চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করেছেন দেলোয়ার জাহান। অনার্সে দ্বিতীয় এবং মাস্টার্সে যৌথভাবে প্রথম হয়েছিলেন তিনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করেছেন এমফিল।
এরপর সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে চাকরির সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানে না গিয়ে দেশে কীভাবে সার ও কীটনাশক প্রয়োগ ছাড়া ফসল উৎপাদন করা যায়, সেই বিষয়ে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করছেন। নিজেও শুরু করেছেন বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনের কাজ।
শিক্ষাজীবন শেষে দীর্ঘ ৮ বছর ঢাকায় দুটি জাতীয় দৈনিকে সাংবাদিকতা করেছেন দেলোয়ার। সেখানেও তার বিষয় ছিল কৃষি ও পরিবেশ। কৃষিকে আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এগ্রো ইকোলজি বিষয়েও কোর্স করেছেন তিনি।
মানিকগঞ্জের ঘিওরের বালিয়াখোড়া ইউনিয়নের কাউটিয়া গ্রামে গড়ে তুলেছেন ‘প্রাকৃতিক কৃষিকেন্দ্র ও প্রাণবৈচিত্র্য খামার’। বিলাসী জীবন ছেড়ে প্রকৃতি ও মানুষ বাঁচাতে দেলোয়ারের এ উদ্যোগ কৃষকদের মাঝেও সাড়া ফেলেছে।
এখন পর্যন্ত মানিকগঞ্জসহ কয়েকটি জেলার অনেক কৃষক বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন করছেন। তাদের উৎপাদিত সবজি, ফল ঢাকায় বিক্রির জন্য মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডে ‘প্রাকৃতিক কৃষি বিপণনকেন্দ্র’ চালুর করা হয়েছে। সপ্তাহের সাত দিনই বিপণন কেন্দ্রটি খোলা থাকে।
সরেজমিন কাউটিয়া গ্রামে কৃষি খামারে দেখা যায়, চারপাশে ফসলের খেত। মাঝে গাছপালা আর লতাপাতায় মোড়ানো একটি বাড়ি। প্রতিটি ঘর কাঠ আর বাঁশ দিয়ে তৈরি। আছে ছনের ছাউনিও। বাড়ির উঠানজুড়ে ছোট-বড় শতাধিক গাছ। সৌরভ ছড়াচ্ছে ফুল।
চারদিকে ঘুঘু, দোয়েলসহ নানা পাখির কিচিরমিচির শব্দ। শুধু সবুজ প্রকৃতির মাঝে খামারবাড়িই গড়ে তোলেননি দেলোয়ার, তার খামারে উৎপাদিত সবজিসহ প্রতিটি ফসল কীটনাশক ও রাসায়নিক সারমুক্ত।
নিজেদের জীবনযাপনও প্রাকৃতিক। খামারে বিদ্যুতের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় সোলার প্যানেল। সংসারের তৈজসপত্র সবই মাটির তৈরি। মাটির পাত্রেই খাওয়া-দাওয়া। কোনো অতিথি এলে তাদেরও মাটির পাত্রেই খাবার পরিবেশন করা হয়। দেলোয়ারের খামারে লালন-পালন করা গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগিও বড় হচ্ছে প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে। জমির ফসল ফলান প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে।
দেলোয়ারের খামারে আছে মাছ ও কবুতর। এগুলো সবই প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে বড় হচ্ছে। ধান, পাট, সবজিসহ নানা ফসল উৎপাদনে কোনো কীটনাশক এবং রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন না তিনি। দেলোয়ারের এ প্রাণবৈচিত্র্য খামার দেখতে প্রায় প্রতিদিনই ভিড় করে মানুষ।
মাটির মায়া ও ফসলের টান কৃষক, কৃষিবিদ ও গবেষক দেলোয়ার জাহানকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। এদেশে পড়াশোনার মানে যখন উচ্চবিলাসী স্বপ্ন, করপোরেট চাকরি, ব্যবসা, তখন দেলোয়ার জাহান দেশের স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেও কৃষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন।
গরিব কৃষকের পাশে দাঁড়িয়ে শোষণ-বঞ্চনা থেকে পরিত্রাণের স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্ন দেখেছেন, কীভাবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়া শস্য উৎপাদন করা যায়, স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে কীভাবে কৃষি উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা যায়।
সাংবাদিকতায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেও কৃষিকাজ কেন এমন প্রশ্নের উত্তরে দেলোয়ার জাহান বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে একটা প্রাকৃতিক জীবনে ফিরতে চেয়েছি। কৃষকের কৃষিকাজে বিভিন্ন সংকট, দুর্বিপাক, ঝামেলা এগুলো আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি এবং এগুলোর মধ্যে আমার বেড়ে ওঠা।
দেলোয়ার জানান, ভাবনাটা ২০০৪ সাল থেকে হলেও মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করেন ২০১২ সালে। মানিকগঞ্জের কাউটিয়া গ্রামে নিজের কেনা ২ বিঘা জমি নিয়ে গড়ে তোলেন খামারবাড়ি। স্থানীয়দের কাছ থেকে লিজ নিয়ে ১৪ বিঘা জমিতে নানা ধরনের ফসলের চাষাবাদ করছেন।
তিনি বলেন, আধুনিক চাষাবাদের নামে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে হুমকির মুখে ফেলা হচ্ছে। পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণের জন্য কীটনাশকের প্রয়োজন নেই। বিভিন্ন পোকা, ছত্রাক, অণুজীব আছে যেগুলো ক্ষতিকর পোকামাকড়কে মেরে ফেলতে পারে। এক্ষেত্রে বড় উপকারে আসে ব্যাঙ, পাখিও।
ভোরের আকাশ/নি