রাজনীতির মাঠের হিসাব বড় জটিল। কখন কোন পরিস্থিতি দাঁড়ায় তা আগে থেকে বলা মুশকিল। কেননা রাজনীতি এমন একটি বিষয়, যা শুধু নিজের দেশ নয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এর একটি যোগসূত্র রয়েছে। মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক মাঠে আলোচনার শেষ নেই। কিছুদিন ধরে রাজনৈতিক পক্ষগুলো থেকে খেলা হবে এমন একটি শব্দ বারবার উচ্চারিত হচ্ছিল। জনগণও খেলা দেখার আশায় ছিল।
তাস খেলায় ট্রাম্প কার্ড খুব গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। প্রতিপক্ষকে হারাতে ট্রাম্প কার্ড ব্যবহৃত হয়। সেখানে ওভার টার্মেরও সুযোগ থাকে। কিন্তু আমেরিকা এমন এক ট্রাম্প কার্ড ব্যবহার করেছে, যেটাকে আর ওভার ট্রাম্প করা যাচ্ছে না। এই বেরসিক ট্রাম্প কার্ডটি রাজনৈতিক খেলায় এক জটিল সমীকরণের জন্ম দিয়েছে। ট্রাম্প কার্ডটির ধরন এমন যে, এটার জালে যে কেউ আটকা পড়তে পারে। অনেকটা চেক জালিয়াতির মতো।
চেক স্বাক্ষর করে দেয়া হয়েছে, এখন শুধু নাম বসানোর বাকি। এত এক অদ্ভুত ধরনের খেলা। খেলায় আনন্দ থাকে, চাপা উত্তেজনা থাকে, কিন্তু এ কোন বেরসিক খেলা যেটা রাতের ঘুম হারাম করে দেয়। বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সবাই চায়। বিদেশিরাও চায়।
একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম তো আর কম হলো না। ২০২৩ এর শেষে বা ২০২৪ এর জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তাপ ছড়িয়েছে। উত্তাপটি মূলত একটি বিষয়কেই কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। আর সেটি হলো নির্বাচন কি দলীয় সরকারের অধীনে হবে, নাকি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হবে।
এ বিষয়ে বড় দুটি দলের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত এবং অনড়। কেউ কাউকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দিতে নারাজ। এ ধরনের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বিশ্ব এবং দেশের আপামর জনতা একটি গ্রহণযোগ্য সংলাপের মধ্য দিয়ে সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজার আহব্বান জানাচ্ছে। তবে অনর্থক সংলাপে কোনো সমাধান আসে না। সংলাপ হতে হবে অর্থবহ। আর অর্থবহ সংলাপের জন্য প্রয়োজন ছাড় দেয়ার মানসিকতা।
প্রশ্ন হলো মার্কিন ভিসানীতি কি বড় দুই দলকে এক টেবিলে বসাতে পারবে? যদি পারে তবে সত্যি কি সমাধান আসবে। মাঠের ভোটের হিসাবের খোঁজ রাজনৈতিক দলগুলো খুব ভালোভাবেই জানে। কাজেই ভোটের জোয়ার কোনদিকে যেতে পারে, সেটা হিসাব করেই বড় দুদল এগোবে। এক্ষেত্রে ভিসানীতি কি সমন্বয়কের ভ‚মিকা নিতে পারবে?
