ঈদের এখনো কিছুদিন বাকি। সাধারণ মানুষেরও নাড়ির টান আছে, শিকড়ের টানে গ্রামে ফেরার তাগিদও কম নেই। তারাই পড়বে হরেক মাত্রার বিপন্নতার আবর্তে। শিকড়ের টানে নগর, বন্দর, শহরের মানুষের চিরচেনা পল্লির নির্মল সবুজ ঘেরা আঙিনায় ছুটে যাওয়ার যেন কোনো বিরাম বিরতি থাকবে না। যেমন ঈদুল ফিতরে ছিল না। একইভাবে ঈদুল আজহাতেও আনন্দ আর আবেশের সর্বাংশজুড়ে থাকে আপন ঠিকানা ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড় গ্রামীণ পরিবেশকে উপলব্ধি করা।
পবিত্র ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহার সময় ঘনিয়ে আসছে। বহু কাক্সিক্ষত কোরবানির দিন ধার্য করা হয় চাঁদের মাসের বিধি মোতাবেক। মুসলমানরা সেই ঈদ উদযাপন করে থাকে জিলকদ মাসের বিদায় ঘণ্টায় জিলহজ মাসের শুভযাত্রা যেখানে সেখান থেকেই। সঙ্গে কোরবানির প্রস্তুতি শুরু হতে দেরি হয় না। ১০ জিলহজ পবিত্র হজের জন্য লাখো মানুষ যে ইবাদত বন্দেগিতে মক্কা শরিফে জমায়েত হন, সেটাই বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম সমাবেশ।
তার পরপরই শুরু হয় কোরবানির ধর্মীয় উৎসব। বাংলাদেশও উদযাপন করে ভাবগাম্ভীর্যে মহান আল্লাহতায়ালার নির্দেশিত বিধান। তবে আবহমান বাঙালি উৎসবপ্রিয় জাতি। বারো মাসে তেরো পার্বণের মধ্যে নিজেদের উৎসর্গ করা বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্য। প্রতিটি দেশ এবং জাতি নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্ম, আচার-আচরণসহ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে তাদের জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়।
আমাদের মাতৃভূমি মুসলিম প্রধান অসা¤প্রদায়িক দেশ। সংগত কারণে সব ধর্মের উৎসবই পালিত হয় জাঁকজমক এবং সাড়ম্বরে। কোরবানির ধর্মীয় আবহই আলাদা মাত্রার এবং অনন্য ধর্মাচ্ছন্ন অনুভবে। অনুষ্ঠানসর্বস্ব আয়োজনে শুধু ঈদের জামাতে নামাজ আদায় করা ছাড়াও পশু কোরবানির রেওয়াজ সেই পুরাকালের। বিশেষ করে গরু, ছাগল আল্লাহর নিমিত্তে উৎসর্গ করে তাকে জবাই করা ইসলামের চিরস্থায়ী বিধি।
পবিত্র ইসলাম ধর্মে বর্ণিত আছে, হজরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর প্রিয় সন্তান ইসমাইলকে (আঃ) আল্লাহর উদ্দেশে কোরবানি দিতে গেলে মহান রাব্বুল আলামিন যে কোনো একটি পশু কোরবানির নির্দেশ দেন। সেই থেকেই এই কোরবানিতে ঈদ উৎসবের মর্যাদা দিয়ে হজ পালনের পরপরই তার আয়োজন শুরু করা হয়।
বাংলাদেশ তার পরিবেশগত ও সাংস্কৃতিক মহিমায় বিভিন্ন উৎসব-আয়োজনে মেতে ওঠাও এক অনন্য সম্ভার। উৎসবই বটে। সারাবছর ধরে চলে এর প্রস্তুতি। বার্ষিক এই ধর্মীয় আনন্দে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পশু কোরবানি দেয়া। অতি সহজ আর স্বাভাবিকভাবে বিষয়টি ঘটে যায় তা কিন্তু নয়। দেশের পশু খামারিরা বছরজুড়ে এমন ধর্মীয় উৎসবের জন্য গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি লালন পালন করতে থাকেন।
সময় সন্নিকট হলেই পশুর হাট বসতেও দেরি লাগে না। পশুর হাট বসা মানেই আর এক জমজমাট দারুণ পরিবেশ-পরিস্থিতি। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের জন্যই। পশুর হাট বসাটাও সময় এবং স্থান নির্ধারণে নির্দিষ্ট করা থাকে। বিশেষ করে কোরবানির ২-৩ দিন আগ থেকেই রাজধানীসহ সারা দেশেই শুধু হাটে-বাজারে নয় বরং রাস্তাঘাটেও থাকে প্রচুর মানুষের ভিড়। দর্শনীয় এক উৎসব তো বটেই। আনন্দ আর খুশির আমেজে আকাক্সিক্ষত সময় কাটে ভীষণ ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে।
তবে ঈদুল ফিতরের চাইতেও ঈদুল আজহার আবেদন, প্রস্তুতি ভিন্ন মাত্রার। এক মাস সিয়াম সাধনার পর রমজানের ঈদের উৎসব আর নিবেদন অন্য রকম। শপিংমলগুলোতে ভিড়ের আধিক্য। রাস্তায় জট পাকানো গাড়ির সারিতে নাভিশ্বাস হওয়ার দশা। সেটাও কম ধকলের নয়। আবার কোরবানির গরু ছাগল হাট থেকে কিনে ঘরে ফেরাটাও অস্বস্তির শেষ সীমায়।
