logo
আপডেট : ৩০ মে, ২০২৩ ১৩:০৪
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের তাগাদায় তিন দলেই আলোচনা
এম সাইফুল ইসলাম

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের তাগাদায়  তিন দলেই আলোচনা

এম সাইফুল ইসলাম: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে দেশের তিন প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে সমাধানের পথ খুঁজে বের করার তাগিদ দিয়েছে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের হাইকমিকশন। সুষ্ঠু ভোটের ব্যাপারে ভিসানীতি ঘোষণার পর গত বৃহস্পতিবার দল তিনটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে এমন তাগিদ দেশটির রাষ্ট্রদূতের। দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনার পর ইতিবাচক খবর জানার জন্য তিনি অপেক্ষায় থাকবেন বলেও জানা গেছে। বৈঠক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তার ওই তাগাদার পর তিন দলের নেতারা অনড় অবস্থানে থেকে ভিসানীতি নিজেদের পক্ষে দাবি করে বক্তব্য দিলেও বিষয়টি দলে আলোচনায় স্থান পেয়েছে।

 

বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা বলছেন, ঘোষিত ভিসানীতি নিয়ে প্রতিনিধিত্বকারী দলের পক্ষে মতামত তারা বৈঠকে তুলে ধরেছেন। বৈঠকে বেশিরভাগ সদস্য এ নীতি দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনে সহায়তা হবে বলেও জানিয়েছেন। আর সুষ্ঠু নির্বাচনে দলগুলোর মধ্যে আলোচনা করে সৃষ্ট বিরোধ নিরসনে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের তাগিদের বিষয়ে তারা কৌশলী উত্তর দিয়েছেন।

 

গত ২৪ মে বুধবার রাতে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধাদানকারীদের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিংকেন এক টুইট বার্তায় ওই ঘোষণা দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেছিলেন, নতুন নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যেকোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে। পরে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের কয়েকটি ধারা অনুযায়ী এই ভিসানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এই বার্তা দেয়া হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে এবং এক্ষেত্রে তারা পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।

 

মার্কিন দপ্তরের ভাষ্যানুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র সর্বত্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থন করে। নতুন এই ভিসানীতি বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বর্তমান বা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, সরকার সমর্থক এবং বিরোধীদলীয় সদস্যরা এর অন্তর্ভুক্ত। এমনকি নির্বাচনে বাধাদানকারীর পরিবারের নিকটতম সদস্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত।

 

কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল নয় বরং দলমত নির্বিশেষে নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় এমন কর্মকাণ্ডে জড়িত যেকোনো ব্যক্তি এই বিধিনিষেধের আওতাধীন। নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ নীতি প্রযোজ্য।

 

ওই নীতি ঘোষণার পরদিন অর্থাৎ গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে তার বাসায় একই টেবিলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা বসেন। আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ এ আরাফাত, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, প্রেসিডিয়াম সদস্য মেজর (অব.) রানা মোহাম্মদ সোহেল ওই বৈঠকে অংশ নেন।

 

কী আলোচনা হয়েছিল ওই বৈঠকে- এ নিয়ে গণমাধ্যমে দলটির নেতারা যে যার মতো কথা বলেছিলেন। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেছিলেন, বৈঠকে নতুন মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ভিসানীতি কোনো দল, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নয়। যারাই নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধা দেবে এবং সহিংসতা করবে, তাদের বিরুদ্ধে এটি কার্যকর হবে। কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করতে পারবে বলেও রাষ্ট্রদূত তাদের জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরপেক্ষ নির্বাচন চান। তিনিও জ¦ালাওপোড়াও চান না। তার এই চাওয়াটা মার্কিন ভিসানীতির ফলে সহজ হয়েছে।

 

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত ভিসানীতিকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, এই নীতি ক্ষমতাসীনদের ভোট কারচুপির বিরুদ্ধে বড় ধরনের ‘সিগন্যাল’। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এ সিদ্ধান্ত এসেছে। আমরা এটাকে স্বাগত জানিয়েছি।

