logo
আপডেট : ১৯ জুন, ২০২৩ ১১:৪১
কোভিড-১৯ এর ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতি দীর্ঘ মন্দার কবলে
রেজাউল করিম খোকন

কোভিড-১৯ এর ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতি দীর্ঘ মন্দার কবলে

কোভিড-১৯ এর ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতি দীর্ঘ মন্দার কবলে পড়েছে। দেশে চাহিদা পড়ে গেছে, সৃষ্টি হয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। এ পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই কমে যাবে- সেটাই স্বাভাবিক। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) প্রাক্কলন অনুযায়ী বাংলাদেশে গত ২০২১ সালের প্রথমার্ধে এফডিআই ১৯ শতাংশ কমে হয়েছিল ১১৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। তখন দক্ষিণ এশিয়ায় এফডিআই কমেছিল ৩১ শতাংশ বা ২ হাজার কোটি ডলার।

 

এরপর বিশ্বজুড়ে করোনার ধাক্কায় বিভিন্ন দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আরো কমেছে, তা বলাই বাহুল্য। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে লকডাউন আরোপ করা হয়েছিল পরিস্থিতি বিবেচনায়। অর্থনীতিতে যার মারাত্মক পরিণতি অবশ্যম্ভাবি হয়ে উঠেছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন সবই স্থবির হয়ে পড়েছিল এর জেরে।

 

বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান নতুন বিনিয়োগ তো করেইনি, বরং বিদ্যমান বিনিয়োগও অনেক ক্ষেত্রে গুটিয়ে এনেছে বা সংকুচিত করেছে। আবার নতুন করে করোনার ঢেউ প্রকট হয়ে ওঠায় অনিশ্চয়তা ও গভীর মন্দার আশঙ্কায় অনেক নতুন বিনিয়োগ প্রকল্পের অগ্রগতি থমকে যায়। করোনার কারণে সারাবিশ্বে এফডিআইর হার অর্ধেক হয়েছিল। তবে বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ রয়েছে।

 

বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন থেকেই অনেক ধরনের সমস্যা চলছে। যেমন- বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরতে হয় কিংবা উপযুক্ত জমি পাওয়া যায় না। সরকার এর জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল ও এক দরজায় সেবা (ওএসএস) চালু করেছে। এগুলো এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন ও কার্যকর হয়নি। অর্থাৎ বিনিয়োগে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, এমন কোনো উদ্যোগই চূড়ান্ত পর্যায়ে যায়নি।

 

এর সঙ্গে ডলার-সংকট বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটা বাড়তি বিষফোঁড়া হিসেবে যুক্ত হয়েছে। ডলার-সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে না পারায় মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি রয়েছে। ফলে অনেক জটিলতা থাকা সত্তেও যতখানি বিনিয়োগ হওয়ার কথা সেটাও আসেনি।

 

ডলার সংকটের কারণেই বর্তমানের এ জ্বালানি সংকট। দাম বাড়িয়েও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করতে পারছে না সরকার। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ঋণ গ্রহণের সীমাও ৩ কোটি ডলার থেকে ২ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশের বলার মতো কোনো উন্নতি হয়নি, বরং গত এক বছরে তিনটি সূচকে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। এমন চিত্রই উঠে এসেছে বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) ২০২২-২৩ জরিপে।

 

গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত জরিপের তথ্যানুযায়ী, ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণ পাওয়া জটিল আকার ধারণ করেছে। কর ও ভ্যাট পরিশোধে হয়রানি আগের চেয়ে বেড়েছে। আবার কারখানা বা ব্যবসার জন্য জমি পাওয়াটাও আগের চেয়ে কঠিন হয়েছে। বিবিএক্স জরিপটি করেছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ।

 

বর্তমানে জ্বালানি সংকটে দেশীয় শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান ছাড়াও নতুন বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহী হচ্ছেন। এ সমস্যা সমাধানে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। দেশের করব্যবস্থা নিয়ে দেশি-বিদেশি সব বিনিয়োগকারীর অনেক অভিযোগ রয়েছে। কয়েক দফায় কমানোর পরও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সার্বিক করের পরিমাণ অনেক বেশি। কর আরো কমানো দরকার। এ ছাড়া ভ্যাটের একাধিক হার কমিয়ে আনার পাশাপাশি এ ব্যবস্থাকে আরো সহজ করা হলে বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

 

বেসরকারি বিনিয়োগের মধ্যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২১ সালে ২৯০ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছিল। আর গত বছর আসে ৩৪৮ কোটি ডলারের বিনিয়োগ। তার মানে গত বছর ৫৫ কোটি ডলারের এফডিআই বেশি এসেছে। তবে মূলধন বা নতুন বিনিয়োগ কমেছে, বেড়েছে পুনর্বিনিয়োগ। ডলার সংকটের কারণে অনেক কোম্পানি নিজ দেশে মুনাফা নিতে পারেনি। এ কারণে কাগজে-কলমে পুনর্বিনিয়োগ বেশি দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এ অর্থের পুরোটা বিনিয়োগ হয়েছে, তা বলা যাবে না।

