logo
আপডেট : ৩১ মে, ২০২৩ ১৩:১৪
আওয়ামী লীগের কাছেই রাজনীতি নিরাপদ
মনি খন্দকার

আওয়ামী লীগের কাছেই রাজনীতি নিরাপদ

প্রাত্যহিক জীবনে আমরা চারপাশে বিদ্যমান পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে চলতে চেষ্টা করি। পরিবেশ কী বা কেমন তা জীব-প্রাণে জড়িয়ে থাকা আদি-অন্ত এক অধ্যায়। সমাজে বাস উপযোগী পরিবেশ কীভাবে থাকে, তা নিয়ে বিস্তর কথা হয়। আমাদের প্রকৃতি বা প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় আমরা কোথায় কোন পর্যায়ে থাকি, কারা সে পরিবেশ রক্ষা করেন, আর কারা করেন না, আমরা তা দেখি।

 

মনে করি একজন রাজনৈতিক কর্মীর পক্ষে সব পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা, পরিস্থিতি সুরক্ষায় দেশপ্রেম ও মানবপ্রীতিই মূল কথা, যা ক্রমান্বয়ে হুমকির মুখে পড়ছে। এর হেতু অনেক।

 

আমরা দেখি, সমাজের নানা অসঙ্গতি দূর করার যত দর্শন-তত্ত্ব, রাজনৈতিক দল, সরকার-ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা, পদ্ধতি বাস্তবায়ন, সমাজ-মনস্ক মানুষ, গুণীজন, কত কত সংগঠনও সেই লক্ষ্যে কাজ করে। আবার কোথাও মত-পথ-স্বার্থের দ্বন্দ্বে হারিয়ে যায় কত কী! দেখি বিশ্বের দেশে দেশে রাজনীতি, রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিচয়-পরিচিতির সংকট, ক্ষমতার পালাবদলের নানা নতুন নতুন সংজ্ঞা, সমীকরণ ও অবস্থান। বাংলাদেশ-ভারতসহ উপমহাদেশের অনেক দেশে পুরোনো অনেক দলের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন, কোথাও কোথাও বিলীনও।

 

বর্তমান সময়ে দেশে দুটি ‘দলীয়’ ধারা দৃশ্যমান। তার একটির নেতৃত্বে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ, অপরটি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগবিরোধী পক্ষ। একই দেশে দুটি ধারা বেশ প্রবলভাবে বিরাজ করছে। একটি ধারা সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতির ভাষার সংগ্রাম-লড়াই ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব এবং তার ভাষা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি বিকাশ ও প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক নেতৃত্বের কথা বলে। অপর ধারাটি বাঙালি জাতিসত্তা, মূল্যবোধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির আশ্রয় গ্রহণ করে, যা ইতিহাস-সমর্থিত নয়।

 

তাদের তেমন বিভ্রান্তিকর অবস্থান রাষ্ট্রচিন্তা-রাষ্ট্রদর্শন গড়ে ওঠার অন্তরায় এবং তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সমাজে এটি স্বাভাবিক নয়। এখানে মনে পড়ে এক. স্বাধীনতার পর ‘বিভ্রান্ত’ জাসদ গণবাহিনীর উত্থান ও তথাকথিত সমাজতন্ত্রীদের ছত্রছায়ায় স্বাধীনতাবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের আশ্রয় লাভের কথা এবং তাদের অবলম্বন ও পুনরুত্থানের পথ খুঁজে পায় সেখান থেকেই।

 

দুই. পঁচাত্তর-পরবর্তী পর্বে ও নানা সময় সামরিক শাসন এবং তার গর্ভে জন্ম নেয়া ‘শাসকের দল’-এ ‘বিকাশ’ ঘটে রাজনীতিবিমুখ, বিচ্যুত, সুবিধাবাদী সহ দলছুটদের; সেখানে অনেক বিত্তশালী, পতিত সামরিক-বেসামরিক আমলা ও ডক্টরেটধারীদের পাওয়া যায়।

 

১৯৪৭-এর পর বাংলা ভাষায় কথা বলার অধিকার ও অন্যান্য বিষয়ে জাতির মোহ এবং বিশ্বাস ভঙ্গ হয়; অবিস্মরণীয় প্রতিবাদ-আন্দোলনের পথ ধরে স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের উত্তাল দাবিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার সুমহান নেতৃত্বে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তিনি একাত্তরের ২৬ মার্চ দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তার অনুপস্থিতিতে তারই নেতৃত্বে ‘জয় বাংলা ধ্বনি’র মধ্যে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করে ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিলে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার।

 

