logo
আপডেট : ১৯ মে, ২০২৩ ১২:৪৪
আজ সেন্দিয়া গণহত্যা দিবস
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করায় খুশি এলাকাবাসী
নিত্যানন্দ হালদার, মাদারীপুর

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করায় খুশি এলাকাবাসী

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায় নির্মিত স্মৃতিসৌধ

মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার সেন্দিয়া গণহত্যা দিবস আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে রাজৈরের খালিয়া ইউনিয়নের সেন্দিয়া, পলিতা, ছাতিয়ানবাড়ী ও খালিয়া গ্রামের দেড় শতাধিক মুক্তিকামী মানুষ প্রাণ রক্ষা করতে আখক্ষেত ও ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে পাকবাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের হাতে প্রাণ দেন। অর্ধশত বছর পর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে নিহতদের স্মৃতি রক্ষার্থে সরকারি অর্থায়নে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ হয়েছে।

 

চলতি বছরের ৩ মার্চ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান খান এমপি এই স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করায় শহীদ পরিবারের সদস্য, স্বজন ও স্থানীয়রা খুশি হয়েছেন।

 

প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাকসেনারা মাদারীপুরের টেকেরহাট বন্দরে সেনাক্যাম্প স্থাপন করে শুরু করে পৈশাচিকতা। ১৯৭১ সালের মে মাসে পাকবাহিনী লঞ্চযোগে গোপালগঞ্জ জেলার ভেন্নাবাড়ী ঘাটে নেমে চরচামটা নামক এলাকা থেকে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ শুরু করে।

 

সেখান থেকে পাকবাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় নৌপথে গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর হয়ে রাজৈরের কদমবাড়ী এলাকায় গানবোট থেকে নেমে সড়কপথে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে আসছে এমন খবর পেয়ে খালিয়া ইউনিয়নের সেন্দিয়া, পলিতা, খালিয়া ও ছাতিয়ানবাড়ী এলাকার হাজার হাজার নিরীহ জনগণ আখক্ষেতসহ বিভিন্ন ঝোপ-জঙ্গলে আশ্রয় নেয়।

 

যারা বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে পারেনি তাদের ধরে নিয়ে যায় পশ্চিম সেনদিয়া ফকিরবাড়ির ভিটায়, সেনদিয়া বাওয়ালি ভিটায়, বারিকদার বাড়ির উত্তর বাঁশ বাগানে, শচীন বারিকদারের বাড়ির দক্ষিণ খালপাড় এবং ছাতিয়ানবাড়ীর পুকুর পাড়ে। কারো চোখ বেঁধে, কারো হাত-পা বেঁধে, বাবা-মায়ের সামনে সন্তানকে, আবার সন্তানের সামনে বাবা-মাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

 

আবার কাউকে বুটজুতা দিয়ে লাথি মেরে ক্ষত-বিক্ষত করে আগুনে পুড়িয়ে বা গুলি করে হত্যা করে। এ ছাড়াও অনেককে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। দীর্ঘ সময় এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে নরপিশাচরা ফেরার উদ্দেশ্যে পশ্চিম সেনদিয়া গ্রাম দিয়ে যেতেই আখক্ষেতে মানুষের শব্দ পেয়ে ব্রাশফায়ার করে। নিমিষেই প্রাণ হারায় শতাধিক মানুষ।

 

এ ছাড়াও পাকবাহিনীর দোসররা আখক্ষেত এবং ঝোপ-জঙ্গলে তল্লাশি চালিয়ে মাটির গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ও ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে ৬টি স্পটে দেড় শতাধিক পলায়নরত মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। নারকীয় এ তান্ডব শেষে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা চলে যাবার পর গ্রামের অন্যান্য লোকজন ও আত্মীয়স্বজন এসে ঝোপ-জঙ্গল এবং আখক্ষেতের মধ্যে থেকে লাশ উদ্ধার করে খালের পাশে ৬টি স্থানে দেড় শতাধিক মানুষকে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। এসব স্থানে মাটি খুঁড়লেই মাটির মধ্যে থেকে এখনো মাথার খুলি ও হাড়গোড় বেরিয়ে আসছে।

 

সেদিনের ঘটনায় দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধ নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয় এবং গুরুতর আহত হয় অনেকেই। পাকবাহিনীর গুলিতে আহতদের অনেকেই এখনো ধুঁকে ধুঁকে মরছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে নিহতদের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ।

 

সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সেন্দিয়া গ্রামের শচীন্দ্র নাথ বারিকদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ’৭১ সালের ৫ জ্যৈষ্ঠ অন্যান্য দিনের মতো পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের কথা মনে করে আতঙ্কের মধ্য দিয়ে সেন্দিয়ার বাড়িতে অবস্থান করছিল। এমনি সময় সংবাদ আসে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা কদমবাড়ী থেকে অগ্নিসংযোগ করতে করতে আসছে।

 

এ সংবাদ শুনে এলাকার জনগণ যে যেভাবে পারে পালানোর চেষ্টা করে। এ সময় তাদের বাড়ির লোকজনও বাড়ির নিকটস্থ আখক্ষেতের মধ্যে পূর্বের করা গর্তের মধ্যে পালিয়েছিল। কিন্তু পালিয়েও প্রাণ রক্ষা হয়নি। পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের চোখ ফাঁকি দেয়া যায়নি। তারা বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার পর চিরুনি অভিযান চালায় ঝোপ-জঙ্গল ও আখক্ষেতের মধ্যে।

 

পলায়নরত নিরীহ মানুষগুলো ঘাতকদের দেখে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে এবং বাঁচার জন্য কাকুতি মিনতি করতে থাকে। এতে ঘাতকদের মনে একটুও করুনার উদয় হয়নি। ঘাতকরা এ সময় গণহত্যায় মেতে ওঠে। তাদের বুলেটের আঘাতে তার বাবা, মেঝ ভাই, কাকাতো ভাই, কাকিমাসহ পরিবারের ৮ জন সদস্য মারা যান। তাদের লাশগুলো বাড়ির নিকটস্থ খালপাড়ে একই গর্তের মধ্যে রাখা হয়।

 

বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিতে গিয়ে শচীন্দ্র নাথ বারিকদারের কান্নায় উপস্থিত জনতা চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। সবাই ফুফিয়ে ফুফিয়ে কেঁদেছে। শচীন্দ্র নাথ বারিকদারের কান্না থামানোর সান্তনা কারোর ছিল না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে নিহতদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করায় তার পরিবারসহ এলাকার জনগণ দারুণভাবে খুশি।

 

একই গ্রামের মাস্টার ক্ষিতিশ চন্দ্র বারিকদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেদিনের ঘটনায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা ১৭টি গ্রামের ৫ শতাধিক ঘরবাড়ি গান পাউডার দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং অসংখ্য মানুষ হত্যা করে।

 

স্বাধীনতার অর্ধশত বছর কেটে গেলেও এখনো এ এলাকার ঝোপ-জঙ্গল ও খালের পাড় খুঁড়লেই পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আলবদর আল-শামসদের হাতে নিহতদের মাথার খুলি এবং হাড়গোড় পাওয়া যাচ্ছে। দিবসটি সরকারিভাবে পালনের দাবি জানান তিনি।

 

ভোরের আকাশ/নি