সর্বজনবিদিত যে, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও নতুন করে করোনা অতিমারির বিস্তারসহ নানামুখী উদ্ভূত সমস্যায় বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা প্রায় বিপর্যস্ত। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেও এর প্রভাব প্রচন্ড অনুভূত। ফলে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতি ও ডলার-জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি তাপপ্রবাহ-লোডশেডিং-পানি সংকটে জনজীবন ওষ্ঠাগত।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে উন্নয়নে বিস্ময়কর অর্জনে বিশ্বস্বীকৃত বাংলাদেশের এই সংকটময় মুহূর্তে পণ্য রপ্তানির অব্যাহত প্রবৃদ্ধিতে দেশের আর্থ-সামাজিক সংকট উত্তরণে সম্ভাবনার নতুন অধ্যায় নির্মিত হয়েছে। রপ্তানির ওপর ভর করে আগামী দিনগুলোতে দেশের অর্থনীতি পুনরায় ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা।
দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদদের মতে, আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আসার সঙ্গে সঙ্গে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়ায় অর্থনীতি আবার গতিশীল এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছিল তা ধীরে ধীরে প্রশমিত হচ্ছে। এ ছাড়াও দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার ভারসাম্য রক্ষার্থে বাংলাদেশ সরকারের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ ও কার্যকর বাস্তবায়নে অর্থনীতির চাকাকে সচল করার গৃহীত সব উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসিত। সম্প্রতি বাংলাদেশি টাকায় বৈদেশিক বিল পরিশোধে নতুন আশা সঞ্চারিত।
৫ জুন ২০২৩ প্রকাশিত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) ৫ হাজার ৫২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ১১ শতাংশ বেশি। ওই সময়ে পণ্য রপ্তানি হয়েছিল ৪ হাজার ৭১৭ কোটি ডলার। সংস্থাটির মতে, চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত তৈরি পোশাকের পাশাপাশি চামড়া-চামড়াজাত পণ্য, চামড়াবিহীন জুতা এবং প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে।
কিন্তু রপ্তানি কম হয় পাট-পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, হিমায়িত-কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও প্রকৌশল পণ্যের। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের উল্লেখ্য সময়ে অর্জিত ৪ হাজার ২৬৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি আয় গত অর্থবছরের তুলনায় ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। শুধু মে মাসে হওয়া ৪০৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি আয়ও ছিল গত বছরের মে মাসের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১১২ কোটি ডলার। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪২ শতাংশ। এ ছাড়াও তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে থাকা হোম টেক্সটাইল পণ্য, পাট-পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে যথাক্রমে ১০২ ও ৮৫ কোটি ডলার।
দীর্ঘ সময় ধরে অপ্রতুল ক্রয়াদেশ, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যেও ২০২২ সালে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি পাঁচ হাজার কোটি ডলার মাইলফলক অতিক্রম করেছে। ২০২০ সালের তুলনায় বিদায়ী বছরে পণ্য রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য যে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে রপ্তানি পণ্য ছিল শুধু পাট আর চামড়া।
এই দুটি পণ্য রপ্তানি করেই ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ৩৪ কোটি ৮৪ ডলার আয় হয়। দেশীয় মুদ্রায় যা ছিল ২৭১ কোটি টাকার মতো। তন্মধ্যে পাট-পাটজাত পণ্যের অবদান ৮৯ দশমিক ৬৬ এবং চামড়ার ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। আশির দশকের শেষের দিকে রপ্তানি পণ্যের তালিকায় যুক্ত হয় তৈরি পোশাক। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে পাটকে হটিয়ে তৈরি পোশাক শীর্ষ স্থান দখল করে নেয়। একইসঙ্গে নিত্যনতুন পণ্যও যুক্ত হতে থাকে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, গত ৫০ বছরে পণ্য রপ্তানি ১৪৯ গুণ বেড়েছে। জুন মাসে শেষ হওয়া সর্বশেষ ২০২১-২০২২ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার, যা প্রতি ডলার ১০২ টাকা ধরে দেশীয় মুদ্রায় ৫ লাখ ৩১ হাজার ২১৬ টাকা।
সকলের জানা, প্রায় তিন যুগ ধরে পণ্য রপ্তানিতে তৈরি পোশাক শিল্প নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে একক দেশ হিসেবে পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। ২০২০ সালে ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে পিছনে ফেলে দ্বিতীয় অবস্থানে এলেও এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ তা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। ২০২২ সালে বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার সংখ্যা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
