শাহীন রহমান: রাত পোহালেই ভোট গাজীপুর সিটিতে। সিটি করপোরেশনের ৫৭ ওয়ার্ডের মেয়র ও কাউন্সিলর কে হবেন তা আগামীকাল বৃহস্পতিবার নির্ধারণ করবেন ভোটাররা। নিজের পছন্দের প্রার্থী বাছাইয়ে ভোট দেবেন প্রায় ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন ভোটার। সকাল ৮টা থেকে ভোট শুরু হবে। তা বিরতি ছাড়াই চলবে বেলা চারটা পর্যন্ত।
ইসি জানিয়েছে, সব কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট নেয়া হবে। কেন্দ্রের নিরাপত্তা ও ভোট কারচুপি রোধে বসানো হয়েছে সিসি ক্যামেরাও। আগারগাঁও নির্বাচন অফিস থেকে সার্বক্ষণিক ভোট পর্যবেক্ষণ করবে ইসি সচিবালয়।
এদিকে গাজীপুর সিটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে ইসি। নির্বাচনী এলাকা নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে সব ধরনের নির্বাচনী প্রচার। প্রার্থী ও ভোটাররা এখন অপেক্ষায় কে হবেন গাজীপুরের নগরপিতা।
ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাত ১২টায় এই সিটি নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচার শেষ হয়েছে। এরপর কোনো ধরনের মিছিল বা প্রচার চালালে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এই নির্বাচনে প্রস্তুতির বিষয়ে ইসি মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সব ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সেখানে সুষ্ঠু ভোটের জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে। প্রার্থীরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছেন। এই পরিবেশ ভোটের দিন এবং ফলাফল ঘোষণার সময় পর্যন্ত বজায় থাকবে। কোনো ভোটার বা এজেন্টকে কোনো রকম বাধা দিলে তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন হবে, সে যেই হোক।
এজেন্টের স্বাক্ষর ছাড়া কোনো ফলাফল শিট গ্রহণ করা হবে না। রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সার্টিফাই করতে হবে কোন পক্ষের এজেন্ট উপস্থিত ছিলেন না।
তিনি বলেন, প্রতিটি বুথে সিসি ক্যামেরা থাকবে। ঢাকায় বসে সিইসিসহ অন্যান্য কমিশনার, কর্মকর্তা এবং সাংবাদিকরা তা পর্যবেক্ষণ করবেন। কোনো অভিযোগ পেলে আইনে যেভাবে অ্যাকশন নেয়ার কথা, সেভাবেই নেয়া হবে। গাইবান্ধায় তো কেবল নির্বাচন বন্ধ করা হয়েছে। এখানে তার চেয়েও কঠিন অ্যাকশন হবে।
বৃহস্পতিবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৭৩ দশমিক ১৩ শতাংশ বা তিন-চতুর্থাংশ ভোটকেন্দ্র অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে পুরো নির্বাচনী এলাকায় থাকছে অতিরিক্ত ফোর্স। শিল্প এলাকা বিধায় গাজীপুর সিটিতে বিভিন্ন ধরনের মানুষের বসবাস। তাই অপরাধ প্রবণতাও বেশি। তবে নির্বাচনী পরিস্থিতি ভালো।
কোনো হুমকি না থাকলেও যেহেতু শিল্প এলাকা, তাই দুষ্কৃতকারীরা বা অসৎ উদ্দেশ্য যাদের থাকে তারা যেন অন্যায় পরিস্থিতি করতে না পারে, তাই অতিরিক্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে তারা দলের বা যে-ই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় আনার জন্য বলা হয়েছে। গাজীপুর সিটি ভোটে মেয়র পদে আটজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এছাড়া ৫৭ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদের জন্য ২৪৬ জন এবং ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের বিপরীতে ৭৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। মেয়র পদের প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম, নৌকা প্রতীকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট মো. আজমত উল্লা খান, লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এমএম নিয়াজ উদ্দিন, হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজী আতাউর রহমান, গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহমেদ।
