logo
আপডেট : ১৪ জুন, ২০২৩ ১০:২৯
এলো নিনোর কালো নিশ্বাস আবহাওয়ায়
শাহীন রহমান

এলো নিনোর কালো নিশ্বাস আবহাওয়ায়

শাহীন রহমান: এ বছর এপ্রিল মাসজুড়ের টানা তাপপ্রবাহের কবলে ছিল দেশ। মে মাসে কমবেশি বৃষ্টি হলেও জুনের শুরু থেকে আবার দাবদাহের কবলে পড়েছে দেশ। তাপপ্রবাহের কারণে দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্র উঠে যায় প্রায় ৪৩ ডিগ্রির ওপরে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছর প্রথম থেকেই গরম স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। এবারের তাপপ্রবাহ এমন পর্যায় পৌঁছেছে যে, আবহাওয়া অধিদপ্তরকে সতর্কতা জারি করতে হয়েছে।

 

অব্যাহত এ উষ্ণায়নের কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, ৫ বছর পর আবহাওয়ায় ‘এল নিনো’ ফিরেছে। ফলে প্রকৃতি দ্রুতই উষ্ণ হয়ে পড়ছে। তারা মনে করছেন, প্রশান্ত মহাসাগরে সৃষ্ট উষ্ণ স্রোতের প্রভাবে কারণে এ অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। এই এল নিনোর কারণে আগামীতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে গিয়ে অব্যাহত খরা পরিস্থিতি হতে পারে। এমনকি বর্ষায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের দেখা নাও মিলতে পারে।

 

তাদের মতে, এল নিনোর প্রভাবে তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়তে পারে। এমনকি তাপমাত্রার নতুন রেকর্ডও তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তারা বলছেন, গত এপ্রিলে টানা দাবদাহের কারণে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠে যায় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা ঈশ্বরদীতে রেকর্ড করা হয়। দেশে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বর্ষা (মৌসুমি বায়ু) থাকে। এর প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।

 

কিন্তু এবার দেশে মৌসুমি অনেক দেরিতে ঢুকেছে একই কারণে। এখনো সারা দেশে বিস্তার করেনি।

 

তারা বলছেন, এল নিনোর প্রভাবে এবার বর্ষায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক কমে যেতে পারে। এছাড়া এ বর্ষায় ফসল উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।

 

আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, এল নিনো এবং লা নিনা উভয় আবহাওয়ার বিরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এল নিনো উষ্ণতা বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে লা নিনা তাপমাত্রা কমে গেলেও এর বিপুল প্রভাব পড়ে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এল নিনো হলো আবহাওয়ার এটা বিশেষ পরিস্থিতি। ইউএস ন্যাশনাল ওশিয়ানিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফিয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা নোয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে এ বছরের শেষভাগ অর্থাৎ শীতের দিকে এল নিনো দাপট বেশি দেখাতে পারে।

 

তারা জানান, এর প্রভাবে প্রশান্ত মহাসাগরের উপরিতলের তাপমাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চরমভবাপন্ন আবহাওয়া তৈরি করতে পারে। যার ফলে দেশে দুর্বল বর্ষা দেখা দিতে পারে। এই এল নিনোর ফলে বিশ্বের কোথাও চরম গরম আবার কোথাও খুব বর্ষণ দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে যদি বর্ষায় এল নিনো প্রভাব ফেলে, তাহলে কৃষি উৎপাদনে যথেষ্ট ক্ষতি হতে পারে।

 

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনওএএ) বিজ্ঞানীরা বলেছেন, পূর্বাভাস অনুযায়ী এল নিনো জলবায়ু পরিস্থিতি শুরু হয়ে গেছে। এতে আবহাওয়া ও তাপমাত্রা চরম রূপ ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

 

বিজ্ঞানীরা বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রার চেয়ে মধ্য ও পূর্বাঞ্চলীয় প্রশান্ত মহাসাগর বেশি উষ্ণ হয়ে আছে।

 