১২ মাসে ৩০টি তৈরি পোশাক ও বস্ত্র কারখানা পরিবেশবান্ধব সনদ পাওয়ায় এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮৭টিতে। ব্যবসায়ীদের দাবি, তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক আর কোনো দেশে এত পরিবেশবান্ধব কারখানা নেই। ১৯৯১-৯২ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রথমবারের মতো বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়।
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ প্রকাশিত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর প্রতিবেদন মারফত জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তৈরি পোশাক শিল্প খাতে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ বা ২৭ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। পূর্বের বছর একই সময়ে এই আয় ছিল ২৩ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। উক্ত সময়ে তৈরি পোশাক খাতে নীটওয়্যার পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ১৪ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার এবং ওভেন পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ১২ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার।
স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে বাংলাদেশ এতদিন যে সুবিধা পেয়ে আসছিল উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে এর কিছু সুবিধা কমলেও দেশের রপ্তানি আয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির আশাবাদ ব্যক্ত করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। ৩০ জানুয়ারি আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণপ্রস্তাব অনুমোদনের পর বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক সম্পর্কে তৈরিকৃত প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২৬-২৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় হবে ৭ হাজার ৫৮ কোটি মার্কিন ডলার, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।
ইইউভুক্ত দেশগুলোয় থ্রো প্রবৃদ্ধি এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা থেকে যাওয়ায় আইএমএফ কিছুটা রক্ষণশীল প্রাক্কলন করেছে, যা অর্জন করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক। তবে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এর পূর্বাভাসে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়।
২০২২ সালের আগস্ট মাসে বিজিএমইএ আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় বলেছিল, সরকারের নীতিসহায়তার পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ ঠিক থাকলে ২০২৩ সালের মধ্যে পোশাক রপ্তানির আয়ই দাঁড়াবে ১০ হাজার কোটি ডলার। বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘দেশে পোশাক পণ্যের বহুমুখীনতা নিয়ে কাজ চলছে। এখন উচ্চমূল্যের পোশাকও রপ্তানি হচ্ছে যা আগে হতো না। ফলে, রপ্তানি আয়ে আমরা আইএমএফের প্রাক্কলনকে ছাড়িয়ে যাব বলে আশা করছি।’ যদিও ২০২০ সালে প্রকাশিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) প্রতিবেদনে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য অনুযায়ী, আগামী জুন মাস নাগাদ রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং চলতি অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়াবে ৫৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এ ছাড়া এই বছরের জুন মাসে রেমিট্যান্স ৪ শতাংশ বেড়ে প্রবাসী আয় প্রায় ২৩ বিলিয়ন এবং আমদানি ৮০ বিলিয়ন ডলার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নতি করে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে পাটজাত পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাটজাত পণ্যকে ২০২৩ সালের ‘বর্ষ পণ্য’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা অনুযায়ী সম্ভাবনাময় এ খাতের উন্নয়ন আরো বেগবান করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জুট প্রোডাক্টস বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল (জেপিবিপিসি) গঠন করেছে।
বর্তমান পাটের উৎপাদন ও পাটপণ্যের ব্যবহার বাড়ছে। অনেকে পাট ও পাটপণ্য উৎপাদন-রপ্তানি করে ভাগ্যের পরিবর্তন করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যেক হাইকমিশনার-রাষ্ট্রদূতকে পাটজাত পণ্য প্রদর্শন এবং বাজার সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।’ ‘দেশের পাটশিল্পের পুনরুজ্জীবন ও আধুনিকায়নের ধারা গতিশীল করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে পাটজাত বহুমুখী পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধিতে জেপিবিপিসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। রপ্তানির সম্ভাবনাময় খাতগুলোর উন্নয়নে বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিল (বিপিসি) ইতোমধ্যে সাতটি খাতভিত্তিক কাউন্সিল গঠন করে কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত সুদূরপ্রসারী নীতি ও বাস্তবায়ন কৌশল; বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় এবং রপ্তানি আয়ের সম্ভাব্য সমীকরণ বৈশ্বিক-দেশীয় বিরাজিত সংকট উত্তরণে ইতিবাচক উদ্যোগ উন্নয়নের নতুন সম্ভাবনাকে জাগ্রত করবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ভোরের আকাশ/নি