এছাড়া স্বতন্ত্র থেকে মেয়র পদে টেবিল ঘড়ি প্রতীকে জায়েদা খাতুন (সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা), ঘোড়া প্রতীকে মো. হারুন-অর-রশীদ ও হাতি প্রতীকে সরকার শাহনূর ইসলাম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ইসি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে ভোটগ্রহণ হবে। প্রায় ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এদের মধ্যে পাঁচ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ ভোটার। নারী ভোটার রয়েছেন পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী।
এছাড়া হিজড়া ভোটার সংখ্যা ১৮ জন। মোট ৪৮০টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা হবে। ভোট গ্রহণের জন্য বুথ তৈরি করা হয়েছে ৩ হাজার ৪৯৭টি।
এই সিটি নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আজমত উল্লা খান। ইসির নিবন্ধিত মোট ৫টি দল এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বি বিএনপি ভোট বর্জনের ঘোষণা দেয়ায় তাদের প্রার্থী নেই। স্থানীয় বিএনপি নেতা শাহনূর ইসলাম রনি মেয়র পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। বিএনপি নেতার ভাতিজা এবং বিএনপি সমর্থক হওয়ায় স্থানীয়ভাবে তার বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে।
এ কারণে গাজীপুর সিটিতে তার একটি ভোটব্যাংক রয়েছে।
অন্যদিকে এই সিটির সাবেক মেয়র মো. জাহাঙ্গীরের প্রার্থিতা বাতিল হলেও তার মা জায়েদা খাতুন ভোটে রয়েছেন। গাজীপুরে জাহাঙ্গীরের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ফলে মেয়র পদে জায়েদা খাতুনকে বড় ফ্যাক্টর হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। এই তিন প্রার্থী ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থী ভোটের মাঠে বড় ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করতে পারবে না বলে স্থানীয় ভোটাররা মনে করছেন।
তবে জানা গেছে, বিএনপি ভোট বর্জন করায় এবং ভোট না দেয়ার আহব্বান জানানোয় ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা অনেক কম রয়েছে। বিএনপি সমর্থিত ভোটারদের ভোট নিয়ে আগ্রহ কম দেখা গেছে। এছাড়াও মুল প্রতিদ্বন্দ্বী মাঠে না থাকায় এবারের ভোট নিয়ে মানুষের আগ্রহ অনেক কম রয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে তারা জানান, গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের প্রচুর সমর্থক আছে, তাই নির্বাচনের দিন পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। কারণ, জাহাঙ্গীরের সমর্থকরা নীরবে পর্দার আড়ালে কাজ করছেন। জায়েদা খাতুন (স্বতন্ত্র ও জাহাঙ্গীরের মা) অবশ্যই আজমতের সঙ্গে ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। যেহেতু বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে, তাই ভোটের মূল লড়াই হবে আজমত ও জায়েদার মধ্যে।
স্থানীয়রা জানান, গাজীপুর ক্ষমতাসীন দলের দুর্গ হিসেবে পরিচিত হলেও জাহাঙ্গীরের সমর্থকরা জায়েদার পক্ষে কাজ করছেন। জানা গেছে, অধিকাংশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী প্রকাশ্যে আজমত উল্লার পক্ষে কাজ করছেন। কিন্তু যারা জাহাঙ্গীরের অনুসারী বলে পরিচিত তারা আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে ভোট নাও দিতে পারেন।
এছাড়াও জানা গেছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য হাসান উদ্দিন সরকারের ভাস্তে ও স্বতন্ত্র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম রনি টঙ্গীতে বেশ জনপ্রিয়। ফলে টঙ্গীর ভোট রনির পক্ষে যাওয়ার সম্ভবনা বেশি।
গাজীপুর জেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন বলেন, ইতোমধ্যে কিছু সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বলে নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে।
ভোরের আকাশ/নি