মার্কিন ভিসানীতি কারো জন্য পৌষ মাস আর কারো জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবে। কারণ মার্কিন মুল্লুকের সঙ্গে আমাদের রাজনীতির অনেক হিসাব জড়িত। তবে ভিসানীতি আমাদের জন্য মোটেও গর্বের কোনো বিষয় নয়। এটা এক ধরনের শাস্তি। সুষ্ঠু ভোটের জন্য এই নীতিটি আপাতত উত্তম মনে হলেও এর প্রভাব কিন্তু সুদূরপ্রসারী। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথটি মোটেও সহজ ছিল না।
বছরের পর বছর আন্দোলন করতে হয়েছে। রক্তপাত হয়েছে। জেল-জুলুম আর নির্যাতনের দাবানলে পুড়তে হয়েছে। ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য। আমাদের এই স্বাধীনতার দরকার ছিল আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র এবং উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য। প্রশ্ন হলো স্বাধীনতার ৫২ বছরে আমরা সেটার কতটুকু পেয়েছি।
২০১৪ এবং ২০১৮ সালে যে নির্বাচন হয়েছে, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ। সেই ধরনের নির্বাচন জাতি আসলে চায় না। হাজার উন্নয়ন হলেও মানুষ তার নিজের ভোটটি দিতে চায়। নিজের ভোটের অধিকার কেউ হারাতে চায় না। বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না গেলে কী হবে? আরেকটি একতরফা নির্বাচন কি তবে হয়ে যাবে? এমন পরিস্থিতি এখন নেই বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাছাড়া ট্রাম্প কার্ডের ভয় সবারই কমবেশি আছে।
মার্কিন ভিসানীতি নিয়ে বড় দুদল ভেতরে ভেতরে টেনশনে আছে কিন্তু বাইরে তারা সেটা প্রকাশ করতে চায় না। ভিসানীতি কার ঘাড়ে চাপবে এ নিয়ে মাথাব্যথার শেষ নেই। নির্বাচন কমিশন বারবার তাদের নিরপেক্ষ অবস্থানের জানান দিচ্ছে। কমিশন বলছে, তাদের একার পক্ষে একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেয়া অসম্ভব। নির্বাচনের সময় কমিশনের সহায়ক শক্তিগুলো যদি নিরপেক্ষ এবং স্বাধীনভাবে কাজ করে তবেই একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দেয়া সম্ভব।
বিরোধী শিবির মনে করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে কমিশন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে। বড় দুটি দল অনড় অবস্থানে থাকা মানেই সংঘাত অনিবার্য। তাহলে উপায় কী? উপায় একটাই, আর সেটা হলো সংলাপ। একটি আন্তরিক সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজে নিতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো।
মার্কিন ভিসানীতির ভয়ে নয়, বরং ভিসানীতি চ্যালেঞ্জ করে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে একটি ঐকমত্যে পৌঁছা। পৃথিবীর বহু দেশে দলীয় সরকারের অধীনেই নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। কিন্তু বাংলাদেশে কেন সেটা হয় না? এর মূল কারণ হলো প্রতিপক্ষের প্রতি মারমুখী আচরণ। বড় দুটি দলের রাজনৈতিক হিসাব ক্ষমতাকেন্দ্রিক। আর ক্ষমতায় যেতে হলে সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমেই যেতে হবে।
২০১৮ তে বিএনপি যে হিসাবটি করেছিল, তাতে মনে হয়েছিল তারা সরকার গঠন করতে না পারলেও একটি শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে তারা সংসদে থাকবে। কিন্তু সব হিসাব উল্টে যায়। মাত্র ৬টি আসন নিয়ে তাদের সংসদে যেতে হয়। আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যে কোনো একটি দল সরকার গঠন করবে এটাই স্বাভাবিক। কেননা মাঠে তাদের প্রচুর ভোট আছে। এ দুদলের বাইরে আপাতত কোনো বিকল্প নেই।
আর দুদলের অবস্থান যদি ভয়ংকর মাত্রায় বিরোধী হয় তবে জনগণ সেটার ভুক্তভোগী হবে এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমরা হেয়প্রতিপন্ন হবো। মার্কিন ভিসানীতি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর কতটা চাপ তৈরি করবে, সেটা দেখার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে পশ্চিমা বিশ্বের চাপে হোক বা জনগণের চাপে হোক একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সবার কাম্য। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি সব ধরনের নির্বাচন বর্জন করে আসছে, যার কারণে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে না। এটি গণতন্ত্রের জন্য মোটেও ভালো লক্ষণ নয়।
তাই ২০২৪ এর শুরুতে যে নির্বাচন হবে, সেটা অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে। আর যদি না হয়, তবে মার্কিন ট্রাম্প কার্ডের জালে হয়তো অনেকেই আটকা পড়বেন। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এ দেশের মানুষের কম রক্ত ঝরেনি। আর রক্তারক্তি না হোক এটাই দেশবাসীর একমাত্র চাওয়া।
লেখক : কবি ও কলাম লেখক।
ভোরের আকাশ/নি