logo
আপডেট : ২৯ মে, ২০২৩ ১১:০৩
দেশে দুই দশকে মাতৃমৃত্যু কমেছে ৭২ শতাংশ  
মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

দেশে দুই দশকে মাতৃমৃত্যু কমেছে ৭২ শতাংশ  

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: এক সময় সন্তান জন্মদিতে গিয়ে অকালে প্রাণ দিতে হত অনেক মাকে। কখনো মায়ের সঙ্গে সন্তানেরও মৃত্যু হত আবার সন্তান বেঁচে থাকলে তাকে বেড়ে ওঠতে হত মায়ের আদর ভালোবাসা ছাড়া।

 

মূলত শিক্ষার অভাব, কুসংস্কার এবং বাড়িতে ধাত্রী দিয়ে ডেলিভারি করানোর কারণেই এমন ঘটনা ঘটত। এর পর কীভাবে মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা যায় তার ওপর জোর দেয়া হয়।

 

ফলে ধীরে ধীরে কমে আসে মাতৃমৃত্যুর হার। জন সচেতনতা বাড়ানোর জন্য প্রতি বছর ২৮ মে পালন করা হয় নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু হার কমানো ও নবজাতকের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই প্রতি বছর ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালিত হয়ে আসছে। গর্ভকালীন, প্রসবকালীন ও প্রসব পরবর্তী সময়ে সব নারীর জন্য নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণই হল নিরাপদ মাতৃত্ব।

 

এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘গর্ভকালে চারবার সেবা গ্রহণ করি; নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করি’। প্রতি বছরের মতো এবারো রোববার বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে দিবসটি পালিত হয়ে গেল।

 

জানা যায়, গত দুই দশকে মাতৃমৃত্যু কমেছে ৭২ শতাংশ। তবে আরো কমিয়ে আনতে চায় সরকার। হাসপাতালে সম্পূর্ণ বিনা খরচে অভিজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সদের সহায়তায় অনেক নরমাল ডেলিভারি করা হচ্ছে এবং সরকারিভাবে তাদের বিভিন্ন উপহারসামগ্রীও দেয়া হচ্ছে।

 

তারপরও অসচেতনভাবে অনেকেই বাড়িতে বাচ্চা প্রসব করানোর চেষ্টা করাতে গিয়ে এ ধরনের দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

 

দেশের মাতৃমৃত্যু হারের কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষরণে ৩১ শতাংশ, একলামশিয়া ২৪ শতাংশ, পরোক্ষ কারণে ২০ শতাংশ, অনির্ধারিত কারণে ৮ শতাংশ, গর্ভপাত জটিলতায় ৭ শতাংশ, অন্য কারণে ৭ শতাংশ এবং অমানসিক শ্রমে ৩ শতাংশ মৃত্যু হয়।

 

অবস্টেট্রিকাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা বলেন, মাতৃমৃত্যুর ৩০ শতাংশই হয় প্রসব উত্তর রক্তক্ষরণ। ২৪ শতাংশ হয় গর্ভাবস্থায় উচ্চরক্তচাপ, বাকিগুলো গর্ভকালীন সংক্রমণ ও বিভিন্ন ইনফেকশনের কারণে হয়ে থাকে।

 

তিনি বলেন, আমাদের দেশে এখনো গর্ভকালীন পরিচর্যা ভালো করে নেয়া হয় না। গর্ভাবস্থায় মায়েদের এন্টিনেটাল চেকআপ খুবই জরুরি। কিন্তু আমাদের ৪৭ ভাগ মায়েরা চারটি এন্টিনেটাল চেকআপ নেয়, বাকিগুলো নিতে যে হবে, সেটিও জানে না। একই সঙ্গে হসপিটাল ডেলিভারি বাড়াতে হবে, ডেলিভারির পরে যে কেয়ার নেয়া হয়, সেটিও বাড়াতে হবে।

 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালের ২৮ মেকে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস ঘোষণা করেন। ১৯৯৮ সাল থেকে দেশব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ৩০ লাখ ৮৮ হাজার জীবিত শিশুর জন্ম হয়েছিল।

 

আর সরকারের ২০১৬ সালের মাতৃস্বাস্থ্য জরিপ বলছে, দেশে ১ লাখ শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১৯৬ জন মায়ের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমান সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রসূতি মায়ের দক্ষ সেবা নিশ্চিত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৭০ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। বর্তমানে প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যু ১৬৫ জন এবং বিগত ১০ বছরে প্রতি লাখে তা ৯৪ জন কমেছে।

 

‘মাতৃমৃত্যুর প্রবণতা: ২০০০ থেকে ২০২০ সাল’ শীর্ষক  বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ, বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের যৌথ প্রতিবেদনে মাতৃমৃত্যুর প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়, ২০ বছরে দেশে মাতৃমৃত্যু ৭২ শতাংশ কমেছে।

 

এরপরও প্রতিদিন সন্তান জন্মদানজনিত জটিলতায় ১০ মায়ের মৃত্যু হচ্ছে।

 

প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সালের হিসাবে ১ লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ১২৩ মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। দুই দশক আগে, অর্থাৎ ২০০০ সালে এ হার ছিল ৪৪১। বছরে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু ৬.৫ শতাংশ হারে কমছে।

 

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সরকারি হাসপাতালে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ডেলিভারি করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি আমাদের আরো বাড়াতে হবে। তাহলে শিশু ও মাতৃমৃত্যু কমে যাবে।

 

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা) ডা. মো. মাহামুদুর রহমান বলেন, গত বছরে শতকরা ৫০ ভাগ ডেলিভারি হতো বাড়িতে। এখন সেটা ৩৫ শতাংশ হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি বাড়িতে প্রসব যেন না হয়। কারণ বাড়িতে প্রসব হলে পরবর্তী সময়ে রক্তপাতসহ বেশ কিছু জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।

 

এ জন্য আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি বাড়িতে যেন কোনো ডেলিভারি না হয়। আর এটা করতে পারলে ২০৩০ সালের মধ্যে এক লাখে মৃত্যু ৭০-এর নিচে নামিয়ে আনতে পারবো।

 

গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন জটিলতার কারণে বিশ্বে প্রতিদিন ৮৩০ নারীর মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ৯৯ শতাংশের মৃত্যু ঘটে উন্নয়নশীল দেশে। ১৯৮৭ সালে কেনিয়ায় নাইরোবি কনফারেন্স এই নিরাপদ মাতৃত্বের ঘোষণা করা হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ২০০০ সালের দিকে ৫০ শতাংশ মাতৃমৃত্যু কমানো।

 

ভোরের আকাশ/নি