logo
আপডেট : ১৮ জুন, ২০২৩ ১৭:৫৯
জন্ম মৃত্তিকা
নদের চাঁদ ফকির

জন্ম মৃত্তিকা

এক

ভোররাতে ঘুম ভাঙ্গে বলাকার। আড়মোড় ভেঙ্গে উঠে বসে। ভাবতে থাকে কিছুক্ষণ আগে দেখা স্বপ্নের কথা। এমন স্বপ্ন কেন দেখল সে! মা-বাবা দুজন এক সঙ্গে ছোট ভাইটাকে নিয়ে কোথায় যেন বেড়াতে যাচ্ছেন। আর ভাইটাও নাছোড় বান্দা। বায়না যখন ধরেছে, তখন যাবেই। বলাকা বারবার নিষেধ করেও তাকে থামাতে পারছে না। আর বাবা-মায়েরও অমত নেই রতনকে সঙ্গে নিতে। বলাকার বাধা অমান্য করে সে নতুন পোশাক পরে মা-বাবার সঙ্গে চলে যাচ্ছে। সে ভাবে এমন স্বপ্ন দেখা তো ভালো নয়।

 

মুদ্দারের সঙ্গে চলে যাওয়া তো অমঙ্গল। ছোটবেলায় দাদীর কাছে বারবার সে এ কথা শুনেছে। তবে কি তার কোনো বিপদ আসছে! ভেবে গা শিরশির করে ওঠে বলাকার। ভাইটার কোনো সমস্যা হয়নি তো। সেই ৫ বছর আগে শেষবারের মতো বাপের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছে সে। এর মধ্যে যাব যাব করে আর যাওয়া হয়নি। আজ কয়েক দিন ধরে সেখানে যাওয়ার জন্য তার মন ছুটেছে। এর পর আজকের স্বপ্ন আরো দুর্ভাবনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাবতে ভাবতে এক সময় সে শব্দ করে কাঁদতে শুরু করে। কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙ্গে স্বামী রহিমের। অপ্রস্তুত রহিম স্ত্রীর কাছে কি হয়েছে তা জানতে চাই। সব শুনে রহিম বলাকা কে বোঝানোর চেষ্টা করে। স্বপ্ন স্বপ্নই। এর সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। কিন্তু কিছুতেই বোঝে না বলাকা। অবশেষে সকালে তাকে বাপের বাড়ি পাঠানো হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয় রহিম।

 

দুই

সকাল না হতেই বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হয় বলাকা। নিজের বাড়ি থেকে ভাইদের জন্য কিছু ফল ও অন্যান্য সামগ্রী সঙ্গে নেয়। ছোট ভাইটা ভাপা পিঠা খেতে পছন্দ করে। সে কারণে সাত সকলে উঠে পিঠা তৈরি করেছে সে। চোখমুখে এক অজানা আনন্দ। বিষয়টি লক্ষ্য করে তার স্বামী। ৮টা নাগাদ ভ্যান চলে আসে। বলাকা তার ছেলে চন্দনকে নিয়ে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্য যাত্রা করে। মেঠো পথ দিয়ে ভ্যান চলতে থাকে। কিছু সময়ের মধ্যে ছোট রাস্তা ছেড়ে বড় রাস্তায় আসে তারা। এতক্ষণ মা ছেলে উভয় চুপ করে ছিল। এবার কথা বলে বলাকা।

 

বাড়ি থেকে আসার সময় তোর বাপকে তো ঠিক মতো বলেও আসলাম না। লোকটা মন খারাপ করেছে কি না কে জানে। তাছাড়া বউমাকে কিছু বুঝিয়ে দিয়ে আসা হয়নি। তাকে আশ্বস্ত করে ছেলে চন্দন। কোনো চিন্তা করো না মা, আব্বাকে সব বলে এসেছি। তোমার বউ মাকেও বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি সব। শান্ত হয়ে যায় বলাকা। বাপের বাড়ি যেতে আর কতক্ষণ লাগবে গুনতে থাকে। অনেকদিন পর তার বাল্য সাথীদের কথা মনে পড়ে। জীবনের নিয়মে সবাই এখন ভাঙ্গা হাটের হাটুরিয়া। কেউ কেউ ইতিমধ্যে পৃথিবী ত্যাগ করেছে।

