ইমরান খান: তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে বাড়ছে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের ব্যবহার। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইমো ও হোয়াটসঅ্যাপসহ অন্য মাধ্যমগুলোতে এই অপরাধের প্রবণতা বেশি। বিশেষ করে সাইবার হামলা বা হয়রানির শিকার হচ্ছেন নারীরা। হয়রানির শিকার হলেও ভুক্তভোগীদের ৩০ শতাংশই এসব ঘটনায় কীভাবে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়, সে বিষয়টি জানেন না।
আবার অনেকেই থানায় জিডি বা মামলা করেও প্রতিকার পাননি। অনেকে ক্ষেত্রে মামলা করার পর উল্টো চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন ভুক্তভোগীরা। এসব কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে সাইবার হেনস্তার শিকার নারীদের অভিযোগের হার দিন দিন কমেই চলছে।
২০১৮ থেকে পাঁচটি জরিপে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী অভিযোগকারীর শতকরা হার ছিল ৬১ শতাংশ, ২০২৩ এ গিয়ে তা কমে ২০ দশমিক ৮৩ শতাংশে নেমেছে। এদিকে, ২০২৩ সালের জরিপে ভুক্তভোগীদের ১৪ দশমিক ৮২ শতাংশের বয়সই ১৮ বছরের নিচে, যা ২০১৮ সালের জরিপের তুলনায় ১৪০ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অপপ্রচারের শিকার হয় নারী ও শিশুরা।
দেড় বছর আগে মোবাইল অ্যাপ ইমোতে রাসেল নামের এক সৌদি প্রবাসীর সঙ্গে পরিচয় পল্লবীর এক তরুণীর। দীর্ঘদিন ইমো ও হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় তাদের। একপর্যায়ে ওই তরুণীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় পাপ্পু। ২০২২ সালের ৩০ আগস্ট ইমো বোর্ডের অডিওকলের মাধ্যমে বিয়ে হয় তাদের। বিয়ের পর ইমোতে ভিডিওকলে নিয়মিত কথা হতো।
কিছুদিন পর নিজের বাবার চোখের অপারেশনের কথা জানিয়ে ওই তরুণীর কাছে ৫০ হাজার টাকা ঋণ চায় পাপ্পু। সরল বিশ্বাসে তাকে ৫০ হাজার টাকা পাঠান ওই নারী। এরপর আবারো টাকা চাইলে তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন তরুণী। এতেই বাধে বিপত্তি। শুরু হয় ব্ল্যাকমেইল।
হঠাৎ করে পাপ্পু জানায়, তার কাছে ওই তরুণীর ইমোকলের সময় ধারণ করা ফুটেজ রয়েছে। টাকা না দিলে ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করে দেয়ার হুমকি দেয় সে। এভাবে ব্ল্যাকমেইল করে ওই তরুণীর কাছ থেকে মোট ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় সৌদি প্রবাসী রাসেল।
এ বিষয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করার পর ভিডিও কলে কথা বলার সময় ধারণ করা স্ক্রিন ভিডিও পরিচিতদের পাঠিয়ে দেয় রাসেল। বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে রাসেল ও তার ভাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ওই নারী ও তার স্বজনদের ছবি দিয়ে হেনস্তা করেছে।
শুধু তাই নয়, এ বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন করেছে এমন কয়েকজন সংবাদকর্মীকে ফোন করে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় পরিচয় দিয়ে হুমকি-ধমকি দেয় প্রবাসী রাসেলের ভাই এ আর নোমান। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজও করেন। ভুক্তভোগীর অভিযোগ এ বিষয়ে থানায় জিডি করার পর সেটা ডিবির সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগে (সিটিটিসি) পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপ-পরিদর্শক শিবলু মন্ডল জানান, যেসব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠানো হয়েছে, সেসব নম্বরের মালিকদের তথ্য যাচাই-বাছাই করে থানায় তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। পরবর্তী ব্যবস্থা থানা থেকেই গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।
