logo
আপডেট : ১৯ জুন, ২০২৩ ১১:১৭
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েও তালিকায় নাম নেই
মীর বাবুল, ময়মনসিংহ

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েও তালিকায় নাম নেই

ক্যাপশন: জামাল উদ্দিন

ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার ঢাকুয়া ইউনিয়নের ঢাকুয়া গ্রামের মৃত আফসর উদ্দিনের ছেলে মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন। ১৯৭১ সালে জামাল উদ্দিন বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে প্রথমে ভারতের ঢালু ইয়ুথ ক্যাম্পে যোগ দেন। ওই ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন অধ্যক্ষ মতিউর রহমান (সাবেক ধর্মমন্ত্রী)। বয়সের ভারে এখন চলাফেরা করতে কষ্ট হয় তার। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম নেই জামাল উদ্দিনের। মৃত্যুর আগে নিজের নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় দেখে যেতে পারাটাই তার একমাত্র স্বপ্ন।

 

তিনি জানান, ভারতের মেঘালয় রাজ্যে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা তিনি। তুরা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ৪ নম্বর উইংয়ে ২৭ দিন অস্ত্র প্রশিক্ষণ, দুই দিন জঙ্গল প্যারেড, এক দিন কসম প্যারেডসহ জেএল কোর্স সম্পন্ন করেছিলেন। প্রশিক্ষণকালীন উইং কমান্ডার ছিলেন মো. আব্দুর রহিম, সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন মো.আব্দুল রহমান।

 

তিনি (জামাল উদ্দিন) প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন এবং একটি এলএমজি সংগ্রহ করেছিলেন। প্রশিক্ষণ শেষে কোম্পানি কমান্ডারের সঙ্গে ঢালু ইয়ুথ ক্যাম্পের পাশে কন্যাডুবি এফএফ ক্যাম্পে অবস্থান করেন। এরপর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। তখন শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ।

 

তিনি বলেন, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সরচাপুর ব্রিজের কাছে পাক বাহিনীর মর্টার সেলের একটি টুকরা ডান হাতের ওপর বিদ্ধ হয়। তখন আমি আমার কোম্পানি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আমার পেছন থেকে হালিম কোম্পানি কমান্ডার আমাকে সাহায্য করেন এবং আমি হালিম কোম্পানিতে যোগ দিয়ে হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত যে কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল সকল যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করি।

 

১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে অবস্থান নেয়ার পর আমার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রশাসক এবং ডা. অলিউল্লাহ আমাকে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন। ৭ দিন চিকিৎসা নেয়ার পর সুস্থ হয়ে পুনরায় জিলা স্কুল বোর্ডিংয়ে হালিম কোম্পানিতে যোগ দেই এবং সর্বশেষ বেতনভাতা হালিম কোম্পানি থেকেই গ্রহণ করি।

 

যখন ১১ নম্বর সেক্টর ক্লোজ করা হয়, তখন আমাদের বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর তৎকালীন অধিনায়ক জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী (এমএজি ওসমানী) স্বাক্ষরিত একটি সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়, যা আমার মূল প্রমাণপত্র।

 

জামাল উদ্দিন বলেন, আমি জানতাম মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকায় আমার নাম থাকবে কিন্তু ১৯৯০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত দলিলে আমার নাম না থাকায় আমি হতাশ হই। জেলা কল্যাণ ট্রাস্টের দলিলে উল্লেখ করা আছে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে প্রাপ্ত দলিলের মধ্য থেকে এক হাজার ৭৬টি দলিল বিনষ্ট বা অস্পষ্ট থাকায় মোট এক হাজার ১২৭ জন মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। আমার নামের দলিল বিনষ্ট বা অস্পষ্ট হয়েছে বলে আমি কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলে ২০০৯ সালের ১৭ জুন, ২০১০ সালের ১৩ জুন ও ২০২১ সালের ২৭ জুন তিনটি আবেদন করি। আবেদনের প্রেক্ষিতে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য আমাকে একটি পত্রও দেয়া হয়েছিল।

 

কিন্তু তা আবার স্থগিত করা হয়। এ বিষয়টি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে ২০১০ সালের ১৩ জুন, ২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সালের ১৯ জানুয়ারি ও ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আবেদন করি। ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) আবেদন করেছিলাম। ভারত সরকারের কাছে প্রশিক্ষণের দলিল চেয়ে ভারতীয় হাইকমিশনার বরাবর ২০১৬ সালের ৯ জুন ও একই বছরের ২২ মে আবেদনের প্রেক্ষিতে ভারতীয় হাই কমিশনারের কার্যালয় থেকে ২০১৬ সালের ৯ জুন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জামুকায় পরপর দুইটি মেইল পাঠিয়ে আমাকে একটি পত্রের মাধ্যমে অবহিত করা হয়।

 

তিনি আরো বলেন, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটিতে আমাকে ডাকা হয়। এসময় জামুকার কেন্দ্রীয় কমিটির একজন, কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের একজন, থানা মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের একজন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ ৭ সদস্যের কমিটির সবাই উপস্থিত ছিলেন। যাচাই-বাছাই শেষে উপজেলার ১০ জনকে ‘ক’ তালিকাভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে আমার নামটি ক্রমিক নম্বর-১ এ রাখা হয়েছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আমার নাম তোলা হয়নি।

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা এবি সিদ্দিক বলেন, আমি ও জামাল উদ্দিন হালিম কোম্পানিতে ছিলাম। একসঙ্গে তুরাতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছি। ভারতের তালিকায় আমার নাম আসার কারণে আমি মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পাচ্ছি। কিন্তু ভারতের তালিকায় অনেকের নাম আসেনি, ফলে জামাল উদ্দিনের মতো অনেকে এখন পর্যন্ত কাগজে-কলমে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেননি।

 

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ময়মনসিংহ জেলা কমান্ডের সদস্য সচিব কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বলেন, যুদ্ধ করে তালিকায় নাম না তুলতে পারলে রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সম্ভব নয়। কোথাও পরিচয় দিলেও তা গ্রহণযোগ্য হবে না। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) উদ্যোগে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকায় উঠানো প্রয়োজন।

 

এ বিষয়ে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মো. মোস্তাফিজার রহমান বলেন, উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের সময় জামাল উদ্দিনের নামটি ‘ক’ তালিকার ক্রমিক নম্বর ১ এ রাখা হলেও আমাদের কিছুই করার নেই। কারণ এটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জামুকা একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারণ করে।

 

ভোরের আকাশ/নি