স্বাধীনতা-উত্তর সংঘাতময় বৈরী বিশ্ব পরিস্থিতির মুখে যুদ্ধবিধ্বস্ত বিপর্যস্ত অর্থনীতি ও জনজীবন স্বাভাবিক- পুনর্গঠনের কর্মযজ্ঞে বঙ্গবন্ধু নিজেকে নিমগ্ন করেন। মাত্র সাড়ে ৩ বছর সময়কালে বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক মুক্তি ও অর্থবহ স্বাধীনতা নিশ্চিতে বিশ্বরাজনীতির আলোকে তার রাজনৈতিক দর্শন এবং প্রজ্ঞায় দেশকে অগ্রসর করেন।

 

এ সময় বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ ও তার এ দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। পাঠকমাত্রই আমাদের এ কথাগুলো তো অবগত মনে করি। মনে আছে কিনা, হত্যা-ক্যু, অত্যাচার-নিপীড়ন, সন্ত্রাসী আগ্রাসন, আওয়ামী লীগ ও স্বৈরাচারবিরোধী কর্মী, সংখ্যালঘু ও মুক্তিযোদ্ধা নিধনের সেই রাষ্ট্রাচার, রক্তাক্ত জনপদের কথা।

 

সেই সঙ্গে প্রকাশ্যে গোলাগুলি, বোমা হামলা ও দেশব্যাপী জঙ্গিদের উত্থানের সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির কথা। স্মরণ করুন- বিদ্যুতের অভাবে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমাদের হাপিত্যেশ করা জীবনের কথা। এখন তেমন নেই। বর্তমানে যাতায়াত ব্যবস্থা আধুনিক ও তথ্যপ্রযুক্তি যোগাযোগে অবিস্মরণীয় বিশ্বমাত্রায় যুক্ত হয়েছে দেশ।

 

অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নানান ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সূচকে দেশের কল্পনাতীত উন্নয়ন আজ বাস্তবতায় দৃশ্যমান। সরকারের সময়োচিত, যথোপযুক্ত ও দ্রুত পদক্ষেপে করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক, মরণথাবা ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হয়। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব এখন টালমাটাল। অর্থনৈতিক মন্দায় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে।

 

উন্নত বিশ্বের দেশে দেশে আজ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহে ভয়াবহ সংকটের কথা আমরা জানতে পারি। বাংলাদেশে সে রকম সংকট হয়নি। তবে স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের টিকে থাকার লড়াই দীর্ঘতর হচ্ছে।

 

দেখা যায়, গত কয়েক যুগে অবক্ষয় আর অনৈতিকতায় দিন দিন মানবকল্যাণমুখী সংস্কৃতিজাত রাজনীতি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়। তাই রাজনীতির বিশ্বস্ত বাহন বলে চলমান বিশ্ব সময়ে কোথাও তেমন কি কিছু দেখা যায়? কিন্তু বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী আওয়ামী লীগের ওপর ভরসা রাখার গাণিতিক সাক্ষ্য-প্রমাণ দেয় বারবার।

 

আমরা দেখেছি, আবহমান বাংলার সব প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সব উৎস থেকে জন্ম নেয়া কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ভাষা আর বাঙালি মানসের প্রতিনিধি ও তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক দার্শনিক শেখ মুজিবকে চিরবিদায় দেয়ার প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের অবস্থান। মিলিয়ে দেখুন, একাত্তরের ২৫ মার্চ, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বা একইসূত্রে ২১ আগস্ট ২০০৪-এর গণহত্যা ও নারকীয় হামলার ঘটনাসমূহ বাঙালির ইতিহাস মুছে ফেলার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা বৈ-আর-কিছু নয়।

 

আজো সেই পরাজিত প্রতিহিংসাপরায়ণ গোষ্ঠী সক্রিয় বলে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক উৎসের উত্তরসূরি শেখ হাসিনার জীবন-প্রাণ হুমকির মধ্যে থাকে। কিন্তু বোধোদয় হয় না যে, ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠীর যখন উত্থান হয় তখন দেশ-জাতি-ইতিহাসের কী হাল হয়। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, আমরা বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছি।

 

তাকে হারিয়ে বাঙালি জাতির কী ক্ষতি হয়েছে- সেসব আলোচনা বা মূল্যায়ন কখনো কখনো কেন্দ্র, জেলা, উপজেলা বা বিভিন্ন স্তরে অনেকটাই দিবসভিত্তিক বা দায়সারা গোছের আয়োজন ও কথাবার্তায় শোনা যায়। দেশের সব ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও সেসব জানা যায়। গত কয়েক যুগে আওয়ামী লীগ সভাপতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের মধ্যে অন্যতম বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রভাবে ভূরাজনীতিতে তার অনন্য অবস্থান নির্দেশ করে।

