logo
আপডেট : ২৪ মে, ২০২৩ ১৫:১১
নগর স্বাস্থ্য : আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় বাড়াতে পারলে আসবে কাক্সিক্ষত সাফল্য
ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার ও মোহাম্মদ মনরিুল হাসান:

নগর স্বাস্থ্য : আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয় বাড়াতে পারলে আসবে কাক্সিক্ষত সাফল্য

ডা. মো. শামীম হায়দার তালুকদার ও মোহাম্মদ মনরিুল হাসান: বাংলাদেশের সর্বশেষ আদমশুমারি পরিসংখ্যান-২০২২ অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ৩১.৪৯% নগরে বসবাস করে। নগর জনসংখ্যার এই হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ২০৪০ সালে দেশের জনসংখ্যা ২৩ কোটিতে উন্নীত হবে, যার অর্ধেকের বেশি (সাড়ে ১১ কোটি) বাস করবে নগরে।

 

বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যমতে, নগরে ৩.১ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

 

উন্নত শিক্ষার সুযোগ, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানের সুযোগের কারণে মানুষর নগরে অভিগমন বাড়ছে। তা ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক ছিন্নমূল মানুষও শহরমুখী অভিবাসনে বাধ্য হচ্ছে।

 

শহরমুখী অভিবাসনের ফলে বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ন হচ্ছে। জনসংখ্যাবিশারদ ও পরিসংখ্যানবিদদের হিসাব মতে, আগামী ৩০ বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৫০ ভাগ জনগণ শহরে বসবাস করতে শুরু করবে।

 

অনিয়ন্ত্রিতভাবে গ্রাম থেকে নগর স্থানান্তরের ফলে আবাসন, নিরাপদ পানীয় জলের মতো নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়াও সরবরাহ, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন, কর্মসংস্থানের সুযোগ, শিক্ষা এবং অন্যান্য নাগরিক সুবিধাও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়নের প্রক্রিয়ায় নিরাপদ খাবার, পানি ও স্যানিটেশন সুবিধার অভাব এবং ঘনবসতিতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপনের কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী।

 

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবকাঠামো গ্রামীণ পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগ ও রাজধানীকে কেন্দ্র করে তিনটি স্তরে গড়ে উঠেছে। সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। মাধ্যমিক স্তরে রয়েছে মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র, জেলা হাসপাতাল এবং তৃতীয় স্তরে রয়েছে মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত হাসপাতাল ও অতি বিশেষায়িত হাসপাতাল।

 

এ ছাড়াও রয়েছে অগণিত প্রাইভেট হাসপাতাল এবং চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বার। এক্ষেত্রে দেখা যায়, গ্রামে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটা শক্তিশালী কাঠামো রয়েছে। অন্যদিকে নগরে তেমন সরকারি প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা কার্যত অনুপস্থিত।

 

বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সালে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ও ২০০৯ এবং স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন প্রণয়ন করে নগর ও পৌরসভাগুলোকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাদানের দায়িত্ব প্রদান করে। অর্পিত আইনগত দায়িত্ব পালনের জন্য একটি কৌশলপত্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার নগর স্বাস্থ্য কৌশলপত্র প্রণয়ন করে ২০১৪ সালে।

 

এই কৌশলপত্রের মূল লক্ষ্য হলো নগরের স্বাস্থ্যসেবাকে মানসম্মত এবং সাধারণ নগরবাসীর সার্বিক চাহিদার বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো উন্নয়ন, অংশীদারিত্ব জোরদারকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম শক্তিশালীকরণ, আন্তঃমন্ত্রণালয় ও আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয়, ডেটাবেজ উন্নীতকরণ, মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারকরণ, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার উন্নতি সাধন করা।

 

তা ছাড়া ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নগর সেবার যে ৫টি আকাক্সক্ষাকে ব্যক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম টেকসই করা। বর্তমানে রাজধানীসহ সারা দেশের মোট ১২টি সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকার দরিদ্রদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র। সিটি করপোরেশন এলাকাগুলোতে স্বল্পমূল্যে দরিদ্রদের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছে নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো।

 

