে কেউ কেউ থাইল্যান্ড যায়। এই মানসিকতা আমাদের ত্যাগ করতে হবে।
দেশে ডাক্তার দেখিয়ে দুই দিন অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে সুস্থ হওয়ার আশা করেন। দুই দিনে কি ভালো হয়? ভালো হয় না। তারা বিদেশে গিয়ে সব টাকা হারিয়ে বিশেষ করে ক্যান্সারের রোগীরা দেশে এসে দেখে যে, নিঃস্ব হয়ে গেছে সহায় সম্বল। আর টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে তাদের কেউ কেউ মারাও যাচ্ছেন। এই মানসিকতা মানুষকে ত্যাগ করতেই হবে। বর্তমানে দেশেই সব জটিল রোগের চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে।
আমি মনে করি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকতেই পারে। বিদেশেও তা রয়েছে। যেমন দেশে উপজেলা পর্যায়ে সব ইনভেস্টিগেশন নাই, জেলা পর্যায়ে ইনভেস্টিগেশনের সকল সুবিধা নাই, সার্জন আছে তো এনেসথেসিয়াসিস্ট নাই এই জিনিসগুলো দূর করতে হবে। আসলে সরকার অনেক টাকা দেয় কিন্তু সেগুলোর সঠিক ব্যবহার হয় না।
আমি মনে করি, মেডিকেল যন্ত্রপাতি কিনতে গেলে জেলায় জেলায় বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ার, বায়োমেডিকেল টেকনিশিয়ান পোস্টিং না দিয়ে যন্ত্রপাতি দেয়া উচিত নয়। কারণ, কারো মাধ্যমে যন্ত্রপাতির তার খুলে দেখলে লাগে বিপুল অঙ্কের টাকা। নিজেদের দক্ষ টেকনোলজিস্টের অভাবে হাসপাতালে হাজার হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি বন্ধ হয়ে আছে। মানসিকতা দূর করতেই হবে। আমি যখন রোগী দেখব, নিজের পরিবারের সদস্য ভেবে দেখতে হবে।
এক্ষেত্রে আমরা বলি, কিছু কিছু হাসপাতালে দালাল চক্র গড়ে উঠেছে। তারা রোগী ভাগিয়ে অন্যত্র নিয়ে যায়। ওষুধ পাচার কঠিন করে দিয়েছে সরকার। বর্তমানে লাল সবুজের মোড়ক লাগানো থাকে। ফলে অন্য কোথাও প্রকাশ্যে তা বিক্রি করতে পারে না। দালাল চক্রের বিরুদ্ধে সব প্রতিষ্ঠানে শক্তিশালী প্রশাসনিক টিম সাজাতে হবে।
আর সরকারি হাসপাতালের যেসব জায়গায় বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণে ঘাটতি রয়ে গেছে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন আয়োজন করেন। যারা এই চক্রের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
দৈনিক ভোরের আকাশ: দেশের উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা ব্যয় রোগীদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এটা কি আদৌ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়?
ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ: আমাদের দেশে এই ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল যেখানে একটি অপারেশন করাতে ৬৫ হাজার টাকা নেয়, যা সরকারি হাসপাতালে করাতে লাগতে পারে মাত্র ৩ হাজার টাকা। এ ধরনের ভারসাম্যহীন অবস্থা থাকা উচিত নয়। বেসরকারি সব ইনভেস্টিগেশন, বিশেষ করে অপারেশন ফি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ফি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আর সরকারি হাসপাতালের যেসব চিকিৎসক বাইরে প্র্যাক্টিস করেন, তারা এখন নিজ নিজ হাসপাতালেই করতে পারবেন।
আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা অনেক আগেই চালু করেছি। সরকারি হাসপাতালেও তা ফলো করা হচ্ছে। এই প্র্যাক্টিস সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে দেশের মানুষের কম খরচে ভালো চিকিৎসাসেবা পাওয়ার পথ আরো সুগম হবে। এক্ষেত্রে আমি বলব, ভারসাম্যহীন ইনভেস্টিগেশন ও অপারেশন ব্যয় কমিয়ে আনা দরকার।
দৈনিক ভোরের আকাশ: দেশে চিকিৎসক এবং রোগী ও তাদের স্বজনদের মধ্যে প্রায় সময় ঘটে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। তাদের উদ্দেশ্যে আপনার কী পরামর্শ?
ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ: আসলে আমরা যারা চিকিৎসা দিই, তাদের ওপর ভরসা করেই রোগীরা আসেন। এই ভরসাস্থল আমরা যেন কোনোভাবেই দুর্বল না করি। আমাকে মনে রাখতে হবে যে, আমি আমার মা-বাবা, ভাইবোনের জন্য যেমন কাজ করি, আমার ওপর ভরসা রেখে আগত রোগীদের জন্য একই ধরনের কাজ করতে, আচরণ করতে হবে।
আরেকটা কাজ করতে হবে, তা হলো চিকিৎসা শুধু প্রেসক্রিপশন লেখা নয়, রোগীর কথা শুনতে হবে, সময় দিতে হবে এবং একটু ভালো ব্যবহার করতে হবে। আর যারা চিকিৎসা নিতে আসবেন, তারা যেন অধৈর্য না হন, তারা যেন সবকিছু না জেনে চিকিৎসকের ওপর হামলা না করেন। এভাবে চিকিৎসা প্রদান এবং গ্রহণকারীর মধ্যে যাতে বোঝাপড়া, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে, সেদিকে উভয়কেই খেয়াল রাখতে হবে।
ভোরের আকাশ/নি