logo
আপডেট : ১৭ মে, ২০২৩ ১০:৩৬
কূটনৈতিক তৎপরতা সতর্ক আওয়ামী লীগ
নিখিল মানখিন

কূটনৈতিক তৎপরতা সতর্ক আওয়ামী লীগ

নিখিল মানখিন: আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বেড়েছে বিদেশি শক্তির তৎপরতা। পাওয়া যাচ্ছে বিদেশিদের অযাচিত হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত।

 

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সবসময়ই বিদেশি কূটনৈতিক মোকাবিলায় পারদর্শী আওয়ামী লীগ। দেশের স্বার্থ রক্ষায় বিদেশিদের কড়া জবাব দিতেও দ্বিধা করে না দলটি। তিন দেশ সফর শেষে সোমবার অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের স্পষ্ট অবস্থান জানিয়ে তারই প্রমাণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

 

পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, গত কয়েক বছরে নানা ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর বৈদেশিক চাপ বেড়ে গিয়েছিল। তবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তা সামাল দিয়ে চলেছে আওয়ামী লীগ। তিক্ততা চরম পর্যায়ে যাওয়ার আগেই দলটি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর সুনজরে পড়েছে বাংলাদেশ ও বর্তমান সরকার। বাংলাদেশে আগমন ঘটছে বিশ্বের একের পর এক প্রভাবশালী দেশের প্রতিনিধিদের।

 

২০২২ সালের শেষের দিকে এসে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে শতভাগ ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার অগ্নিপরীক্ষায় পড়ে বাংলাদেশ। কূটনৈতিক মহলের আলোচিত খবর ছিল র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি, যা বিদায়ী বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির মাঠও উত্তপ্ত করে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে লবিস্ট নিয়োগের কথাও বলেছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু নতুন বছরেও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়নি।

 

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য সফর করেছেন।

 

সোমবার সেই সফরের বিস্তারিত তুলে ধরতে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কথা নাই বার্তা নাই, স্যাংশনের ভয় দেখাবে আর আমরা ভয়ে মুখ বুঝে থাকব কেন?

 

আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি, যারা আমাদের সপ্তম নৌবহরের ভয় দেখিয়েছিল, সেটাও পার করে বিজয় অর্জন করেছি, এ কথা ভুললে চলবে না। দরকার হলে একবেলা খেয়ে থাকব, তাতেও অসুবিধা নেই। আমাদের ওপর যারা স্যাংশন দেবে, তাদের কাছ থেকে আমরা কিছু কিনব না, পরিষ্কার কথা। এর মধ্যেই আমি দুটি অ্যাকশন নিয়েছি আগেই।

 

তাতে ভয়ের কী আছে? আমরা তো কারো ওপর নির্ভরশীল নয়। আমাদের যা দরকার, আমরা নিজেরাই তো উৎপাদন করতে পারি বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী।

 

মঙ্গলবার বিদেশিদের হস্তক্ষেপের বিষয়ে একই সুরে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

 

তিনি বলেন, বিদেশিরা নয়, বিদেশিরা বাংলাদেশে ক্ষমতায় বসাবে এমন অসম্ভব চিন্তা আওয়ামী লীগ করে না। দেশের ক্ষমতার মালিক বিদেশিরা নয়, বরং মালিক হলো দেশের জনগণ। সুতরাং ক্ষমতায় বসাতে হলে বসাবে দেশের জনগণ।

 

শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন আমরা ক্ষমতায় আসতে চাই জনগণের ভোটে। জনগণ চাইলে আছি, না চাইলে নাই।

 

শেখ হাসিনা বিদেশি শক্তিকে ভয় পান না মন্তব্য করে তিনি বলেন, এই মানসিকতা যার (শেখ হাসিনা), তিনি বিদেশি বা দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের ভয় পাবেন, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।

 

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে উদ্দেশ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, তিনি মনে করছেন পশ্চিমারা তাকে ক্ষমতায় বসাতে পারবে, তার দলকে ক্ষমতায় বসাতে পারবে। সে কারণে ঘন ঘন তাদের দুয়ারে ধরনা দিচ্ছেন, নালিশ করছেন, লবিস্ট নিয়োগ করছেন বলে অভিযোগ করেন ওবায়দুল কাদের।

 

বৈদেশিক চাপ: ঢাকায় মায়ের ডাকের সমন্বয়কের বাসায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের যাওয়াকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক বিতর্ক গড়ায় যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার বৈরিতা পর্যন্ত। এলিট ফোর্স র‌্যাব ও এর ৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মাথায় নিয়ে শুরু হওয়া বিদায়ী বছরে সবচেয়ে আলোচিত ছিল ঢাকা-ওয়াশিংটন টানাপড়েন।

