logo
আপডেট : ২২ মে, ২০২৩ ১৩:৫২
সিন্ডিকেট-মজুতদারদের দখলে পেঁয়াজের বাজার
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি

সিন্ডিকেট-মজুতদারদের দখলে পেঁয়াজের বাজার

কুষ্টিয়ায় এ বছর হতাশায় ভুগছেন পেঁয়াজ চাষিরা। যে আশা নিয়ে মাঠে পেঁয়াজ চাষ করেছিলেন সে আশা জলে গেছে। অধিকাংশ চাষিই এ বছর পেঁয়াজ চাষ করে লোকসানে পড়েছে বলে অভিযোগ তাদের। কয়েকদিন ধরেই বাজারে পেঁয়াজের দর ঊর্ধ্বমুখী। গত সাত দিনের ব্যবধানে কুষ্টিয়ার বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিতে প্রায় ৩০ টাকা এবং এক মাসের মধ্যে দফায় দফায় বেড়ে প্রায় তিনগুনে ঠেকেছে।

 

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, হঠাৎ করে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ৮০ টাকা হতে হবে। মালের সরবরাহও আছে, মূলত পাইকার ও আড়তদাদের কারসাজিতেই এমন আকাশচুম্বি পেঁয়াজের দাম। কুষ্টিয়ায় সিন্ডিকেট-মজুতদারদের দখলে রয়েছে পেঁয়াজের বাজার।

 

খলিসাকুন্ডি বাজারের পেঁয়াজ বিক্রেতা সলেমান খাঁজা বলেন, দেশি পেঁয়াজ গত মাসে বিক্রি করেছি ২৫-৩০ টাকা কেজি। ১ সপ্তাহ আগেও দাম ছিল ৫০-৫২ টাকা। আজকে হঠাৎ করে আড়তেই পেঁয়াজের কেজি ৭৫-৮০ টাকা।

 

কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ঝাউদিয়া বাজারের খুচরা বিক্রেতা মওলা বিশ্বাস বলেন, মাঠ থেকে পেঁয়াজ তোলার পর নিজের সংসারের প্রয়োজনীয় পরিমাণ রেখে বাকিটা পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে সবাই। এখন চাষিদের কাছে পেঁয়াজ নেই।

 

বাজারে যে পেঁয়াজ সরবরাহ হচ্ছে তা মূলত: দেশের বিভিন্ন আড়ত ও মজুদদারদের কাছ থেকে কিনে এনে বিক্রি করছি। এখন পেঁয়াজের বাজার সব বড় এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে।

 

তিনি জানান, পেঁয়াজের যে খুব বেশি চাহিদা তা কিন্তু না। আমাদের এলাকায় যে পেঁয়াজ হয় তা চাষিরা তাড়াতাড়ি বিক্রি করে দেয়, কারণ সংরক্ষণ করতে পারে না। এজন্য এখন বাইরে থেকে পেঁয়াজ আমদানি করে এনে বিক্রি করতে হচ্ছে।

 

খলিসাকুন্ডি এলাকার চাষি ইংরাজ মন্ডল বলেন, এ বছর আমি এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেছিলাম। এক বিঘা জমিতে আমি ৪০ হাজার টাকা খরচ করেছি। পেঁয়াজ পেয়েছি ৬০ মণ। প্রতি মণ ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে ৩২ হাজার টাকা হয়েছে। বিঘায় আমার ৮ হাজার টাকার মতো লস হয়েছে। মূলত চাষিরা মৌসুমে পেঁয়াজের দাম পায় না। ১২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি পেঁয়াজ আমি, এখন দাম ৭০-৮০।

 

মিরপুর উপজেলার ক্ষুদ্র পেঁয়াজ চাষি সোহেল রানা বলেন, প্রতিবছরই ৫ কাঁঠা জমিতে করে পেঁয়াজ চাষ করি। সেখান থেকে নিজেদের খাওয়া হয় এবং আত্মীস্বজনদের দেয়া হয়। গত বছর ৫ কাঁঠা জমি থেকে আমি ৭ মণ পেঁয়াজ পেয়েছিলাম। কিন্তু এবার পেঁয়েছি মাত্র ১২ কেজি।

