logo
আপডেট : ৭ জুন, ২০২৩ ১৬:০৮
সাধের জনম
মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

সাধের জনম

বারো

আজগর চেয়ারম্যানের বেশভূষনে পরিবর্তন এসেছে। আগে থেকেই পরিপাটি থাকতে পছন্দ করেন তিনি। সব সময়ে দামি লুঙ্গির সাথে পাকিস্তানি এবং ইন্ডিয়ান পাঞ্জাবি পরেন। আগে তার দু’ একটা চুল পাকা ছিল। এখন প্রায় অর্ধেকই পেকে গেছে। কিন্তু কলপের কারণে বোঝা যায় না। লুঙ্গির বদলে এখন বেশিরভাগ সময়েই পায়জামা পরেন। আগে বেশিরভাগ সময় বাজারেই থাকতেন। এখন বাড়িতে থাকতে ভালোবাসেন। সারাক্ষণ গুনগুন করেন। তার সেবা করার জন্য স্ত্রী গুলজান রয়েছেন। রয়েছে বানুও। চেয়ারম্যানের সব খবর ইদানীং তাকেই রাখতে হয়।

 

বানুর চেহারাটাও আগের চেয়ে বদলেছে। দেখতে আরও সুন্দরী হয়েছে। শরীরে বিধবার লেশ নেই। আবার বিয়ে করবে, তেমনটিও ভাবছে না। চেয়ারম্যান বাড়ি খাচ্ছে, কাজ করছে, ঘুমাচ্ছে দিব্যি দিন কেটে যাচ্ছে। তাকে দেখে কেউ বলবে না যে, সে এ বাড়ির কাজের লোক। বরং গুলজানকে দেখে অনেকে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন।

 

চেয়ারম্যানের শখ হয়েছে পাকান পিঠা খাবেন। বানু সেসব জোগাড়-গোছালে ব্যস্ত। এখন সে বারান্দায় বসে নারকেল কোরাচ্ছে। চেয়ারম্যান পাশেই চেয়ারে বসা। গুলজান চেয়ারম্যানের গায়ের ঘামাচি ভেঙে দিচ্ছেন।

 

আজ নীল কাপড় পরেছে বানু। কানে নীল দুল, হাতে একই রংয়ের কাঁচের চুড়ি। চেয়ার‌্যমান তার দিকে তাকিয়ে আছেন। সত্যিই মেয়েটা দিনদিন আরও সুন্দরী হয়ে উঠছে। তিনি গুলজানকে বলেন, সীমান্তর মা একটা বিষয় খেয়াল করেছো?
আমাদের বানু কিন্তু আগের চেয়ে সুন্দর হয়ে গেছে।

 

আচ্ছা, এক কাজ করলে হয় না। ওরে তো আবার বিয়ে দিতে পারি। নারীরা পুরুষের ছোয়ায় আরও বেশি সুন্দর হয়ে ওঠে। তাছাড়া সামনে ওর পুরো জীবনটাই পড়ে আছে। ওরও তো সাধ-আহ্লাদ হয়। স্বামীর সোহাগ পেতে ইচ্ছে করে। ও রে কত কই, কিন্তু ও তো বিয়ের কথা শুনতেই পারে না।

 

গুলজানের কথা শুনে চেয়ারম্যান হেসে বলেন, কথাটা যে আমি ভাবি না তা নয়। বানু তো আমার মেয়ের মতো। ওরে আমি পরের বাড়িতে পাঠাতে পারব না। কবিরের মতো ভালো ছেলে খুঁজচ্ছি। এমন কাউকে পেলে তবেই ওর বিয়ে দেবো। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, তার এই বাড়িতেই থাকতে হবে।

 

আমার একটা কথা শুনবেন?
বলো কী বলবে?

 

বলছি যে, আমার একটা চাচাত ভাইয়ের ছেলে আছে। গরিব মানুষ। ওদের জমিজিরাত নেই। তার সঙ্গে বানুর বিয়ে দিলে কেমন হয়?