 

মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানিসহ পশ্চিমা কূটনীতিকদের এ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে খোলামেলা কথা বলা ও তাদের কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলতে সরকারের বারবার তাগিদের মধ্যেও বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হয়ে ওঠে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এক অপ্রীতিকর ঘটনা।

 

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের ইস্যুতে রুশ-মার্কিন পাল্টাপাল্টি বাগ্বিতন্ডা ফেসবুক, টুইটার ও ঢাকা থেকে মস্কো পর্যন্ত গড়ায়। গত ২২ ডিসেম্বর রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা মস্কো থেকে বিবৃতির মাধ্যমে পিটার হাসের ঘটনার ব্যাপক সমালোচনা করেন।

 

এর মধ্যেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কিছু জিনিসপত্র বহনকারী রাশিয়ার পতাকাবাহী কার্গো জাহাজ উরসা মেজর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি পায়নি।

 

গত ১৪ নভেম্বর ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ অনুষ্ঠানে জাপানি রাষ্ট্রদূত ইতি নাওকি বলেন, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে দেখতে চায় জাপান। তিনি আরো বলেন, গত নির্বাচনে আগের রাতেই পুলিশ ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছিল বলে আমি শুনেছি। অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্ত নেই।

 

এবার তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না বলে আশা প্রকাশ করেন জাপানি রাষ্ট্রদূত। রাষ্ট্রদূতের এমন বক্তব্যে বিব্রত পরিস্থিতিতে পড়ে আওয়ামী লীগ।

 

২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে যৌথভাবে এক বিবৃতি প্রকাশ করে ১৫টি দেশ। বিবৃতি দেয়া দেশগুলো নিজেদের বাংলাদেশের বন্ধু ও অংশীদার হিসেবে অভিহিত করেছে। তারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও নির্বাচন বিষয়ে অঙ্গীকার রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন। এখানেও বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয় আওয়ামী লীগের ওপর।

 

চলতি বছরের মার্চে প্রথম আলোর সাংবাদিক গ্রেপ্তারসহ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের বিষয় উল্লেখ করে বিদেশি দেশ ও সংস্থাগুলো যে বিবৃতি দিচ্ছে তা আমলে নিচ্ছে না সরকার। বিদেশি দেশ ও সংস্থাগুলোর এ ধরনের মন্তব্য বা বিবৃতি সরকারের জন্য বাধার কারণ নয় এবং তাতে দেশের ভাবমূর্তিতে ন্যূনতম আঁচড়ও পড়বে না। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের বিষয় উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ১২ দেশ এক বিবৃতিতে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে তার প্রত্রিক্রিয়ায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বৃহস্পতিবার এমন মন্তব্য করেন।

 

কূটনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য সফর করেছেন। সফর শেষে দেশে ফিরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে বিদেশি শক্তির প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন, বিরোধী পক্ষের প্রতি সরকার পক্ষের আচরণ এবং মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান ‘তিক্ত সম্পর্কের’ সমাপ্তি চায় বাংলাদেশ। গত এক বছর ধরে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের পর গত এক সপ্তাহ ধরে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকেও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা প্রভাবশালী দেশটি বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হয় তা চায়।

 

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী ভোরের আকাশকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্য ও সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে বাংলাদেশ। বিএনপিসহ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দীর্ঘ বছর ধরে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা ও অপপ্রচার চালিয়ে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু তাদের সে অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। অনেক আগেই কূটনৈতিক তৎপরতা জোরালো করেছে দলটি। ভুল তথ্য দিয়ে বিদেশিদের বিভ্রান্ত করার দিন শেষ হয়ে গেছে বলে জানান সুজিত রায় নন্দী।

 

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা জানান, দল গোছানোর পাশাপাশি বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও আলোচনার মাত্রা তারা কয়েকগুণ বাড়িয়েছে। নীরব ক‚টনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েছে আওয়ামী লীগ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দলীয় অবস্থান এবং নির্বাচন নিয়ে সরকারের চিন্তাভাবনার বিষয়ে বার্তা দিতেই এ কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা।

 

শুধু দলীয় ব্যক্তিদের দিয়েই নয়, বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশে নিযুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালাচ্ছে হাইকমান্ড।

 

ভোরের আকাশ/নি