 

একই উপজেলার পোড়াদহ এলাকার চাষি আনন্দ বলেন, আমি এ বছর তিন বিঘা জমিতে পেঁয়াজের চাষ করি। কিন্তু পেঁয়াজের ফলন ভালো হয়নি। যেখানে ২০০ মণ পেঁয়াজের আশা করেছিলাম সেখানে মাত্র ৭০ মণ পেঁয়াজ পেয়েছি, যাতে আমার জমির খরচই উঠেনি।

 

কুমারখালী উপজেলার কৃষক ইন্তাজ আলী বলেন, জমি, বীজ, সার, কীটনাশক, পরিচর্যা ও পরিবহন দিয়ে প্রতিকেজি পেঁয়াজে খরচ হয়েছে ২৫-৩০ টাকা। কিন্তু আমাদের বিক্রি করতে হয়েছে ১৫-২০ টাকায়। বড় বড় মজুতদাররা কৌশলে চাষিদের কাছ থেকে সব পেঁয়াজ গোডাউনে ঢুকিয়ে ইচ্ছে মতো দাম হাঁকাচ্ছে। এবার পেঁয়াজ ভালো হয়নি এই এলাকায়। অধিকাংশ চাষিই উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে বিক্রি করায় লোকসান হয়েছে।

 

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, কুষ্টিয়ার ৬টি উপজেলায় ১২ হাজার ১৩১ হেক্টর জমিতে রবি মৌসুমে পেঁয়াজের চাষ হয়েছিল। এর মধ্যে ৩ হাজার ২৮৫ হেক্টর জমিতে মুলকাটা এবং ৮ হাজার ৮৪৬ হেক্টর জমিতে চারা। মুলকাটা পেঁয়াজের মধ্যে দৌলতপুর উপজেলায় ২ হাজার ৬৯৯ হেক্টর জমিতে এবং চারা পেঁয়াজে কুমারখালী উপজেলায় ৪ হাজার ১৯১ হেক্টও জমিতে চাষ হয়। চলতি মৌসুমে পেঁয়াজ রোপণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৩ হাজার ৭৩৫ হেক্টর।

 

লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৬০৪ হেক্টর জমিতে কম আবাদ হয়েছে। তবে ২০২১-২২ অর্থবছরে এ জেলায় ১২ হাজার ৯১০ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও সে সময় অর্জিত হয়েছিল ১৩ হাজার ৭৩৪ হেক্টর জমিতে।

 

কুষ্টিয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ড. হায়াত মাহমুদ বলেন, আমরা প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষকদের বিনামূল্যে পেঁয়াজের বীজসহ বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করেছি। সেই সাথে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের পেঁয়াজ চাষে উদ্বুদ্ধ করেছি। তবে এবার তাপমাত্রার কারণে কিছু এলাকায় পেঁয়াজের ফলনে ঘাটতি হয়েছে।

 

তিনি জানান, চাষি পর্যায়ে পেঁয়াজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় তারা মাঠ থেকে তুলেই বাজারে বিক্রি করায় দাম কম পায়। তবে কৃষকরা যাতে পেঁয়াজ চাষে আরো আগ্রহী হয় এজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে।

 

কুষ্টিয়ার বাজার কর্মকর্তা সুজাত হোসেন খান বাজার সিন্ডিকেটের কারসাজির সত্যতা স্বীকার করে বলেন, হঠাৎ করে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই পেঁয়াজের বাজার দর অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগামীর বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।

 

আগামী ৫-৭ দিনের মধ্যে আমাদানিকৃত পেঁয়াজ বাজারে ঢুকে যাবে এবং দেশীয় পেঁয়াজের বাজার দর সহনীয় পর্যায়ে না আসলে সরকার হার্ড লাইনে যাবে বলে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

 

ভোরের আকাশ/নি