 

চেয়ারম্যান কিছুক্ষণ ঝিম ধরে থাকেন। তারপর বলেন, আচ্ছা তাকে একদিন আমাদের বাড়িতে আসতে বলো দেখি কেমন ছেলে। তারপর গুলজানের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেন, যে সে ছেলে তো বানুকে সামাল দিতে পারবে না। ওর জন্য চাই--।

 

ধুর আপনি না। বয়স দিনদিন বাড়ছে না কমছে চেয়ারম্যান সাহেব। ইদানীং কথাবার্তা শুনলে তো মনে হয় আপনার বয়স চব্বিশ। হা-হা-হা।

 

হাসি-ঠাট্টার মধ্যেই পিয়ন এসে একটা চিঠি দিয়ে যায়। বহুদিন পর হলুদ খামের চিঠি দেখে অবাক হন আজগর চেয়ারম্যান। এই সময়ে কে চিঠি লিখবে তাকে। খামটা নিয়ে ভেতরে চলে যান।

 

বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় খাম খোলেন চেয়ারম্যান। বেশ বড়সড় একটা চিঠি। হাতের লেখাটা বেশ পরিচিত লাগছে। কিন্তু ঠিক কার লেখা মনে করতে পারছেন না। তিনি চিঠিতে চোখ বোলাতে শুরু করেন। কোনো ধরনের সম্বোধন ছাড়া চিঠি।

 

বহুদিন পর আমার লেখা চিঠি পেয়ে অবাক হবেন সেটাই স্বাভাবিক। বিশ^াস করুন আপনাকে চিঠি লেখার কোনো ইচ্ছেই ছিল না আমার। তবু মনে হলো আমি বেঁচে আছি এটা আপনাকে জানানো দরকার। আরও জানানো দরকার, আমি কারও সঙ্গে পালিয়ে আসিনি। আমি যাকে ছোট মা ডাকতাম তিনি এবং আপনি নিশ্চয়ই গ্রামে এসব রটিয়েছেন।

 

তাছাড়া আপনারা আরও একটা বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছেন তা হচ্ছে আমাকে খুন করার পরিকল্পনা আমি জানতে পেরেছি কি না। হ্যাঁ, আমি নিজ কানে সব শুনতে পেয়েছিলাম। আর সেই জন্যই সে দিন পালিয়ে বাঁচতে পেরেছিলাম। সেদিন অন্ধকারের মধ্যে কীভাবে ছুটেছিলাম, তা ভাবতে গেলে অবাক হই। কোনো মানুষ এইভাবে ছুটতে পারে এটা জানা ছিল না।

 

যে মেয়েটি ভূতের ভয়ে সন্ধ্যার পরে রান্না ঘরের কোনায় যেতে ভয় পেত সে এমন পরিস্থিতি সামাল দিবে ভাবিনি। এত দিন পরেও যখন মনে পড়ে ওই রাতে কীভাবে কুমার নদী সাঁতরে পার হলাম। শরীরের পশমগুলো দাঁড়িয়ে যায়। দিনের বেলাতেও আমি এটা পারতাম না। কিন্তু ওইদিন পেরেছিলাম। আর ওই দিন পেরেছিলাম বলে এখন মনে হয় আমি সব পারি। সব পারব।

 

আপনি আমার আব্বু এখন এটা অস্বীকার করি। কিন্তু অস্বীকার করলেই তো সব হয় না। আপনার রক্ত আমার শরীরে। এটা অস্বীকার করি কীভাবে। আপনাকে আমি এত বেশি ঘৃণা করি যে, মাঝে মাঝে মনে হয় শরীরের সব রক্ত বের করে দেই। আচ্ছা, আপনার কাছে আমার একটা প্রশ্ন কীভাবে টাকার জন্য নিজের মেয়েকে খুনের অনুমতি দিতে পারলেন? শুধু তা-ই নয়। হালিম সর্দারকে আপনি বলেছিলেন মামলা শক্ত করার জন্য দরকার পড়লে ধর্ষণ করবে।

 

ছিঃ আপনার এই কাহিনি শুনলে পৃথিবীর অন্যসব বাবারা লজ্জা পাবেন। পৃথিবীর ওইসব বাবাদের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা। সম্রাট বাবর ছেলে হুমায়ূনের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন। পত্রিকায় পড়েছিলাম একবার শিশু মেয়েকে রক্ষা করার জন্য পদ্মা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন এক বাবা। সেখানেই তার মৃত্যু হয়েছিল। এইসব বাবাদের শ্রদ্ধা না করে কী উপায়। কোনো উপায় নেই। কারণ পৃথিবীতে তাদের মতো বাবার সংখ্যা অনেক বেশি। আর আপনার মতো বাবার সংখ্যা একবারেই নঘন্য। হাতে গোনা। তারা আপনার মতোই অসুস্থ। আপনার মতোই কীট।

