logo
আপডেট : ১৪ জুন, ২০২৩ ১০:১১
বিশ্ব রক্তদাতা দিবস আজ
স্বেচ্ছায় রক্তদান বাড়ছে না
নিখিল মানখিন

স্বেচ্ছায় রক্তদান বাড়ছে না

নিখিল মানখিন: রক্তদান একটি মহৎ সেবা। রক্তের প্রয়োজনে জীবাণুমুক্ত নিরাপদ রক্তই রোগীকে নতুন জীবন দিতে পারে। তবে রক্ত যেমন একদিকে জীবন রক্ষা করে; অন্যদিকে অনিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনে বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

 

তারা বলেন, জটিল রোগ থেকে নিরাপদ থাকার একমাত্র উপায় হচ্ছে পেশাদার রক্তদাতা থেকে রক্ত গ্রহণে বিরত থাকা এবং স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের থেকে রক্ত গ্রহণ করা। দেশে স্বেচ্ছা রক্তদাতা এবং আত্মীয় রক্তদাতার হার বেড়েছে বলে দাবি করেছে সরকার। কিন্তু দেশের সব ক’টি রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র সরকারি নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই রক্ত গ্রহণকারীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

 

বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে জানান, প্রতি চার মাস অন্তর একজন সুস্থ ব্যক্তি রক্ত দান করতে পারে। স্বেচ্ছায় রক্তদান সর্বোত্তম সেবা। স্বেচ্ছায় রক্তদান করলে বারডেমের পক্ষ থেকে একটি কোটপিন দেয়া হয়। আর দেয়া হয় ভল্যুন্টারি ডোনার কার্ড দেয়া হয়, যা রক্তদানের ছয় মাস পর থেকে যেকোনো রক্তের প্রয়োজনে সম্পূর্ণ নিবামূল্যে আপনার প্রেরণকৃত ডোনারের জন্য সেবা প্রদানে বাধ্য থাকে।

 

তিনি আরো বলেন, রক্তদানের আগে ডোনারদের অ্যালকোহল পান বা ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। রক্তদানের আধাঘণ্টা পূর্বে চা-কফি খাওয়া থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। খাবার গ্রহণ করে আসতে হবে। সুস্থ ব্যক্তি আদর্শ রক্তদাতা। ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার, হাঁপানি, জ্বর ইত্যাদি থাকলে রক্তদান থেকে বিরত থাকতে হবে।

 

তিনি আরো জানান, রক্তদানের পর ডোনারকে তরল জাতীয় খাবার (যেমন জুস) গ্রহণ করা দরকার। প্রচুর (প্রায় ৩ লিটার) পানি বা পানীয় পান করা উচিত। নিতে হবে বিশ্রাম। ভারী কাজ, গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে। আর দুধজাতীয় খাদ্য রক্তদানের ১ ঘণ্টা পর খেতে পারেন।

 

রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর ভোরের আকাশকে বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালন করা হয় বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। তবে আমাদের দেশে স্বেচ্ছায় রক্তদাতা মাত্র ৩১ শতাংশ। দেশের রক্তদাতার প্রধান উৎস হলো রিপ্লেসমেন্ট ডোনার বা রিলেটিভ ডোনার।

 

যেমন আপনার প্রয়োজনে আপনার আত্মীয়স্বজন এসে রক্ত দিল। আমাদের দেশে বছরে প্রায় ৮ লাখ ইউনিট রক্তের প্রয়োজন হয়। বিশ্ব সংস্থার একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এর মধ্যে ৭ লাখ ইউনিট রক্ত সংগ্রহ করা হয় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এ ৭ লাখের মধ্যে ৩১ শতাংশ হলো স্বেচ্ছায় রক্তদাতার মাধ্যমে আর বাকিটা রিপ্লেসমেন্ট ডোনার বা রিলেটিভ ডোনারের মাধ্যমে আসে।

 

তাই বছরে এখনো কিন্তু ১ লাখ ব্যাগ রক্তের ঘাটতি রয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৬২টি দেশে শতভাগ স্বেচ্ছা রক্তদানের মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। উন্নত বিশ্বে স্বেচ্ছা রক্তদানের হার প্রতি ১ হাজারে ৪০ এবং উন্নয়নশীল বিশ্বে প্রতি হাজারে ৪ জনেরও কম।

 

ডা. আলমগীর বলেন, রক্ত মানবদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পূর্ণমাত্রায় রক্ত থাকলে মানবদেহ থাকে সজীব ও সক্রিয়। আর রক্তশূন্যতা বা এনিমিয়া দেখা দিলেই শরীর অকেজো ও দুর্বল হয়ে প্রাণশক্তিতে ভাটা পড়ে। আর এ অতি প্রয়োজনীয় জিনিসটি কারখানায় তৈরি হয় না। বিজ্ঞানীদের যথাসাধ্য চেষ্টা সত্ত্বেও এখনো রক্তের বিকল্প তৈরি করা সম্ভব হয়নি, নিকট ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে এমনটাও আসা করা যায় না।