সর্বশেষ ২০১৮-১৯ সালে এ ধরনের এল নিনো পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল। গড়ে ২ থেকে ৭ বছর পরপর এল নিনো পরিস্থিতি হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এল নিনো একটি উষ্ণ সামুদ্রিক স্রোত। যার প্রভাব পড়ে বিভিন্ন দেশের আবহাওয়ায়। পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের পশ্চিম উপকূলঘেঁষে পেরু, ইকুয়েডর বরাবর কোনো কোনো বছর ডিসেম্বর মাস নাগাদ এক প্রকার উষ্ণ দক্ষিণমুখী স্রোতের সৃষ্টি হয়। এরই নাম এল নিনো। এল নিনো স্প্যানিশ শব্দ। এর অর্থ ছোট্ট ছেলে। পেরু, ইকুয়েডর উপক‚লেই মাঝেমাঝে এল নিনোর বিপরীত একটি শীতল স্রোত সৃষ্টি হয়। তার নাম লা নিনা। দুই স্রোতের প্রভাব পড়ে বিশ্বের আবহাওয়ায়।

 

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এ ‘এল নিনো’ অতি উত্তপ্ত এ বিশ্ব আগামী কয়েক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো তাপমাত্রা বৃদ্ধির সর্বোচ্চ সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

 

তারা বলছেন, ২০২৭ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে ৬৬ শতাংশ।

 

এর কারণে হিসেবে তারা বলছেন, আবহাওয়ায় এল নিনোর উপস্থিতি। আবহাওয়ায় এল নিনো সক্রিয় থাকলে মধ্য ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উষ্ণতা বাড়ে। গত তিন বছর ধরে বিশ্ব লা নিনার মুখোমুখি হয়েছে, যা জলবায়ু উষ্ণায়নকে কিছুটা হলেও কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এল নিনোর প্রভাবে বিশ্বে যে অতিরিক্ত তাপ তৈরি হবে তার প্রভাবে আগামী বছর উষ্ণতা বাড়বে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা।

 

তারা বলছেন, এল নিনোর প্রভাবে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরে উত্তরমুখী শীতল পেরু স্রোত বাধাপ্রাপ্ত হয়। ওই অঞ্চলে মৎস্য চাষে ব্যাঘাত ঘটে। সামুদ্রিক প্রাণী এবং পাখিদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে এ স্রোতের প্রভাবে। দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে এল নিনো নিম্নচাপের সৃষ্টি করে। যার ফলে ওই এলাকায় অসময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। তবে এ উষ্ণ স্রোতের প্রভাবে শুধু পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরেই সীমাবদ্ধ থাকে না।

 

নিরক্ষরেখা বরাবর প্রশান্ত মহাসাগরের জল এল নিনোর প্রভাবে ধারাবাহিকভাবে উষ্ণ হতে শুরু করে। এর ফলে কোথাও অতিবৃষ্টিতে বন্যা, কোথাও অনাবৃষ্টিতে খরার পরিস্থিতি তৈরি হয়।

 

পরিসংখ্যান তুলে ধরে তারা বলেন, ১৯০০ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত প্রশান্ত মহাসাগরে সাতবার এল নিনোর সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে এল নিনোর দেখা মিলেছে অন্তত ১৫ বার। এল নিনোর এ ১৫টি বছরের মধ্যে ৯ বার দেশে বর্ষাকালে পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি হয়নি।

 

স্বাভাবিকের তুলনায় অনেকটাই কম বৃষ্টি হয়েছে এ বছরগুলোয়। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ার কারণে কৃষি ব্যবস্থা প্রভূত ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ঠিক সময়ে সংশ্লিষ্ট ফসল উৎপাদিত হয় না। চাহিদা অনুযায়ী জোগান না থাকায় মূল্যবৃদ্ধিও হয়ে পড়ে অবধারিত। অতীতে এল নিনোর বছরগুলোয় এ ভাবেই ভুগতে হয়েছে।

 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের অতিক্রম করলে বিপজ্জনক হয়ে পড়বে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং মানুষের জীবন। এর প্রভাবে কোথায় বৃষ্টিপাতের মাত্রা প্রচন্ড ভাবে বেড়ে গিয়ে ঘন ঘন বন্যা হবে। সাগরের উচ্চতা বেড়ে প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের ছোট অনেক দ্বীপ বা দ্বীপরাষ্ট্র বিলীন হয়ে যেতে পারে। অনেক দেশে খরার প্রকোপ বাড়তে পারে। পরিণতিতে খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে।

 

ভোরের আকাশ/নি