 

যখন একা থাকি বকুলগঞ্জের কথা মনে পড়ে। শিকড়ের টান অনুভব করি। ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পারি না সেটা শুধু আপনার কারণে। বুজির মুখটা খুব মনে পড়ে। সীমান্তকে মনে পড়ে। একটামাত্র ভাই ওকে দেখার জন্য মনটা আনচান করে। সীমান্তর মায়াভরা মুখটা যখন মনে হয় তখন ভাবি আপনাকে মাফ করে দিই। অন্তত ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মাফ করি আপনাকে। কারণ আপনি তো ওর মতো একটা ভালো সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। পরে মত বদলাই। সীমান্তর জীবনে এখন ভোরবেলা।

 

বাকিটা জীবন সামনে পড়ে রয়েছে। একসময় ও আপনার মতোই হবে। অত্যাচারী হবে, ধর্ষক হবে, পূর্বপুরুষের মতো খুনি হবে। তবুও কেন যেন মনে হয়ে সীমান্ত আপনাদের মতো নয়। ও অন্য রকম। ওর মতো। এটা সম্ভবত ওকে ভালোবাসি এই জন্য মনে হয়। আপনার কাছে একটা অনুরোধ সীমান্তকে ওর মতো হতে দিন। দয়া করে ওকে পূর্বপুরুষদের মতো বানাবেন না।

 

বিজ্ঞান বলে, আপনার মতো মানুষেরা আসলেই অসুস্থ। এদের চিকিৎসা দরকার। আপনি অসুস্থ, এটা আমি ছোটবেলা থেকেই বুঝেছিলাম। মা মরে যাওয়ার পর কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলাম আমি। অন্য বাচ্চাদের থেকে আলাদা। চুপচাপ। কারও সঙ্গে মিশতে ইচ্ছে করত না। সে কারণে আমার সব কিছুই দেরিতে হয়েছে। আমি সাঁতার শিখি ১০/১১ বছর বয়সে। আপনি আমাকে সাঁতার শেখানোর চেষ্টা করতেন। এর ছলে আপনি আমার--।

 

ছিঃ ভাবতে গেলেই আমার গা গুলিয়ে যায়। ভাবি, চিকিৎসা করলে আপনার এই রোগ ভালো হবে। আপনার মনোচিকিৎসা দরকার। আবার ভাবি, আপনি অসুস্থ নন। বুজির কাছে শুনেছি আপনাদের পূর্বপুরুষেরা এমনই ছিল। আপনাদের রক্তেই আছে খুন, নারীভোগ, দখলবাজি, অত্যাচার করা। যা আপনার মধ্যেও আছে। আপনার সর্বাঙ্গে ব্যাথা। এর কোনো চিকিৎসা নেই। তাই সীমান্তকে নিয়েও ভয় পাই। একদিন হয়তো আপনাদের কাতারেই ওকে দেখব।

 

আমার দুই ফুফু। উনারা খুব ভালো মানুষ। আপনার জন্য উনারা অনেক ভাবেন। আপনাকে চোখে হারান। অনেক ছাড় দিয়েছেন আপনাকে। এমন কি সব সম্পত্তিও উনারা বুঝে নেননি। কিন্তু তাতে আপনি খুশি নন। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেছেন। আপনি হাড়ে হাড়ে স্বার্থপর। এই ছোট্ট জীবনে আপনার মতো এমন মানুষ দেখিনি। আমার মতো এটা অনেকেই জানে গ্রামের প্রতিটি খুন, চুরি, বিচার সালিসে আপনার ইন্ধনে হয়।

 