ভুক্তভোগী ওই নারীর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমি সরল বিশ্বাসে তার সঙ্গে সম্পর্ক করেছিলাম। সে নাম-ঠিকানা থেকে শুরু করে সব ভুয়া তথ্য দিয়ে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা নিয়েছে।
একবার রাসেলের স্ত্রী তামান্নার ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও আমি টাকা পাঠিয়েছি। সেটাও প্রমাণ রয়েছে। জিডি করে কোনো প্রতিকার পাইনি। উল্টো রাসেল ও তার ভাই এ আর নোমান আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। কিছুদিন আগে ঢাকার সাইবার ট্রাইবুন্যালে মামলা করেছি। তবে আমার মনে হয় এসব বিষয় নিয়ে মামলা বা অভিযোগ করা আমার ঠিক হয়নি। চুপচাপ থাকলে আমার সম্মানহানি হতো না।
একই রকম ঘটনার স্বীকার রাজধানীর উত্তরা এলাকার বাসিন্দা সায়মা আক্তার (ছদ্মনাম)। তিনি একটি কলেজের শিক্ষার্থী। একই এলাকার বাসিন্দা ফেরদৌসের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। সম্পর্ক চলাকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেরদৌসের সঙ্গে আদান-প্রদান হয় বিভিন্ন নগ্ন ছবি। ফেরদৌস মাদকাসক্ত হওয়ায় একপর্যায়ে প্রেমের সম্পর্কে চিড় ধরে। আর এতেই প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে প্রেমিক ফেরদৌস।
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় নগ্ন ছবিগুলো। এ ঘটনায় শারমিন উত্তরা পশ্চিম থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পর তদন্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ। কিন্তু আইনগতভাবে আর সামনে এগোননি শারমিন। পুলিশের কাছে শুধুই ছবিগুলো অপসারণের দাবি জানান তিনি।
শুধু এই দুজন নারীই নন, সাইবার ক্রাইমের শিকার অধিকাংশ নারীর অবস্থা একই রকম। কেউ অভিযোগ করে পিছিয়ে যাচ্ছেন, আবার কেউ অভিযোগ না করে অন্তরালেই থেকে যাচ্ছেন। বিশেষ করে টিনএজার বা কিশোরী বয়সের মেয়েরা আইনগত ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা, নিজের পরিবারকেই জানাতে চান না কিছু। আবার অনেক শিক্ষিত সচেতন নারীও আইনি ঝামেলার মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে এড়িয়ে যান সাইবার ক্রাইমের ঘটনাগুলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রাশেদা রওনক খান বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ভুক্তভোগীরা কেন যান না এটাই একটি বড় প্রশ্ন। ধর্ষণের বিষয়েই যদি বলি নানা ধরনের প্রমাণ একজন নারীকে দিতে হয়। আলামত নষ্ট হয়ে গেলে সেটা আরো কঠিন হয়ে পড়ে। ১৮ বছরের নিচে বাচ্চাদের কাছেও এখন যেভাবে মোবাইল পৌঁছে গেছে তাদের অপরাধের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তাই এখনই আমাদের সচেতন হতে হবে।
সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতাবিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য প্রকৌশলী মো. মুশফিকুর রহমান বলেন, নিজেদের তৈরি নয় অজানা জায়গা থেকে আসা প্রযুক্তি আমরা ব্যবহার করি। তাছাড়া সাইবার দুনিয়াটা পুরোটাই ধোঁয়াশায় পূর্ণ। এজন্য সবাইকে অনেক বেশি সচেতন থাকতে হবে।
এ বিষয়ে সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ডিভিশন বিভাগের পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম বলেন, সাইবার ক্রাইম নিয়ে কাজ করার জন্য তিনটি আইন রয়েছে। আমাদের ডিপার্টমেন্ট এই তিন আইনের ওপর ভিত্তি করেই কাজ করে। আমরা লক্ষ করেছি বেশিরভাগ নারী মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক করে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। দেশেও এরকম ঘটনা ঘটছে।
অপরাধী দেশে আছে কিনা অথবা তারা খুব বেশি প্রভাবশালী কিনা ইত্যাদি বিষয় চিন্তা না করে সাইবার আক্রমণের শিকারদের পুলিশের কাছে আসা দরকার।
ভোরের আকাশ/নি