 

বঙ্গবন্ধুর বাণী, নানান সময় তার ভাষণ অথবা শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক আলোচনা-নির্দেশনা অনুসরণ কারা করেন? তাদের তেমন করে দেখা যায় না যে! সংগঠন বা দল এ সময় রাজনীতিনির্ভর যদি না হয় তো হোক, কিন্তু এটি ন্যূনতম জনবান্ধব ও জনস্বার্থের অনুকূলে থাকবে তো। সংগঠন কর্মীবান্ধব ও সমর্থকদের আশ্রয়স্থল হয় না। এখানে ছোট্ট করে কিছু কথা তুলে ধরি: পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রথম সামরিক শাসক হিসেবে জেনারেল জিয়া একটি দল গঠন করেন, যে দলটির আন্দোলন-সংগ্রাম-লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত নেই।

 

মনে পড়ে, সেদিন সরকার বা দেশ চালানোর জন্য ওই ব্যক্তির ইচ্ছায় উপদেষ্টা, মন্ত্রী, এমপির জন্ম হয়। ফলে দেশের সামনে অখ্যাত-কুখ্যাত মানুষেরা নেতা বনেছেন। আমরা আজ যে সর্বগ্রাসী প্যানা-বিলবোর্ড-ব্যানার ‘কালচার’ দেখি তার উৎপত্তি বা যাত্রা তখন থেকে। ওই সব অচেনা লোকেরা নিজেদের সেসব প্রচার মাধ্যমে নিজেদের জাহির করে। সেখানে সর্বোচ্চ, মাঝারি বা প্রয়োজন মতো নেতা-নেত্রীর সঙ্গে ছবি ছাপিয়ে নিজেকে বড় করে ওই সব প্রচারে দেখানো যে, সেও কত বড় একজন! সময় যায় সময়ের মতো করে।

 

কোথাকার মানুষ কোথায় যায়, কোথায় পৌঁছায়। চেয়ারে থাকা বা চেয়ারে আসা মানুষের অনেকে ভাবেন না- তারা ওখানে আসার বা বসার যোগ্যতা রাখেন কিনা! পদপদবিতে আসীনদের অনেক ক্ষেত্রে বাছ-বিচার বা মূল্যায়নও হয় গতানুগতিক বা অবৈজ্ঞানিক ধারা অনুসরণে। সেখানে প্রায়ই ব্যক্তির বর্তমান ঢ়বৎভড়ৎসধহপব বেশি গুরুত্ব পায়।

 

তার পূর্বের অবস্থান, অবদান বা ভ‚মিকা খতিয়ে দেখা আরো বেশি যে জরুরি তার নির্যাস পাওয়া যায় না। তাহলে হয়তো শপথগ্রহণকারীদের মতো অনেকের পাশাপাশি পদপদবিতে অধিষ্ঠিত ওই মানুষ সতর্ক থেকে অর্পিত কাজ ও দায়িত্ব পালন করে। সময় যে অন্তহীন নয়, সে কথাটিও বুঝতে পারে।

 

দেশের নানামুখী শিক্ষা ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয়, অশিক্ষা-কুশিক্ষা, মাদক ও ভেজালে জীব-প্রাণনাশী উপস্থিতি এবং সেসব প্রতিকারে দীর্ঘসূত্রতা ও সংকোচন পরিবেশ সত্তে¡ও ‘প্রকৃত মানুষ’ গড়ে উঠবার তেমন পরিবেশের অপেক্ষায় আমরা। অতএব দলীয় বৃত্তের ভেতরে ও বাইরে সব মানুষের উত্তরণের পথ খুঁজতে হয়।

 

রাজনীতির দুর্বল আবহে পশ্চাৎমুখী ঔপনিবেশিক ধারায় বর্তমান ডিজিটাল সময়ে ছদ্মবেশী রাজনীতিক, ওই সুশীল ও কুশীলবদের পিছুটান এবং কাক্সিক্ষত সুবাতাস প্রবাহে সুর, তাল, লয় ও ছন্দ এখনো যে উপস্থিত তা সময়ই বলে দেয়।

 

একমাত্র আওয়ামী লীগেরই আছে দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত লড়াইয়ের ইতিহাস। এই ইতিহাসের কারিগর বাঙালি জাতি ও রাষ্ট্রের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিবীয় দর্শনের সঙ্গে মিলিত হয় মুক্তির পথ প্রয়াস এই মুক্তি দেশমুক্তি, এই মুক্তিই ‘আমার স্বাধীনতা’।

 

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও কলাম লেখক।

 

ভোরের আকাশ/নি