আপনি যেমন চান, তেমন হয়। এমনকি রাহাতের খুনের পেছনেও আপনার হাত ছিল। সে কোনো দিন কারও সঙ্গে কোন্দলে যায়নি। আপনার লোকই রাহাতকে সে দিন জোর করে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। আমি শতভাগ বিশ্বাস করি, তারাই কেউ রাহাতকে মেরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসিয়েছে। সব মেনে নিয়েছিলাম আমি। কিন্তু যে দিন ত্রিশ থেকে চল্লিশ লাখ টাকার বিনিময়ে আমাকে খুন করার পরিকল্পনা করলেন, সে দিনই মনে হলো আপনি আমার পিতা নন। জন্মদাতা। জন্ম দেয়া আসলেই খুব সহজ। অনিচ্ছাতেই প্রতিদিন হাজার হাজার শিশুর জন্ম হচ্ছে। লাখ লাখ ভ্রুণ নষ্ট হচ্ছে। এসব করছে জন্মদাতারা। বাবা হওয়া সত্যিই বড় কঠিন। সবাই বাবা হতে পারে না।

 

শেষান্তে
রুপালি

 

চিঠি পড়া শেষে কিছুক্ষণ নীরব থাকেন আজগর চেয়ারম্যান। তারপর চিঠিটাকে টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলেন।

 

তেরো
কলেজে তেমন কারও সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠেনি রুপালির। চাকরি করে পড়াশোনা করে বলে সে নিয়মিত ক্লাসে আসতে পারে না। তাই এমন হয়েছে। ক্লাসমেটদের সঙ্গে হাই-হ্যালো সম্পর্ক। বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেছে শুধু দোলন আর মৌসুমির সাথে।

 

আজ দোলন, মৌসুমি কেউ আসেনি। ওরা জানে না, আজ তৃতীয় বর্ষের রেজাল্ট বের হবে। রুপালিও জানত না। কলেজে এসে দেখে নোটিশ বোর্ডে রেজাল্টশিট টানানো হয়েছে। ডিপার্টমেন্টে তার চেয়ে বেশি নাম্বার পেয়েছে দুই জন। ফাস্ট অরুণ। দ্বিতীয় জালাল উদ্দীন রুমি। এরপরই রুপালির স্থান। পরের স্থানটি শাহাদাতের।

 

রেজাল্ট নিয়ে কলেজ ক্যান্টিনের কাছে এসে দাঁড়ায় রুপালি। এখান থেকে বাসে গুলিস্তান পর্যন্ত যেতে পারবে। পরে অন্য গাড়িতে যেতে হবে। হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়ান সুদর্শন এক পুরুষ। জিন্স প্যান্টের সাথে নীল রংয়ের টিশার্ট পরেছেন ভদ্রলোক। চোখে সান গ্লাস। প্রথমে কিছুটা ভয় পায় রুপালি। পরে ভাবে যতক্ষণ নিজেদের ক্যাম্পাসে আছে ততক্ষণ সে নিরাপদ। লোকটাকেও ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে না। কেমন চেনাচেনা লাগছে। কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে করতে পারছে না।

 

ভদ্রলোকটা রুপালিকে সালাম দিয়ে বলেন, কেমন আছেন মিস রুপালি?
জি ভালো। আপনি কেমন আছেন? রুপালি কাঁপাগলায় উত্তর দেয়।

 

ভালো। আপনি সম্ভবত আমাকে চিনতে পারেননি?
আসলে কোথায় দেখেছি, মনে করতে পারছি না।

 

আমার নাম আনিসুর রহমান। পুলিশে আছি। আপনি একবার একটা সমস্যা নিয়ে থানায় গিয়েছিলেন। তারপর আপনার বাসায় দু একবার গিয়েছিলাম।
এবার চিনতে পারে রুপালি। বলে, সরি স্যার, আমি আপনাকে চিনতে পারিনি। আসলে অনেকদিন পর দেখা তো। আর আপনাকে তো এই পোশাকে দেখিনি। সেই জন্য গুলিয়ে ফেলেছিলাম।

 

ওকে। তাছাড়া সেটা বেশ আগের ঘটনা। মনে থাকার কথাও নয়। তবে শেষ পর্যন্ত যে চিনতে পেরেছেন, সেটাই বড় কথা। তো আপনি এখানে?
আমি এই কলেজেই পড়ি স্যার।
তাই নাকি?

