কুমিল্লার দক্ষিণাঞ্চলের লাকসাম, লালমাই, বরুড়া, নাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জ উপজেলাজুড়ে একটা সময় খাঁন ও বিহারী সম্প্রদায় কিংবা বেহারাদের নানা গানের সুরে সুরে বিয়ে অনুষ্ঠানে বর-কনের একমাত্র বাহন ছিল গ্রামবাংলার চিরায়ত জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী পালকি। চলমান প্রযুক্তির ঢামাঢোলে আজ সবই হারিয়ে গেছে। কালের আবর্তে হারিয়ে শুধু অতীত স্মৃতি হয়ে কল্পনায় ভাসছে সেই মধুর দিনগুলো।
এ অঞ্চলে অবস্থানরত পশ্চিমাদেশের বিহারী সম্প্রদায়ের নতুন প্রজন্মের একাধিক সূত্র বলেন, আমাদের পূর্ব পুরুষদের পেশা ছিল এ পালকি দিয়ে বিয়ে অনুষ্ঠানে বর-কনে পারাপারের বাহন। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে এখন আর পালকি পেশা নাই।
দাদা-পিতার মৃত্যুর পর আমরা পালকির এ পেশার দিকে না ঝুঁকে অন্য পেশা নিয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছি। ওই সময় দেখা যেত বিয়ে অনুষ্ঠানে বর-কনেকে কাঁধে নিয়ে বরের বাড়ি থেকে কনের বাড়ি অথবা কনের বাড়ি থেকে বরের বাড়ি পালকি নিয়ে যাওয়ার অপরূপ দৃশ্য।
সেই সাথে পালকি বেহারার কণ্ঠে গান শুনা যেত। রাস্তা দিয়ে বর-কনে আসছে শুনে ঘর থেকে বের হয়ে আসত এ অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা। এখন আর সে দৃশ্য নাই বললেই চলে। পালকির সামনে-পিছনে বর-কনের ৬-৭ জন স্বজন আর মাঝখানে বেহারা দু’জন মধুর কণ্ঠে গান গেয়ে ছুটে চলত গন্তব্যস্থলে। এভাবেই বহন করা হতো বিয়ে অনুষ্ঠানে বর-কনেকে পালকি নামক বাহন দিয়েই।
সূত্রগুলো আরো জানায়, জেলার দক্ষিণাঞ্চল তথা বৃহত্তর লাকসামের বাণিজ্যিক নগরীখ্যাত লাকসাম দৌলতগঞ্জ নোয়াখালী রেলগেটের উত্তর পাশে সারি সারিভাবে থাকত পালকি ও বেহারার দল। তখনকার সময় প্রায়ই ৩০-৩৫টি ওই সম্প্রদায়ের পরিবার পালকি বাহন পেশায় জড়িত ছিল। কিন্তু এখন আর তাদের ওই পেশার অস্তিত্ব বলতে কিছুই নেই।
তবে পালকি বাহন পেশার সাথে জড়িতদের এ অঞ্চলের মানুষ বেহারা বলে চিনত। লাকসাম পৌর শহরের একটি পাড়ায় এখনো ঘরের চালের সাথে ভাঙ্গাচুড়া পালকি বাহনটি সংযুক্ত সরঞ্জামসহ তুলে রাখার চিত্র পাওয়া যায়। আবার অভাবের তাড়নায় কেউ কেউ পেশা পরিবর্তন করে অন্য পেশায় এবং কেউ কেউ চলে গেছেন বিভিন্ন শহরে কিংবা নিজ জন্মস্থানে।
স্থানীয় বয়ঃবৃদ্ধদের একাধিক সূত্র জানায়, এ পেশার সাথে জড়িত বেহারা পরিবারগুলো ছিল অনেকটাই অভাবী পরিবার। বাংলা নববর্ষে বিয়ের মৌসুম এলেই বিয়ে অনুষ্ঠানে বর-কনে বহন করতে পালকি ছাড়া বিকল্প কোনো বাহন ছিল না। মাসে ৮-১০টি বিয়ের ভাড়া দিয়েই চলত তাদের সংসার। বছরের বেশিরভাগ সময় তারা বসে বসে দিন গুণত কখন কোন এলাকার লোকজন এসে পালকি বায়না করবে।
আজ সবকিছু যেন অতীত। নতুন প্রজন্মের কাছে পালকির গল্পটা যেন একটা ইতিহাস। ১৯৯০ সালের পূর্বে এ বাহন পালকির ভাড়া প্রতিটা ৫শ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত গন্তব্য এলাকা বুঝে দর হাঁকাত তারা। আনন্দ-উল্লাস করে এলাকার মানুষদের কেউ কেউ ওইসময় পালকি ভাড়া নিয়ে থাকত। বিয়ে অনুষ্ঠান ব্যতিত বেহারারা পালকি ভাড়ায় যেত না। ৯০ দশকের পর প্রযুক্তিযুগে দেশ অনেকটাই এগিয়ে গেলেও গ্রাম-বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য পালকির কদর এখন আর নেই।
এ ব্যাপারে পালকি ব্যবসার সাথে জড়িত বিহারী কিংবা খাঁন পরিবার সম্প্রদায়ের লোকজন এবং পালকি বেহারাদের স্বজনদের কাছ থেকে বারবার চেষ্টা করেও কোনো তথ্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
ভোরের আকাশ/নি