 

যারা বেঁচে আছে তাদের সবার সঙ্গে আর দেখা হবে কি না সে ভাবতে থাকে। কপাল ভালো হলে হয়তো দুএকজনের সাথে দেখা হবে। বড় রাস্তা ছেড়ে আবারো গাঁয়ের চেনা রাস্তা ধরে ভ্যান। এই গ্রাম চেনা বলাকার। এটি তার ফুফুবাড়ির গ্রাম হিজল ডাঙ্গা। বলাকার চোখে পড়ে রইস মাঝির দিঘি। পাড়ের বকুল গাছগুলো শীতল ছায়া দিয়ে রেখেছে দিঘিটিকে। পাড়ে তাল, নারকেল, আম গাছ বাঁশঝাড়ের জড়াজড়ি। এই দিঘির সাথে কত স্মৃতি বলাকার! ফুফুবাড়ির গ্রামে বাল্য সাথীদের সাথে সে কত এই দিঘিতে গোসল করতে আসত।

 

চোখের সামনে ভেসে ওঠে চৈত্রের দুপুরে সাথীদের নিয়ে দিঘিতে সাঁতার কাটার সেইসব দৃশ্য। এখানে সাঁতার কাটতে গিয়ে একদিন সে প্রায় ডুবে যাচ্ছিল। গফুর ভাই না থাকলে সেদিন হয়তো বেঁচে ফেরা হতো না তার। বলাকা স্থির করে নেমে কিছুক্ষণ দিঘির পাড়ে কিছুক্ষণ বসে যাবে। আবার হাত বুলিয়ে দেবে স্মৃতিচিহ্নে। হঠাৎ তার কল্পনায় ছোট ভাইয়ের মুখখানা ভেসে উঠে। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ড্রাইভারকে বলে দ্রত চালাতে।

 

তিন

বাপের বাড়িতে পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে যায়। ছোটভাই রতন তখন বারান্দায় বসে ছেলেকে পড়াচ্ছে। বলাকাকে দেখে সে ছুটে আসে। তার বয়স যেন কয়েক বছর কমে যায়। কাছে এসে বুবুকে জড়িয়ে ধরে। পরম মমতায় তাকে বুকে টেনে নেয় বলাকা। দুই ভাইবোন কিছুক্ষণ চোখের জল ঝরান। তাদের এই কান্ড দেখে সেখানে উপস্থিত অন্য মহিলাদের চোখে পানি এসে যায়। খবর পেয়ে বাজার থেকে ছুটে আসে অপর ভাই আলতাব। বুবুর পাশে বসে দীর্ঘক্ষণ কুশলাদি বিনিময় করে দুভাই। ভাইদের ছেলেমেয়ে ও বউরা খুশি হয়। তারা চন্দনকে অনুরোধ করে বলাকাকে কিছুদিন এখানে রেখে যেতে। রাজি হয় চন্দন।

 

বাপের বাড়িতে প্রথম কয়েকদিন ভালোই কাটে বলাকার। এর পর থেকে সে বউদের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে পায়। বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নেয় সে। ভাবে বউরা মনে হয় কোন কারণে অন্যমনস্ক। সে নিজের মতো করে চলতে থাকে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবার খোঁজখবর নেই। বাল্যসাথীদের সাথে সময় কাটায়। তার বাল্য সখী জাহানারার এই গ্রামেই বিয়ে হয়েছে। দুই সখী বসে বসে ফেলে আসা দিনের স্মৃতিচারণ করে। সুখ-দুঃখের আলাপ হয়। অনেক দিন পর তাকে কাছে পেয়ে ভালো লাগে জাহানারার। অল্প বয়সে বিধবা জাহানারা সখীর কাছে নানা বিষয় শেয়ার করে। বলাকাও তার যাপিত জীবনের গল্প করে বাল্য সখীর কাছে।

 