 

জি স্যার। ওই ঘটনার কিছুদিন পরই এখানে ভর্তি হই। আপনি এখানে কাজে এসেছিলেন বুঝি?
হ্যাঁ। আমার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। ও এই কলেজেই আছে। সমাজ বিজ্ঞান ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক। আখতারুজ্জামান সুমন। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলায় বাড়ি। আমার আর একজন বন্ধু আবুল হোসেন নয়ন। ও

 

ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক। চেনা আছে?
না স্যার, আমি কলেজে কম আসি। আমার বিভাগের শিক্ষকদের ছাড়া তেমন কাউকে চিনি না।

 

ও আচ্ছা, তা আজ কি ক্লাস শেষ?
জি স্যার। এখন চলে যাবো। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি।

 

কোথায় যাবেন?
কলেজের গাড়ি গুলিস্তান পর্যন্ত যায়। তার পর অন্য গাড়িতে মহাখালী যাওয়া যাবে।
কিছু মনে না করলে আপনি আমার গাড়িতে যেতে পারেন। আপত্তি নেই তো?

 

ধন্যবাদ স্যার। আমি চলে যেতে পারব, কোনো অসুবিধা হবে না।
মিস রুপালি আমি কিন্তু বলিনি যে, আপনার সমস্যা হবে। বলছি আপনার কোনো আপত্তি না থাকলে আমার গাড়িটা শেয়ার করতে পারেন। আমি উত্তরা থাকি। মহাখালী হয়েই যাবো।

 

না স্যার থাক। তাছাড়া আপনার অফিসিয়াল গাড়ি। কেমন দেখাবে?
না না, অফিসের গাড়ি নয়। আজ আমার ছুটি। নিজের গাড়ি নিয়ে বের হয়েছি। আসুন।

 

অনিচ্ছা সত্ত্বেও আনিসুর রহমানের সাথে গাড়িতে ওঠে রুপালি। দুজনে পাশাপাশি বসা। এই পুলিশ অফিসারকে সে ভালো মানুষ হিসেবে জানে। প্রথম দিন তাকে দেখে ভুল ধারণা হয়েছিল রুপালির। ভেবেছিল লোকটা হয়তো অন্যদের মতো। কিন্তু পরবর্তীতে লোকটার প্রতি তার শ্রদ্ধা বাড়ে। তবে আজ একেবারে অন্য পরিবেশ। তাছাড়া পুরুষ মানুষে তার বিশ্বাস নেই। পুরুষ মানেই নারী লোভী। পুরুষ মানেই স্বার্থপর। নিজের বাবাতেই তার আস্থা নেই। সেখানে অন্য পুরুষদের কীভাবে বিশ্বাস করে!
আপনার কি আনইজি লাগছে?

 

আনিসুর রহমানের কথায় চমকে ওঠে রুপালি। না না, আনইজি লাগবে কেন?
তাহলে ঘামছেন যে। রশিদ, এসিটা দিয়ে দাও।

 

ড্রাইভার এসি অন করে। গাড়ি চলছে ধীরগতিতে। রুপালি কিছু বলছে না দেখে আনিসুর রহমান কথা শুরু করেন । আপনাদের বাড়ি তো ফরিদপুর তাই না?
জি, আপনার সেটাও মনে আছে?

 

পুলিশে চাকরি তো অনেক কিছু মনে রাখতে হয়। তবে সব যে মনে থাকে, তা নয়। আপনার কেসটার অনেক কিছুই মনে আছে। আপনি ওখান থেকে কবে বেরিয়েছেন?
সম্রাট-আর রয়েল মারা পড়ার পরই আমার এই চাকরিটা হয়। তারপরই খালেকের বস্তি ছেড়ে দেই।

 

আপনাদের গ্রামের বাড়িতে কে কে আছেন?
রুপালি নিরুত্তর। সে কী বলবে বুঝতে পারেছে না। আজগর চেয়ারম্যান তার বাবা এ পরিচয়টা দিতে রুচিতে বাধে।

 

আনিসুর রহমান আবারও প্রশ্ন করেন। বাড়িতে কে কে থাকেন?
মা-বাবা, দাদি উনারা আছেন। আর একটা ভাই আছে।
কী করেন আপনার বাবা?

 

উনি বকুলগঞ্জের চেয়ারম্যান।
রুপালির কথা শুনে হোঁচট খান আনিসুর রহমান। চেয়ারম্যানের মেয়ে! তার মানে আর্থিক অবস্থা ভালো-ই হওয়ার কথা। কোনো সমস্যা না হলে তো এমন পরিবারের মেয়ের ঢাকায় এসে চাকরি করার কথা নয়। এর পেছনে নিশ্চয়ই অন্য কোনো কারণ আছে। আনিসুর রহমানের কৌতূহল বাড়ে। রুপালিকে প্রশ্ন করেন।

 

কিছু মনে না করলে আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
বলুন, নো প্রবেলম।
বিষয়টা আপনার একান্তই ব্যক্তিগত। তাই হেজিটেশন ফিল করছি।

 

বললাম তো, কোনো প্রবেলম নেই।
পরিবারের সাথে আপনার যোগাযোগ নেই, তাই না?

