logo
আপডেট : ১৬ মে, ২০২৩ ১০:২৬
মাঝপথে বন্ধ হচ্ছে চিকিৎসা
নিখিল মানখিন

মাঝপথে বন্ধ হচ্ছে চিকিৎসা

নিখিল মানখিন: দুটি কিডনিই অকেজো হয়ে গিয়েছিল জসিম মিয়ার (৪২)। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় তার বাড়ি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। কয়েক একর আবাদি জমি থাকলেও পরিবারে নেই কোনো চাকরিজীবী।

 

গত ৬ বছরে ডায়ালাইসিসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসাব্যয় মেটাতে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে তার সহায়-সম্বল। রয়েছে ১০ কাঠার ভিটামাটি। অর্থ সংকটে চরমভাবে ব্যাহত হয় চিকিৎসা। চলতি বছরের মার্চে জসিম মিয়া মারা যান বলে জানান ছেলে মো. শফিক। শুধু জসিম মিয়া নন, প্রতি বছর দেশের উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে অসংখ্য পরিবার। চিকিৎসার মাঝপথে অর্থের অভাবে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার ঘটনাও ঘটছে।

 

গত দুই বছর ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ছেন টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার মাগনতিনগর গ্রামের আয়েশা বেগম (৩৯)। ক্যান্সার ধরা পড়ার পর ঢাকার একটি সরকারি হাসপাতালে এক বছর চিকিৎসা নিয়েছেন। তখন খুব বেশি খরচ হয়নি। থেরাপি প্যাকেজ নিশ্চিত করতে না পেরে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

 

আয়েশা বেগমের স্বামী মো. ইলিয়াস ভোরের আকাশকে বলেন, প্রথমে তারা ভারতে যাওয়ার কথা চিন্তা করলেও চিকিৎসার খরচের কথা বিবেচনা করে দেশের সরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসা শুরুর সিদ্ধান্ত নেন। মধুপুর থেকে ঢাকা এসেছি। বাংলাদেশে চিকিৎসা আছে বলে জানান চিকিৎসকরা। তাই খরচের কথা ভেবে ভারতে যাইনি। কিন্তু এখানেও অনেক খরচ। এ রোগের চিকিৎসার একটি অংশ কেমোথেরাপি, যেটা আয়েশাকে দেয়া হয়েছে ১২টি। আর প্রতিবারেই এ বাবদ তাদের গুনতে হয়েছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।

 

জমি, গবাদিপশু বেচে ও অন্য আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা ঋণ নিয়ে চলছে তার চিকিৎসা। রোগীর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছে। অর্থ সংকটে অনিয়মিত হয়ে পড়ছে চিকিৎসা। আর কত দূর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারব বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন মো. ইলিয়াস।

 

রাজধানীর মিরপুরের ডেল্টা হাসপাতালে কেমোথেরাপি নিতে কিশোরগঞ্জ থেকে এসেছেন বুলবুল আহমেদ (৫১)। তার সঙ্গে রয়েছে ছেলে মো. ইমন। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, ডাক্তার ১০টি কেমোথেরাপি নেয়ার কথা বললেও আপাতত ৬টির বেশির খরচ বহন করা তার পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়। জমি বিক্রির আলাপ চলছে। হাতে টাকা পেলে পরবর্তী চিকিৎসা শুরু করতে পারব বলে জানান মো. ইমন।

 

মো. কাশেম (৬৩), শেরপুর জেলা সদরের নয়াপাড়া লসমানপুর গ্রামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তিনি দুরারোগ্য ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। চিকিৎসার পেছনে সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে পরিবারটি।

 

মো. কাশেমের ছেলে মো. উজ্জল ভোরের আকাশকে জানান, দুই বছর আগে ক্যান্সার ধরা পড়ে বাবার। সেই থেকে টানা চিকিৎসা চলছে। বাবা সুস্থ হয়ে উঠবেন এমন নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না চিকিৎসকরা। চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েও চিকিৎসকদের এমন কথা আমাদের কষ্টের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানান উজ্জল।

 

দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে সবুজ মিয়ার (৬০)। ডায়ালাইসিস দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। দুটি ডায়ালাইসি ও ওষুধের পেছনে প্রতি সপ্তাহে খরচ লাগে প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। জরুরি ভিত্তিতে কিডনি প্রতিস্থাপন করানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

 

কিন্তু রোগীর পরিবারের পক্ষে এ ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পরিবারটির আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। চিকিৎসার খরচ মেটানোর পেছনে ইতোমধ্যে সহায়-সম্বল ফুরিয়ে গেছে বলে জানান সবুজ মিয়ার ছেলে মো. জয়নাল।

 

এভাবে চিকিৎসাসেবার উচ্চ ব্যয় বহন করতে গিয়ে সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে শত শত পরিবার। এটি দেশের দারিদ্র্যবিমোচন মোকাবিলার পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, হুহু করে বেড়েই চলেছে দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যয়। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যয় বাকিতে চলে না। তুলনামূলকভাবে কম চিকিৎসা ব্যয় হলেও সব জটিল রোগের দীর্ঘমেয়াদি ও চূড়ান্ত পর্যায়ের চিকিৎসা মেলে না সরকারি হাসপাতালে।