চার

দেখতে দেখতে বেশ কয়ে দিন হয়ে যায়। নিজ বাড়িতে ফেরার জন্য উতলা হয়ে ওঠে বলাকা। ভাইদের বারবার বলে তাকে রেখে আসতে। দুই ভাইয়ের আবদার বলাকা আরো কিছু থেকে যাক। কিন্তু সে আর থাকতে রাজি নয়। ইদানীং সে লক্ষ করেছে তার থাকা নিয়ে কথা উঠছে। বউরা প্রায় শুনছে সে কোন বেলা কার ঘরে খাবে। এর মধ্যে সে দিন ঘটে গেছে আর এক ঘটনা। দুপুরের খাবার খেতে রতনের ঘরে গিয়ে দেখে খাবার নেই। পরে বউ তাকে বলে বুবু আমি ভেবেছি আপনি বড় বুজির ঘরে খাবেন সেই জন্য আপনার চাউল দেয়া হয়নি।

 

একই কথা বলেছে বড় ভাইয়ের বউ। এর পর গাছ থেকে আম পাড়তে গেলে বড় বউ তাকে বাধা দিয়েছে। বলেছে বুবু আমার কাছে না শুনে আম পাড়তে গেছেন কেন। জানেন তো এটা ভাগের গাছ। সেদিন অবাক হয়েছিল বলাকা। দাদার আমলের এই গাছের সাথে তার কত স্মৃতি। ছোটবেলায় সে এই গাছ থেকে কত আম পেড়েছে তা ইয়াত্তা নেই। আজ সে গাছ থেকে তাকে আম পাড়তে বাধা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া আরো কয়েকটি ঘটনা তার মনে দাগ কেটে গেছে।

 

চিরচেনা বাড়িটা তার কাছে খুব বেশি অচেনা মনে হচ্ছে। ভাইদের কাছে এসব বলতে চাই না বলাকা। অযথা ঝামেলা করে লাভ কি। ভাইদের সংসারে অশান্তি হবে। এই ভেবে চুপ করে থাকে সে। অযাথা ঝামেলা পাকানো কোনোকালেই তার স্বভাবে ছিল না।

 

পাঁচ

বলাকা বাড়িতে না থাকায় ছেলে, ছেলের বউ ও স্বামী রহিম তার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। রহিম চন্দনকে বলে তার মাকে বাড়ি নিয়ে আসতে। বাবার কথা মতো মামা বাড়িতে হাজির হয় চন্দন। তাকে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচে বলাকা। আজই সে স্বামীর বাড়িতে চলে যাবে বলে স্থির করে। কিন্তু বাদসাধে ভাইয়েরা। এখন রওনা হলে বাড়ি যেতে অনেক রাত হয়ে যাবে। তারা চন্দকে অনুরোধ করে। মামাদের কথামতো রাতটুকু থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় চন্দন। পরের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে বলাকা। বাড়ির পিছনে শিউলী গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়।

 

এখানে তার বাবা-মা, দাদা-দাদীর কবর। কবর পাড়ে দাঁড়িয়ে তার মন কেঁদে ওঠে। কাল সে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য মরিয়া ছিল। কিন্তু আজ ইচ্ছে হচ্ছে না বাপের ভিটে ছেড়ে যেতে। সে শিউলী গাছের নিচে বসে। দুহাত দিয়ে কিছু মাটি তুলে নেয়। এই মাটির মধ্যে কি যে এক মায়া লুকিয়ে আছে সে ভেবে পায় না। এই মাটি তার জন্ম মাটি। এই মাটি গায়ে মেখে সে বড় হয়েছে। এই মাটিতে পা রাখলে তার মধ্যে এক অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে। অথচ স্বামীর বাড়ির মাটির প্রতি তার এমন টান নেই। সেটা অন্য টান। কিন্তু জন্ম স্মৃতি এখানেই।

 

কি ভেবে আবার বাড়ির মধ্যে চলে যায় বলাকা। রান্নাঘর থেকে বঁটি নিয়ে এসে আবারো শিউলী গাছের নিচে বসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু মাটি তুলে ব্যাগে রাখে। তুলে নেয় কিছু শিউলী ফুলের বিচি। বলাকা ভাবে এই মাটিতে যদি তার শেষ ঠাঁই হতো! কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়। মেয়েদের শেষ ঠাঁই হবে স্বামীর ভিটায়। এটাই নিয়ম। এই গ্রামে তার আর ফিরে আসা হবে কি না সে জানে না। কিন্তু ইচ্ছে হলেই সে স্বামীর বাড়িতে বসে এই মাটি ছুঁয়ে দেখতে পারবে। নিতে পারবে এই মাটির ঘ্রাণ। দূর থেকে বিষয়টি খেয়াল করে চন্দন। মার এই কান্ড দেখে সে অবাক হয়।