 

ঠিকই ধরেছেন। বকুলগঞ্জের কারও সাথে আমার যোগাযোগ নেই।
কারণটা জানতে পারি কি?

 

রুপালির কেন যেন বিষয়টি শেয়ার করতে ইচ্ছে করে। যদিও মলিনা থেকে শুরু করে কাউকে এ বিষয়ে কিছু বলেনি। বরাবরই বলে এসেছে তার মা-বাবা নেই। চাচির কাছে থাকত। গরিব ঘরের মেয়ে কষ্টে পড়েই ঢাকায় এসেছে।
রুপালির নীরবতা দেখে আনিসুর রহমান বলেন, সরি আমার এক্সপেকটেশন একটু বেশিই হয়ে গেছে। বিষয়টি আপনার কাছে জানতে চাওয়া উচিত হয়নি।

 

না না, তা কেন। আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। আসলে আমার ঘটনাটা খুব কষ্টের। কখনও কারও কাছে শেয়ার করা হয়নি। আমার আব্বু আমাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিলেন। এ কথা কী কারও কাছে বলা যায়!
বলেন কী! চমকে ওঠেন আনিসুর রহমান।

 

হ্যাঁ। আমার আব্বু খুবই অত্যাচারী মানুষ। এমন কোনো খারাপ কাজ নেই, যা তিনি করেন না। একবার তার একটা লাশের দরকার পড়ল। কাউকে সম্ভবত পাচ্ছিলেন না। পরে বেছে নিলেন আমাকে। প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য ত্রিশ লাখ বা তারও বেশি টাকার বিনিময়ে আমারকে খুনের অনুমতি দেন। ঠিক কত টাকার বিনিময়ে, তা আমার মনে নেই। তবে ত্রিশ লাখ নগদ পরিশোধ করতে হবে, এটা শুনেছিলাম। ওই রাতেই আমি পালিয়ে আসি।

 

আনিসুর রহমানের শরীর হিম হয়ে আসছে। তার পুলিশি জীবনে এমন ঘটনা কখনও শোনেননি। তিনি কী বলবেন, ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। পরে বলেন, আপনার বাবার খুব টাকার নেশা, তাই না?

 

কিসের নেশা নেই তার! টাকা, নারী, জমি, খুন সবকিছুর নেশাই তার আছে। যারা আমায় খুন করবে ঠিক করেছিল আব্বু তাদের বলেছিলেন দরকার পড়লে ধর্ষণ করবে। মামলা যাতে আটে সেই ব্যবস্থা করবে। বিশ^াস করুন, আমাদের সম্পত্তি একেবারেই কম নেই। না হলেও ত্রিশ থেকে চল্লিশ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। কিন্তু তারপরও আমার আব্বুর টাকার নেশা কাটে না।

 

আচ্ছা বাড়িতে তো আপনার মা, দাদি, ভাই রয়েছে বললেন। তাদের সাথে যোগাযোগ করতে ইচ্ছে হয় না?

 

আমার মা নেই। আমি যখন খুব ছোট তখন তিনি গলায় রশি নিয়ে আত্মহত্যা করেন। পরে আবার বিয়ে করেন আব্বু। ওই ঘরে একটা ভাই আছে। ওর নাম সীমান্ত। তার জন্য আর আমার বুজির (দাদি) জন্য খুব খারাপ লাগে। মনে হয় যোগাযোগ করি। কিন্তু ওরা জানলে আব্বু জানবেন, তাই এত দিন যোগাযোগ করিনি। কিছু দিন আগে একটা চিঠি পাঠিয়েছি। মনে হয় এত দিন পেয়েও গেছেন। একটানা কথাগুলো বলে থামে রুপালি।

 

দুজনেই খানিকক্ষণ নীরব থাকেন। আনিসুর রহমান খেয়াল করেছেন কথা বলতে বলতে রুপালির চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। এখন তার নিজের কাছেই খারাপ লাগছে। মেয়েটার অতীত এত কষ্টের জানলে এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করতেন না তিনি। প্রসঙ্গ ঘুরানোর চেষ্টা করেন আনিসুর রহমান। বলেন, আচ্ছা আমি তো আপনাকে কত প্রশ্ন করলাম। আপনি কিন্তু আমায় কোনো প্রশ্ন-ই করলেন না। তার মানে কি ধরে নেবো, আমার বিষয়ে আপনার কোনে আগ্রহ নেই?

