লালমনিরহাটে চলছে মৌসুমি ফল লিচু বাজারজাত করণের উৎসব। প্রকৃতির বৈরী আবহাওয়ায় এ বছর লিচুর ফলন তুলনামুলক কম হয়েছে। তবে কম ফলনেও ভালো দাম পেয়ে খুশি চাষিরা। মৌসুম শুরুর দিকে চাষিদের খানিকটা আক্ষেপ থাকলেও বাজারের চাহিদা ও দাম এখন খুশির কারণ হয়ে ওঠেছে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, জেলায় দেশি প্রজাতির লিচু বাজারে এসেছে দুই তিন সপ্তাহ আগেই। এখন উন্নত বোম্বে ও চায়না-থ্রি জাতের লিচু নামানো হচ্ছে।
কৃষকদের লিচুর বাগানগুলোর গাছে গাছে ঝুলছে রঙিন লিচুর থোকা। বাগান থেকে লিচু পেড়ে তা ঝুড়িতে সাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জেলা শহরের বিভিন্ন পাইকারি বাজারে। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ব্যবসায়ীরা ট্রাকে করে লিচু নিয়ে যাচ্ছেন নিজ নিজ এলাকায়। অনেক ফল ব্যবসায়ী লিচু বাগানে গিয়ে পছন্দ মতো লিচু কিনছেন। সবকিছু মিলিয়ে জেলায় এখন তৈরি হয়েছে উৎসবের আমেজ।
লালমনিরহাটে এখনো পুরোপুরি বাণিজ্যিকভাবে লিচুর চাষ শুরু না হলেও অনেক ফল চাষিই ব্যক্তি উদ্যোগে বড় বড় লিচু বাগান করেছেন। এছাড়াও কিছু মানুষ বাড়ির আঙিনায় লিচুর চাষ করেছেন। অন্য ফল-ফসলের তুলনায় লিচুতে বেশি লাভ ও একই সঙ্গে অর্থ পাওয়া যায় যা চাষিকে সমৃদ্ধ হতে সহায়তা করে। ফলে প্রতিবছর লিচু চাষির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমানে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বাউরা, কুচলিবাড়ি, হাতীবান্ধা উপজেলার ভেলাগুড়ি, জাওরানি, বাগদিরবাজার, ফকিরপাড়া, কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুর, দলগ্রাম, বলাইরহাট চাঁপারহাট, লোহাকুচি, শিয়ালখাওয়া, আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ি, পলাশী, নামুরী, কমলাবাড়ি, সাপ্টিবাাড়ি এলাকায় প্রচুর পরিমাণে লিচুর আবাদ হচ্ছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার ফুলগাছ, দুরাকুটি এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে লিচুগাছ ও বাগান।
সদর উপজেলার ফুলগাছ এলাকার লিচু চাষিরা বলেন, প্রকৃতির বৈরী আবহাওয়ার কারণে গত বছরের তুলনায় এবার লিচুর উৎপাদন কিছুটা কম। তারপরেও লিচু ভাঙার শুরু থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পাইকাররা বাগানগুলোতে আগেভাগে এসে পুরো লিচু বাগান কিনে নিচ্ছেন। চাহিদার তুলনায় ফলন কম থাকার কারণে ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে।
ঢাকা থেকে লালমনিরহাটে আসা লিচু ব্যবসায়ী হোসেন আলী জানান, এ বছর প্রতি হাজার লিচু বাগান থেকেই তিন হাজার থেকে ৪ হাজার টাকায় কিনতে হয়েছে তাকে। এর পাশাপাশি শ্রমিকের খরচ ও পরিবহন খরচ মিলিয়ে ঢাকার পাইকারি বাজারে লিচু পৌঁছাতে প্রতি হাজার লিচুতে খরচ পড়ছে ৫ হাজার সাড়ে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
ফলে ঢাকার বাজারে ৫ হাজার টাকার ওপরে ভালো লিচু বিক্রয় হচ্ছে। এর আগের বছর একই লিচু বাগান থেকে ১ হাজার ২০০ থেকে দেড় হাজার টাকার মধ্যে কিনেছিলেন বলে জানান তিনি।
অপর এক ব্যবসায়ী হামিদুল ইসলাম বলেন, ২/৩দিন থেকে বাগানে বাগানে হাইব্রিড প্রাজাতির বোম্বে ও চায়না-থ্রি লিচু ভাঙা শুরু হয়েছে। আগামী ১ থেকে ২ সপ্তাহের মধ্যে সব জাতের লিচু বাজারে চলে আসবে।
লিচু চাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, সাধারণত তিন জাতের লিচুর ফলন ভালো হয়। এগুলো হলো মোজাফফর বা দেশি লিচু, বোম্বাই ও চায়না-৩। এ ছাড়া কদমী, কাঁঠালী, বেদানা, চায়না-১ ও চায়না-২ জাতের লিচু চাষ হয়ে থাকে এখানে।
সবার আগে বাজারে আসে মোজাফফর বা দেশি লিচু। বোম্বাই ও চায়না-৩ লিচু কিছুদিন পরে পাকলেও বাজারে এর কদর বেশি। বিক্রিও হয় বেশি দামে। চায়না লিচু দেশি লিচুর মতো দেখতে হলেও আকারে ছোট হয়। খেতেও সুস্বাদু।
দুরাকুটি এলাকার আরেক লিচু চাষি সাহাবুল আলম জানান, এ বছর তার বাগানের ৭৫টি লিচু গাছের মধ্যে ৩০ থেকে ৪০টি গাছে ভালো ফলন হয়েছে। লিচুর মুকুল আসার সময় অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বৃদ্ধির সময় বৃষ্টির অভাবে কাক্সিক্ষত ফলন পাওয়া যায়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তবে ভালো দাম পাওয়ায় সেই ক্ষতি অনেকটা পুষিয়ে গেছে বলে জানান তিনি।
লালমনিরহাট জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র মিশনমোড়ে হাফিজুল নামে এক খুচরা ফল ব্যবসায়ী বলেন, লিচুর মৌসুম খুব ছোট। রসাল এই ফলের প্রতি মানুষের আগ্রহও বেশি। তাই দাম বেশি হলেও ক্রেতার অভাব হচ্ছে না বলে জানান।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর লালমনিরহাটের উপপরিচালক হামিদুর রহমান বলছেন, ধারণা করা হচ্ছে এ বছর ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকার লিচুর ব্যবসা হবে। প্রায় ১ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে, যা থেকে প্রায় ১২ হাজার ৪০০ টন লিচু পাওয়া যেতে পারে।
এই কৃষি কর্মকর্তার হিসাবে, এ বছর ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ গাছে লিচুর ফলন এসেছে বলেও জানান তিনি।