 

মানুয়ের রক্তের প্রয়োজনে মানুষকেই রক্ত দিতে হয়, জীবন বাঁচানোর জন্য রক্তদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রমানুষের শরীরে রক্তের প্রয়োজনীয়তা এত বেশি যে, রক্ত ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না। মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাতে প্রায়ই জরুরি রক্ত দেয়ার প্রয়োজন হয়।

 

যেমন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে, রক্তবমি বা পায়খানার সঙ্গে রক্ত গেলে, দুর্ঘটনায় আহত রোগী, অস্ত্রোপচারের রোগী, সন্তান প্রসবকালে, ক্যান্সার বা অন্যান্য জটিল রোগ, এনিমিয়া, থ্যালাসেমিয়া, হিমোফিলিয়া, ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার ইত্যাদি রোগের কারণে রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন পড়ে। এছাড়া বর্তমানে অঙ্গ প্রতিস্থাপন শুরু হয়েছে, যা সফল করতে প্রচুর রক্তের প্রয়োজন হয়।

 

এদিকে অভিযোগ রয়েছে, দেশের শতকরা ৮১ ভাগ রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র অনুমোদনহীন। রক্ত সংগ্রহের সময় বাধ্যতামূলক পাঁচটি পরিসঞ্চালন সংক্রমণ পরীক্ষা করা হয় না শতকরা ৫০ ভাগ কেন্দ্রে। রক্ত পরিসঞ্চালন কার্যক্রম তত্ত্বাবধানের কাজে নিয়োজিত লোকদের শতকরা ৭৪ ভাগ নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন বিষয়ে সম্যক জ্ঞান রাখেন না। এসব কেন্দ্র থেকে সরবরাহকৃত রক্ত গ্রহণে সবসময় ঝুঁকি রয়ে যায়। আশঙ্কা থাকে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার। বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। আর বেসরকারিভাবে গড়ে ওঠা ব্লাড ব্যাংকগুলোয় রক্ত পরিসঞ্চালন হয় এমন অধিকাংশ রক্তই মাদকসেবীদের বলে জানা গেছে।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক মো. আসাদুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, দেশব্যাপী ব্লাড ব্যাগ, কিটস ও রি-এজেন্ট সংকটের কারণে রক্তের গ্রাহকরা নিজের অর্থায়নে ব্যাগ ও কিট কিনে নিচ্ছেন। রক্তদানের আগে যে ৫ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কথা সেটাও অধিকাংশ সেন্টারে করা হচ্ছে না। ফলে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রক্তগ্রহীতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রক্তদানের আগে অত্যাবশ্যকীয় পাঁচটি পরীক্ষার বিধান রেখেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে মাঠপর্যায়ে এর বাস্তবায়ন নেই। স্বল্প পরিসরে যতটুকু নিরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে তাকে গত তিন বছরে দেশে ১৩৯ জনের দেহে প্রাণঘাতী এইচআইভি এইডস শনাক্ত হয়েছে। ফলে পরীক্ষা ছাড়া রক্ত গ্রহণে হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, এইচআইভিসহ প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির মাধ্যমে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে ৯৯টি এবং ইউএইচসি তথা উপজেলা হেলথ কেয়ার কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারিভাবে ১২৪টি ব্লাড ব্যাংক পরিচালনা করা হয়। তবে করোনাকালে কেন্দ্রীয়ভাবে অর্থ বরাদ্দ না থাকায় ব্লাড ব্যাংক ও পরিসঞ্চালন কেন্দ্রে রক্তের ব্যাগ, রি-এজেন্টসহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অর্থের জোগান না থাকাকে উপকরণ সংকটের মূল কারণ বলছে অধিদপ্তর।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থায় বছরে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ ব্যাগ রক্ত দরকার হয়। সারা দেশে সরকারিভাবে ২২৩টি ব্লাড ব্যাংক বা রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচির মাধ্যমে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে ৯৯টি এবং ইউএইচসি তথা উপজেলা হেলথ কেয়ারের কর্মসূচির মাধ্যমে ১২৪টি সরকারি ব্লাড ব্যাংক রয়েছে।

 

এর মধ্যে বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও বিশেষায়িত ব্লাড ব্যাংকে রক্তদাতাদের স্ক্রিনিং করে ২০১৯ সালে ৬৪, ২০২০ সালে ৪৭ ও ২০২১ সালে ২৮ জনের এইডস শনাক্ত হয়।

 

একই সময়ে ১৬ হাজার ৯১০ জন স্বেচ্ছা রক্তদাতার শরীরে হেপাটাইটিস-বি ও ৮৪৭ জনের হেপাইটিস-সি ভাইরাস শনাক্ত হয়।

 

এছাড়া ২০১৯ ও ২০২০ সালে ২ হাজার ২১২ জনের যৌনবাহিত সিফিলিস রোগ ধরা পড়ে।

 

ভোরের আকাশ/নি