 

ভাবে এই মাটি দিয়ে কি করবে মা। এত যত্ন করে মাটিগুলো ব্যাগে ভরারই বা কারণ কি! কিছুতে অঙ্ক মেলাতে পারে না । মাটি তোলা শেষ করে আবারো কবরের কাছে এগিয়ে যায়, বাবা-মায়ের করবে হাত বুলিয়ে দেয়। তার পর বাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে আবার ফিরে যায় অন্য একট কবরের কাছে। এই কবরটি বলাকার ছোট বড় বোনের। সেই কত কাল আগে কলেরা রোগে মারা গিয়েছে তার এই বোনটি। তারপর কত বছর কেটে গেছে। কিন্তু একটি দিনের জন্য সে বোনটিকে ভুলে থাকতে পারেনি। বোনের কথা মনে হতে তার দুচোখ বেয়ে পানি ঝরতে থাকে। কিছুক্ষণ কবরের পাশে বসে থাকে। তার পর বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে।

 

ছয়

বাপের বাড়ি থেকে ফিরে এসে দুমাস না যেতেই বিছানায় পড়ে বলাকা। স্বামী এবং পুত্র কেউই তার চিকিৎসার কোনো ত্রুটি রাখছে না। কিন্তু কাজ হলো না কোনো ডাক্তার কবিরাজে । দিন দিন তার অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগল। শেষ সময়ে তার কাউকে দেখতে ইচ্ছে হয় , কিংবা কিছু খেতে মন চাই কি না সবাই তা জানতে চাই। তারা যেন শেষ ইচ্ছে পূরণে ব্যস্ত।

 

এর মধ্যে বাপের বাড়ি থেকে সবাই এসে বলাকাকে দেখে গেছে। দিন-রাত সেবা-যত্নের ত্রুটি নেই তার। ছেলের বউটা নিজের মেয়ের মতো কাজ করে যাচ্ছে। বলাকার অনেক ভাগ্য এমন একটা বউ পেয়েছে। সে মনে মনে বউমার জন্য প্রার্থনা করে। ছয় মাসের মাথায় তার অবস্থা আরো খারাপ হলো। স্বামীকে কাছে ডেকে সে তার ভাইদের কাছে খবর পাঠাতে বলে। খবর পেয়ে বলাকার বাপের বাড়ি থেকে দুই ভাই ও তাদের ছেলেমেয়েরা আসে।

 

এতক্ষণে বলাকার অবস্থা প্রায় শেষ। নিজের কাছের মানুষদের দেখে যেন অনেকটা সুস্থ হলো বলাকা। ভাইদের কাছে কুশলাদি জানল। উপদেশ দিলো বুবুর জন্য চিন্তা না করার। সেদিন রাতেই প্রায় অচেতন হয়ে পড়ল বলাকা। কারো ডাকই তার কানে গেলো না। শেষ সময়ে ইশারায় ছেলে চন্দনকে কাছে ডাকে। মায়ের কথা শোনার জন্য তৈরি চন্দন। কিন্তু মায়ের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। বলাকা বারবার শোকেসের ওপর কিছু দেখাচ্ছে। সবাই এটাওটা জানতে চাইলে ইশারায় না করছে। শেষ পর্যন্ত চন্দন মাটির ব্যাগটি দেখায়। এবার সাই দিলো বলাকা। চন্দন ব্যাগটি এনে মায়ের কাছে দেয়। তাতে কিছুক্ষণ হাত বুলাই বলাকা। তার পর চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে।

 

পরের দিন সকালে মায়ের দাফন সেরে ঘরে আসে চন্দন। চোখ যায় মাটির ব্যাগটির দিকে। এত দিন পরে সে বুঝতে পারে মা কেন সেদিন মামা বাড়ি থেকে এই মাটি বয়ে নিয়ে এসেছিলো। সবার অজান্তে মাটিগুলো নিয়ে কবরস্থানে যায় চন্দন। মামা বাড়ি থেকে আনা মাটিগুলো মায়ের কবরে ছড়িয়ে দেয়। কবরের ওপর গেড়ে দেয় শিউলীর বিচিগুলো।

 

ভোরের আকাশ/নি