logo
আপডেট : ১৭ জুন, ২০২৩ ১২:৩২
মানবতা
জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের বৈশ্বিক প্রবণতা
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন

জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের বৈশ্বিক প্রবণতা

গত ১৪ জুন ইউএনএইচসিআর বা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা তাদের ‘গ্লোবাল ট্রেন্ডস ইন ফোর্সড ডিসপ্লেসমেন্ট’ বা ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের বৈশ্বিক প্রবণতা’ নামক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বে বর্তমানে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি। গত বছরের শেষ নাগাদ এ সংখ্যা ছিল ১০ কোটি ৪৮ লাখ। ২০২১ সালের তুলনায় এটা প্রায় ১ কোটি ৯১ লাখ বেশি।

 

আর বর্তমানে সেটা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ কোটি। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০২২ সালেই প্রায় ৩ কোটি ৫৩ লাখ লোক নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পালিয়েছে। এক বছরের মধ্যেই প্রায় সাড়ে ৩ কোটি লোক নিজ দেশ থেকে অন্য দেশে বাস্তুচ্যুত হয়েছে, এটা যে কোনো বিচারেই আতঙ্কের বিষয়।

 

এছাড়া প্রায় ৬ কোটি ২৫ লাখ লোক নিজ দেশেই অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান বলছেন, ‘এই ক্রমবর্ধমান সংখ্যা আশঙ্কাজনক এবং নিন্দনীয়।’ এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বে কেন জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা এভাবে বাড়ছে? পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এমন কী পরিস্থিতি বিরাজ করছে যে, মানুষ নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পালাতে বাধ্য হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর জানাটা জরুরি।

 

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, যখন কোনো মানুষ বা জনগোষ্ঠী নির্যাতন, সংঘাত, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড, ক্রমবর্ধমান নৈরাজ্য (ডিস্টার্বিং পাবলিক অর্ডার) এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় গ্রহণ করে, তখন তাকে ‘ফোর্স ডিসপ্লোজড’ বা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত বলা হয়।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা কমানোর জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। জাতিসংঘসহ পশ্চিমা বিশ্ব নানাভাবে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা যাতে না বৃদ্ধি পায় সে জন্য নানা ধরনের আইন-কানুন প্রণয়ন করেছে যাকে বলা হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক’ অথবা ‘ইন্টারন্যাশনাল প্রটেকশন রেজিম’।

 

যেমন ১৯৫১ সালের আন্তর্জাতিক রিফিউজি কনভেনশন, ১৯৬৭ সালের রিফিউজি প্রটোকল, ১৯৫৪ সালের কনভেনশন রিলেটিং টু দ্য স্ট্যাটাস অব স্টেটলেস পিপল, ১৯৬১ সালের কনভেনশন অন দ্য রিডাকশন অব স্টেটলেসনেস, ১৯৬৭ সালের ডিকলারেশন অব টেরিটরিয়াল এসাইলাম এবং ১৯৯৫ সালের ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন অন দ্য এলিমিনেশন অব অল ফর্মস অব রেসিয়াল ডিসক্রিমিনেশন প্রভৃতি।

 

এছাড়া ইউরোপ, আফ্রিকা, আরব দেশ এবং এশিয়ার দেশগুলোয় শরণার্থী ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা যাতে বৃদ্ধি না হয়, তার জন্য নানা আইনি সুরক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের (যা ঘোষণা করা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে) ৭৫ বছর পরও পৃথিবী দেশে দেশে শরণার্থীর সংখ্যা, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা, আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা এবং রাষ্ট্রহীন মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্যানুযায়ী বর্তমানে পৃথিবীতে শরণার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ কোটি।

 

ভিন্ন দেশের আশ্রয়প্রার্থীর (এসাইলাম শিকার) সংখ্যা প্রায় ৫৪ লাখ। অন্তত এক কোটি লোক বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্রবিহীন মানুষ হিসেবে পরিচিত। তার সঙ্গে যুক্ত আছে ১১ কোটি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষ এবং ৬ কোটি ২৫ লাখ নিজ দেশে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষ। পরিসংখ্যান দেখেই উপলব্ধি করা যায়, পৃথিবীতে শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত, রাষ্ট্রবিহীন মানুষ এবং অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। সংখ্যার এ ক্রমবর্ধমান প্রবণতার দায়-দায়িত্ব জাতিসংঘসহ বিশ্ববাসীকে অবশ্যই নিতে হবে।

 

জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা কেন বর্তমানে ১১ কোটিতে গিয়ে পৌঁছেছে, তার কারণ হিসেবে গত ১৪ জুন প্রকাশিত জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সংঘাত, নিপীড়ন, দ্ব›দ্ব ও বৈষম্যের কারণে মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।’ তাছাড়া আরো বলা হয়েছে, ‘ইউক্রেন বনাম রাশিয়ার যুদ্ধ, তালেবানের আফগানিস্তান দখল এবং সুদানের গৃহযুদ্ধের কারণে নিজ দেশ থেকে পালানো মানুষের সংখ্যা অর্থাৎ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা এভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।’

 

তখন প্রশ্ন আসে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য কে দায়ী? কেন ইউক্রেনের সাধারণ জনগণকে এর মূল্য দিতে হবে? কেন প্রায় ৪০ লাখ ইউক্রেনিয়ানকে অন্য দেশে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষ হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে? এর জন্য কে দায়ী? কিংবা একইভাবে প্রশ্ন করা যায়, আফগানিস্তানের আজকের এ পরিণতির জন্য কে দায়ী? কেন লাখ লাখ আফগানকে শরণার্থী হয়ে ভিন্ন দেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়? কেন লাখ লাখ আফগান জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষ হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে? এর জন্য কে দায়ী? একই প্রশ্ন প্রযোজ্য সুদানি শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও।

 

কিন্তু জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডি রাশিয়া বনাম ইউক্রেন, আফগান শরণার্থী এবং সুদান শরণার্থীর কথা বললেও বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী প্রায় ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীর কথা তিনি প্রেস কনফারেন্সে বলেননি। এবং রোহিঙ্গাদের কথা আন্তর্জাতিক ফোরামে ইদানীং যত্ন করে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ প্রশ্নগুলো রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কেন আজ বাংলাদেশে প্রায় ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী হয়ে জীবনযাপন করছে? কেন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর ২০১৭ সালে জেনোসাইড সংঘটন করা হয়েছিল? কেন রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ থেকে রক্ষা করা যায়নি? এর জন্য দায়ী কে? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা দরকার। অন্যথায় পৃথিবীতে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে। বিশ্ব সম্প্রদায়কে এর দায়-দায়িত্ব নিতে হবে।

 

এখানে মনে রাখা জরুরি যে, আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির বলি হয়ে লাখ লাখ মানুষ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। ফলে পশ্চিমা পুঁজিবাদী, ধনবাদী রাষ্ট্রগুলো এর দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে বিভিন্ন দেশে আগ্রাসন চালানোর খেসারত দিতে হয় সে দেশের সাধারণ মানুষকে। এসব আধিপত্য বিস্তারে এবং সাম্রাজ্য বিস্তারে যাদের হাত রয়েছে, তাদের এ ক্রমবর্ধমান জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যার দায়-দায়িত্ব নিতে হবে।

 

এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাতিগত সংখ্যালঘু, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং সাংস্কৃতিকভাবে ভিন্ন মানুষের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন ও অত্যাচার বেড়েই চলেছে। ফলে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, নির্যাতন ও অত্যাচারের হাত থেকে সাধারণ জনগণকে সুরক্ষা দিতে না পারার দায়-দায়িত্বও জাতিসংঘসহ তথাকথিত মানবাধিকার সুরক্ষার ‘ডিলার’দের নিতে হবে। ‘গ্লোবাল জাস্টিস’ বা ‘সর্বজনীন মানবাধিকার’ প্রভৃতির তাত্তি¡ক কাঠামোতেও বিশ্ব নাগরিক হিসেবে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব বিশ্ব সম্প্রদায়ের। তাই জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির ঘটনাকে কেন্দ্র করে বলেছেন, ‘এমন একটা প্রতিবেদন হচ্ছে, যার জন্য পুরো বিশ্বকেই অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

 

এই জোরপূর্বক স্থানচ্যুতির সমাধান এতই কঠিন হয়ে উঠছে যে তার সমাধান তো দূর, টেবিলে আলোচনার জন্যই তোলা যাচ্ছে না। মেরুকরণ প্রবল এমন একটি বিশ্বে আছি আমরা, যেখানে আন্তর্জাতিক উত্তেজনা যাবতীয় মানবিক ইস্যুকে খারিজ করে দিচ্ছে।’ জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধানের কথায় ক্ষোভ আছে, আক্ষেপ আছে এবং বাস্তবতার ছাপ আছে কিন্তু কোনো সমাধান নেই। আমাদের এ সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। কথা নয়, কাজ প্রয়োজন। প্রতিবেদন নয়, প্রতিরোধ জরুরি। প্রতিষেধক প্রয়োজন।

 

লেখক : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ভোরের আকাশ/নি