 

চিকিৎসা গ্রহণের মাঝপথে নানা কারণে বেসরকারি হাসপাতালে যেতেই হয়। সেখানকার উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে মাঝপথেই ঝরেপড়ে অনেক রোগী এবং নিঃস্ব হয়ে পড়ে তাদের পরিবার। রোগীও বাঁচে না, সহায়-সম্বলও রক্ষা পায় না।

 

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে একজন ব্যক্তিকে তার চিকিৎসা ব্যয়ের ৫৫ শতাংশ বহন করতে হতো। আর সরকারি ব্যয় ছিল ৩৭ শতাংশ। ২০০০ সালে ব্যক্তির ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় কমে হয় ৩৩ শতাংশ। ২০০৩ সালে ব্যক্তির ব্যয় ৫৯ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় আরো কমে হয় ৩১ শতাংশ।

 

২০০৬ সালে ব্যক্তির ব্যয় ৫৮ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় ৩২ শতাংশ। ২০০৯ সালে ব্যক্তির ব্যয় ৬০ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় ২৫ শতাংশ। ২০১২ সালে ব্যক্তির ব্যয় ৬৩ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় ২৩ শতাংশ। ২০১৫ সালে ব্যক্তির ব্যয় ৬৭ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় ২২.৮ শতাংশ।

 

সর্বশেষ ২০২০ সালে ব্যক্তির ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৬৮.৫ শতাংশ এবং সরকারি ব্যয় কমে দাঁড়িয়েছে ২৩.৩ শতাংশ। ব্যক্তি ও সরকারের বাইরে অবশিষ্ট ব্যয় বহন করে এনজিও, প্রাইভেট সেক্টর ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। এ পরিসংখ্যান বিশ্নেষণ করে বলা যায়, গত দুই যুগে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে ব্যক্তির ব্যয় ১৩.৫ শতাংশ বেড়েছে। আর সরকারি ব্যয় কমেছে প্রায় ১৪ শতাংশ।

 

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ ভোরের আকাশকে বলেন, দেশে সংক্রামক রোগ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এলেও বেড়েছে অসংক্রামক রোগগুলোর তীব্রতা। বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোক, লিভার, কিডনিসহ বিভিন্ন জটিল রোগের উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় অধিকাংশ রোগীর পরিবার সামাল দিতে পারেন না। সরকারি হাসপাতালে এসব রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে।

 

কিন্তু এসব জটিল রোগে আক্রান্তের সংখ্যা এত বেশি, সরকারি হাসপাতালেও সংকুলান হয় না। আর বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেশি এটা বিশ্বের সব দেশেই হয়ে আসছে। চিকিৎসাসেবা প্রদানের সক্ষমতার তুলনায় রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় বাংলাদেশে এ সমস্যা আরো বেশি প্রকট বলে জানান ডা. আজিজ।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, সীমিত সম্পদ ও আয়তনের তুলনায় দেশে রয়েছে বিপুল জনসংখ্যা। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় এখনো সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতালের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। জটিল রোগগুলোর চিকিৎসা সব জায়গায় হয় না।

 

সব জটিল রোগের চিকিৎসা অনেকটা রাজধানীকেন্দ্রিক। ফলে ব্যবস্থা থাকলেও সরকারি হাসপাতালগুলোয় সব রোগীকে চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

 

তিনি আরো বলেন, শুধু দরিদ্র রোগীর নয়, অনেক ধনী পরিবারের রোগীদের পক্ষেও বেসরকারি হাসপাতালের উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় বহন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আমি অনেক দিন ধরেই এসব নিয়ে কথা বলে আসছি বলে জানান ডা. আব্দুল্লাহ।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, আমাদের দেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে উচ্চ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল যেখানে একটি অপারেশন করাতে ৬৫ হাজার টাকা নেয়, যা সরকারি হাসপাতালে করাতে লাগতে পারে মাত্র ৩ হাজার টাকা।

 

এ ধরনের ভারসাম্যহীন অবস্থা থাকা উচিত নয়। বেসরকারি সব ইনভেস্টিগেশন, বিশেষ করে অপারেশন ফি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ফি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। আর সরকারি হাসপাতালের যেসব চিকিৎসক বাইরে প্র্যাক্টিস করেন, তারা এখন নিজ নিজ হাসপাতালেই করতে পারবেন। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা অনেক আগেই চালু করেছি। সরকারি হাসপাতালেও তা ফলো করা হচ্ছে। এ প্র্যাক্টিস সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে দেশের মানুষের কম খরচে ভালো চিকিৎসাসেবা পাওয়ার পথ আরো সুগম হবে।

 

এক্ষেত্রে আমি বলব, ভারসাম্যহীন ইনভেস্টিগেশন ও অপারেশন ব্যয় কমিয়ে আনা দরকার।

 

ভোরের আকাশ/নি