 

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছিলেন, মার্কিন সরকার বাংলাদেশের জন্য যে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত জানতে চেয়েছে। প্রতিটি দলই তাদের মতামত দিয়েছে। নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একদল আরেক দল সম্পর্কে বলেছে।

 

তবে, ওই বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত আসলে কী বলতে চেয়েছেন, সে বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে দৈনিক ভোরের আকাশ। বৈঠক সূত্র বলছে, ‘বৈঠকে অনেক বিষয়ে আলোচনা হলেও মূলত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাপাকে নির্বাচনকালীন সংকট কীভাবে সমাধান করা যায়, তার পথ খুঁজে বের করতে বলেন। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে চলমান সংকট নিরসনে তিনি দলগুলোর মধ্যে আলাচনার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে তিনি নিজেদের মধ্যে (রাজনৈতিক দলসমূহ) আলোচনা করে সমাধানের দিকে গিয়ে একটি ইতিবাচক অগ্রগতির খবর জানার অপেক্ষায় থাকবেন বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।’

 

তার এই আশাবাদ নিয়ে দল তিনটিতে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা তা জানার চেষ্টা করে ভোরের আকাশ। জানা গেছে, মার্কিন ভিসানীতি ও গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠকের পর তিন দলেই হিসাব কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। দলের নেতারা সভা-সমাবেশে যার যার অবস্থানে অনড় অবস্থানে বক্তব্য দিলেও সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষ্যে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেছেন।

 

একাধিক সূত্র বলছে, ভিসানীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়ার বিষয় নিয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা আলোচনা করছেন। ইতোমধ্যে দলটিতে সহিংসতামুক্ত কর্মসূচি পালন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া যদি নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে ক্ষসতাসীনরা আলোচনা করতে চায়, সেক্ষেত্রে বিএনপির ভূমিকা কী হবে তা নিয়েও দলীয় ফোরামে আলোচনা হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের পদত্যাগের আগে কোনো আলোচনা নয়Ñ এমন অবস্থানে অনড়, না সমাধানের লক্ষ্যে আলোচনার টেবিলে যাওয়া উচিতÑ তা নিয়েও হিসাব-নিকাশ চলছে। যদিও বিএনপি নেতারা ভিন্ন কথা বলছেন।

 

বিষয়টি নিয়ে জাতীয় পার্টিও ভাবতে শুরু করেছে। দলটিতে এখন চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দলটির নেতারা কী প্রস্তাব করতে পারেন, তা নিয়ে ভাবনা চলছে। বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে তাদের মাঝেও অসন্তোষ রয়েছে।

 

এদিকে, মুখে দলের নেতারা নানা কথা বললেও আওয়ামী লীগও নিরপেক্ষ নির্বাচনে সংবিধানের মধ্যে থেকে ছাড় দিয়ে সব দলকে কীভাবে নির্বাচনে আনা যায়, সে চেষ্টা করছে বলেও নানা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।

 

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল ভোরের আকাশকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চান সবাইকে নিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে। এটি যে শুধু মার্কিনিদের চাওয়া অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী চান তা নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি আগের থেকে এখন আলোচনায় বেশি প্রধান্য পাচ্ছে।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলটির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ভোরের আকাশকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশে নিরপেক্ষ ও প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়, সেটিই ভিসানীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। এদেশে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে সে দেশের চাওয়া ও বিএনপির চাওয়া এক। সেটি হলো একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন। যার জন্য প্রয়োজন নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। নতুন ভিসানীতি ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত দলগুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনার যে তাগিদ দিয়েছেনÑ সে ব্যাপারে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে সরকারকেই আগে ভাবতে হবে। পরে বিএনপি ভেবে দেখবে।

 

আর জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুম আমিন হওলাদার ভোরের আকাশকে বলেন, আমাদের চেয়ারম্যান এখন উত্তরবঙ্গ সফরে আছেন। তিনি দু-এক দিকে মধ্যে ঢাকায় এলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।

 

 ভোরের আকাশ/আসা