লাল কার্ডধারীদের জন্য বিনামূল্যে ও সাধারণ মানুষের জন্য মাত্র ৫০ টাকায় মিলছে যেকোনো স্বাস্থ্যসেবা। এই সেবাকেন্দ্রগুলোয় সাধারণত নিরাপদ প্রসব বা সিজার অপারেশন, প্রজনন স্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসেবা, সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ ও সাধারণ রোগ নিরাময়ের সেবাসমূহ প্রদান করা হয়। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর বেশিরভাগই স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।

 

এত বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে নেই কোনো পৃথক স্বাস্থ্য ইউনিট, কারিগরি জ্ঞান, অবকাঠামো বা দক্ষ জনবল। নগর জনস্বাস্থ্য সেবা প্রদানে উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান এডিবি ও অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় (ঋণ) ১৯৯৮ সাল থেকে আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রকল্পটি চলমান। বর্তমানে প্রকল্পটির চতুর্থ ধাপের কাজ চলমান।

 

এই প্রকল্পের প্রথম ধাপে ৬.১৬ মিলিয়ন রোগী, দ্বিতীয় ধাপে ২৬.৫ মিলিয়ন রোগী, তৃতীয় ধাপে ৪৮.৮৯ মিলিয়ন রোগী এবং চতুর্থ ধাপের ১০০.৭৭ মিলিয়ন বা ১ কোটি ৭৭ লাখ (২০২১ সালের নগর জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ) প্রকল্পের স্বাস্থ্যসেবার আওতায় এসেছে। অবশ্য ঋণের অর্থে পরিচালিত এই প্রকল্প থেকে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে দরিদ্র নগরবাসী। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল।

 

যেহেতু একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে নগর স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রগুলোর দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে। তাই নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও তাদের বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখভাল করার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক জনবল, অবকাঠামো ও বিনিয়োগ। বিপুলসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পদোন্নতিসহ তাদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের লক্ষ্যপূরণ ও পেশাগত বিকাশ ঘটানোর সুযোগ ও সক্ষমতা নেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বা সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার।

 

এনজিও ও পৌরসভায় সীমিত সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়, কিন্তু সেখানে স্বাস্থ্যকর্মীরা চাকরির অনিশ্চয়তার জন্য অনেক ক্ষেত্রে কাজে যোগ দিতে চায় না। তা ছাড়া তারা যোগ দিলেও দ্রুতই ছেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশে নগর স্বাস্থ্যের সাথে জড়িত আছে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সহযোগী যারা নগর স্বাস্থ্যে ব্যবস্থাপনায় অর্থায়ন করে থাকে। সরকারি-বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যৌথ কোনো সমন্বয় নেই।

 

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা দেখভালের মূল দায়িত্ব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিন্তু নগরের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ একই কাজের বিষয় হলেও এ সম্পর্কে কিছুই জানে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কখন কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু হচ্ছে বা অনুদানের অভাবে বন্ধ হচ্ছে সেটিও জানে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

 

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব কেন্দ্রকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে অতি দ্রুত যুক্ত করা দরকার। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সাথে মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় না থাকার বিষয়টি সহমত পোষণ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, এই ক্লিনিকগুলোর স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তাই সমন্বয়টাও জরুরি।

 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনগত অসঙ্গতি বা ফাঁক থাকলে তা দূর করে নগরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে একটি সমন্বয় সেল গঠন করা জরুরি। নগর স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো গড়ে তুলতে ও যেকোনো কারিগরি সহায়তা প্রদান করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আরো কার্যকরী ভ‚মিকা পালন করা উচিত।

 

এ ছাড়া সরকারি অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর মতো সার্বক্ষণিক জরুরি সেবা চালু রাখার ব্যবস্থা করা ও নগর স্বাস্থ্যসেবা নির্বিঘ্ন করতে সরকারি অর্থায়ন নিশ্চিত রাখা। নগর স্বাস্থ্যসেবাকে বহুমুখী করতে প্রায় ৮০ ভাগ বেসরকারি পর্যায়ে যেসব উদ্যোক্তা রয়েছে তাদের সরকারের পরিপূরক হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে। সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালার আওতায় এনে এই কার্যক্রমগুলোর সাথে নগরের নাগরিকদের সম্পৃক্ত করা উচিত বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

 

লেখক: এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট কনসালটেন্ট, ইউনিসেফ

অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর, এমিনেন্স অ্যাসোসিয়েটস ফর সোশ্যাল ডেভেলমেন্ট

 

ভোরের আকাশ/নি