 

না না তা কেন থাকবে না।

 

রুপালিকে আর প্রশ্ন করতে হয় না। আনিসুর রহমান নিজেই বলতে শুরু করেন। আমার গ্রামের বাড়ি নড়াইলে। চিত্রা নদীর নাম হয়তো শুনেছেন। ছোট্ট শান্ত একটা নদী। এই নদীর তীরেই আমাদের গ্রামের বাড়ি। উত্তরায় ছোট্ট একটা বাড়ি আছে আমাদের। সেখানেই থাকা হয়।

 

আপনার মা-বাবার সঙ্গেই থাকেন?
না, উনারা বেঁচে নেই। আমার ছোট ভাই-বোন আছে দুইজন। ওরা আমেরিকাতে সেটেল।

 

ও আচ্ছা, আপনার বেবি আছে?
হ্যাঁ, আমার এক ছেলে। সেও আমার কাছে থাকে না। বিকেএসপিতে পড়ছে তো, ওখানেই থাকে। এই যে দেখুন, আমার ছেলের ছবি। ফেসবুকে ঢুকে ছেলের ছবি দেখান আনিসুর রহমান।

 

ছবি দেখে রুপালি বলে, খুব কিউট তো একেবারে আপনার কপি। কোন ক্লাসে পড়ছে ও?
ক্লাস সেভেনে। কিন্তু দেখলে যে কেউ বলবে, কলেজে পড়ে।

 

তাহলে বাসাতে ভাবী আর আপনিই থাকেন?
একসময় ছিল।
তার মানে? ঠিক বুঝলাম না।
সে নেই।

 

ঠিক কী বলছেন, বুঝতে পারছি না। উনি কী বেঁচে নেই?
আপনার কাছে সত্যিটা বলেই ফেলি। ও আসলে অন্য একজনের সাথে চলে গেছে। আমাকে ডিভোর্স দিয়ে তাকেই বিয়ে করছে। ওই ছেলেটা আমার বাবুর গৃহশিক্ষক ছিল। আমি চাইলে অ্যাকশনে যেতে পারতাম কিন্তু চাইনি।

 

কারণ ছেলেটার কোনো দোষ নেই। আর আমার সাবেক স্ত্রীকেও দোষ দেই না। ও আমার সাথে থাকতে চাইছিল না, তাই মুক্তি নিয়েছে। এতে আমার তেমন কোনো খেদ নেই। কিন্তু বাবুর জন্য খারাপ লাগে। ছেলেটার মা থাকতেও নেই। ব্রোকেন ফ্যামেলির ছেলে-মেয়েদের অনেক কষ্ট হয়। সেটা ভেবে খারাপ লাগে।

 

আচ্ছা, আপনাদের কি লাভ ম্যারেজ ছিল?
হ্যাঁ। ছাত্রজীবন থেকেই ওকে ভালোবাসতাম। সে জন্য চাকরি পাওয়ার পরপরই বিয়ে করে ফেলি।

 

তাদের কথা যখন জমে ওঠেছে গাড়ি তখন মহাখালীতে চলে আসে। রুপালি বলে, আমি সামনেই নামব।
ও আচ্ছা। কথা বলতে বলতে খেয়ালই করিনি যে, মহাখালীতে চলে এসেছি। রশিদ বাঁয়ে রাখো।

 

গাড়ি থামলে নামে রুপালি। বলে ধন্যবাদ স্যার। আবার দেখা হবে নিশ্চয়ই।
ওকে। অবশ্যই দেখা হবে। কিছু মনে না করলে আপনার সেল নাম্বারটা পেতে পারি?

 

কেন নয়। রুপালি নাম্বার দিলে গাড়ি টান দেয়। আনিসুর রহমান হাত নাড়েন। রুপালিও হাত নেড়ে বিদায় জানায়।

 

ভোরের আকাশ/নি