 

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এফডিআই জিডিপির ৩-৪ শতাংশ করার কথা ছিল। জিডিপির ৩ শতাংশ ধরলেও প্রায় ১০-১২ বিলিয়ন ডলারের এফডিআই আসা উচিত ছিল। সেখানে আমাদের বর্তমান অবস্থান খুবই নগণ্য। সার্বিকভাবে বেসরকারি বিনিয়োগের অবস্থাও ভালো নয়। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জিডিপিতে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্য ছিল ২৮ শতাংশ। তবে সেই জায়গায় পৌঁছানো যায়নি। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবার আগে রিটার্ন নিয়ে চিন্তা করেন।

 

যখন তারা দেখেন পদ্ধতিগত কিছু সমস্যার কারণে ব্যবসায় ব্যাঘাত ঘটে, তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগ করতে চান না। প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের সময়েও জাপানিরা বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে তারা বলেছে, বাংলাদেশে ব্যবসায় সমস্যা আছে। সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান না করে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে। জ্বালানি-সংকট ও পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় বস্ত্র, তৈরি পোশাক, সিরামিক, ইস্পাতসহ বিভিন্ন খাতের শিল্পকারখানার উৎপাদন কমেছে। তার মধ্যে বস্ত্র ও তৈরি পোশাকে নতুন নিয়োগ বন্ধ। কোনো কোনো কারখানা কর্মী ছাঁটাইও করছে।

 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি আদেশ কমেছে। ফলে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ১ হাজার ৮৩৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দেড় শতাংশ কম। সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি ৮৪ শতাংশ তৈরি পোশাক থেকে এসেছে। বর্তমানে এ খাতের প্রবৃদ্ধি মাত্র দশমিক ৭৭ শতাংশ।

 

সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসার পরিবেশ বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের অনুক‚লে নেই। জ্বালানি সংকটের কারণে বস্ত্র খাতের কারখানাগুলো ৫০ শতাংশ সক্ষমতায় চলছে। নতুন নিয়োগ বন্ধ। ডলার সংকটের কারণেই বর্তমানের এই জ্বালানি সংকট। দাম বাড়িয়েও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ করতে পারছে না সরকার। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) ঋণ গ্রহণের সীমাও ৩ কোটি ডলার থেকে ২ কোটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। শিগগিরই ব্যাংকঋণের সুদের হার দুই অঙ্কের ঘরে যাবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন বিনিয়োগ তো দূরে, যারা ব্যবসায় আছেন, তাদের টিকে থাকতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।

 

সব দোষ যুদ্ধের ওপর চাপানোর সময়টা পার হয়ে গেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে শুধু বাংলাদেশই অসুবিধায় পড়েনি। অন্যান্য দেশে এখন মূল্যস্ফীতি কমছে, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন পারছে না। এজন্য সমস্যার মূল কারণগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে দ্রুত সেগুলো সমাধান করতে হবে। যুদ্ধের ওপর দায় চাপানোর কৌশল থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিনিয়োগ সেবার মান উন্নত করার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, অধিক বিনিয়োগ মানে অধিক কর্মসংস্থান এবং উন্নয়নের পথে আরো এগিয়ে যাওয়া।

 

সব দোষ যুদ্ধের ওপর চাপানোর সময়টা পার হয়ে গেছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে শুধু বাংলাদেশই অসুবিধায় পড়েনি। অন্যান্য দেশে এখন মূল্যস্ফীতি কমছে, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন পারছে না।

 

অমিত সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিপুল আয়োজন নিয়ে অপেক্ষা করে আছে। বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিনিয়ত বিনিয়োগের জন্য সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এ তালিকায় সিঙ্গাপুর ও দুবাই রয়েছে এমনকি আমেরিকা থেকেও বিনিয়োগের জন্য যোগাযোগ করছে। বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, ইজ অব ডুয়িং বিজনেসে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া অবস্থান। আমাদের ইমেজ সংকট রয়েছে।

 

এটাকে সামগ্রিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ব্রান্ড ভ্যালু অনেক কম। ইনভেস্টররা বাংলাদেশের কথা শুনলে মনে করে এ দেশ অনেক গরিব কিংবা দুর্যোগকবলিত দেশ। এ অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ করতে হবে। প্রয়োজনে গ্লোবাল পিআর এজেন্সি নিয়োগ করে বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করতে হবে। আমরা গরিব দেশ নই, উন্নয়নশীল ও বিনিয়োগবান্ধব এটা সবাইকে বোঝাতে হবে।

 

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার

 

ভোরের আকাশ/নি