সবটাই যেন উৎসবপ্রিয় জাতির অনন্য স্বজাত্যবোধ। মুসলিম প্রধান দেশ মালয়েশিয়ায় এক বছর থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যে দেশে শপিংমল এবং রাস্তার আশপাশে বিভিন্ন দোকানে তসবিহ এবং জায়নামাজের সারি সারি পসরা সাজানো সেখানে দুটো ঈদ উৎসবই নাড়া দেয়ার মতোই নয়।
কোনো আয়োজন কিংবা প্রস্তুতি নেই। শপিং মলগুলোতে ঈদেও কোনো ভিড়ই নেই। এমনকি গরু-ছাগল কোরবানি দেয়ারও কোনো নিদর্শন মেলেনি। অথচ মুসলিম প্রধান দেশ। হিজাব ছাড়া কোনো নারী তিনি শিশু, কিশোরী, যুবতী কিংবা বৃদ্ধাই হোন না কেন দেখতেই পাওয়া যায়নি। ধর্মীয় নির্দেশ অনুযায়ী সব পালন করেও উৎসব কিংবা আড়ম্বরের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া সত্যিই অসম্ভব পর্যায়ের।
বাংলাদেশে ঈদ উৎসবের আরো এক অভাবনীয় কর্মযোগ নাড়ির টানে দেশের বাড়িতে গিয়ে একসঙ্গে এই ধর্মীয় বিধানটি উদযাপন করা। সঙ্গত কারণে শিকড়ের টানে গ্রামের সেই পরিবেশে ফিরে যাওয়া যেন উৎসবের অপরিহার্যতা। সেটাও যে কতখানি হয়রানির শিকার হতে হয় তা বলাই বাহুল্য। প্রথমত গ্রামের বাড়িতে যেতে গেলে পথযাত্রার জন্য যেকোনো যাতায়াত মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়।
সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ের যাত্রার মাধ্যমের জন্য সংগ্রহ করতে হয় টিকিট। সেটাও কম ঝামেলা ঝক্কির বিষয় নয়। গণপরিবহনের কাউন্টারে টিকিটের যে লাইন তাও কম অস্বস্তির নয়। বর্তমানে আধুনিক ও প্রযুক্তির বাংলাদেশ অনলাইনভিত্তিক টিকিট বিক্রয়ের যাত্রা শুরু করেছে। সেখানেও ওঠে এসেছে হতাশার চিত্র। সিংহভাগ মানুষই এখনো তথ্যপ্রযুক্তিতে অদক্ষ। যারা সক্ষম এবং দক্ষ তারা অনলাইন টিকিট কিনতে পারদর্শী এবং কিনেও নেয়। কিন্তু বাকিরা পড়ে গলদঘর্মে।
ভালো মানের টিকিট পাওয়া যেমন মুশকিল একইভাবে সেই পুরোনো প্রথায় টিকিট কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে ক্রয় করাটাও কোনোভাবেই সুখকর নয়। দেশটা এখনো সাধারণ মানুষের। উন্নয়ন মহাযজ্ঞ সেভাবে সবাইকে স্পর্শও করতে পারেনি। সংগত কারণে উৎসব, আনন্দ আয়োজন কিংবা সংকটে বিপদে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াগুলো বর্তায় অসহায় জনজীবনে। ঈদযাত্রাও তার ব্যতিক্রম নয়।
এবারও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসছে অনলাইন টিকিট বিক্রি কোনো কোনো কাউন্টারে শেষ পর্যায়ে। বিক্রি শুরু হয়েছে আরো আগে। ঈদের এখনো কিছুদিন বাকি। সাধারণ মানুষেরও নাড়ির টান আছে, শিকড়ের টানে গ্রামে ফেরার তাগিদও কম নেই।
তারাই পড়বে হরেক মাত্রার বিপন্নতার আবর্তে। শিকড়ের টানে নগর, বন্দর, শহরের মানুষের চিরচেনা পল্লির নির্মল সবুজ ঘেরা আঙিনায় ছুটে যাওয়ার যেন কোনো বিরাম বিরতি থাকবে না। যেমন ঈদুল ফিতরে ছিল না। একইভাবে ঈদুল আজহাতেও আনন্দ আর আবেশের সর্বাংশজুড়ে থাকে আপন ঠিকানা ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড় গ্রামীণ পরিবেশকে উপলব্ধি করা। সেই চিরচেনা উৎসব আড়ম্বরের শাশ্বত মহিমান্বিত পর্যায়।
তবে কোরবানির ঈদের সঙ্গে যুক্ত হয় আরো এক জমজমাট পর্বÑ পশুর হাট বসাই শুধু নয় বরং পছন্দসই গরু, ছাগল কিনে কোরবানিটা নিয়মমাফিক উপভোগ করা। সেটাও যাত্রাপথের দুর্ভোগের চাইতে কোনো অংশে কম নয়। হাট থেকে পশু কিনে বাড়িতে রাখাই শুধু নয়, তাদের জবাই করার আগ পর্যন্ত নিয়মিত পরিচর্যা করাও একপ্রকার সচেতন দায়বদ্ধতা।
প্রযুক্তির বলয়ে কিছু কাউন্টারের টিকিট বিক্রি হয়ে যাওয়ার দৃশ্য অনেককে স্বস্তি দিলেও কিনতে না পারার কষ্টও বাকিদের নাজেহাল করছে। তারপরেও মানুষ পল্লি জননীর নির্মল প্রতিবেশে আপন ঠিকানায় ছুটে যেতে সব ধরনের ব্যবস্থা করে থাকে। গণপরিবহনে স্থানসংকুলান না হলে কয়েক পরিবার মিলে ব্যক্তিগত গাড়ি ভাড়া করে যাওয়ার চিত্রও ঈদযাত্রায় উঠে আসে। ভোগান্তির কোনো শেষ পরিশেষ থাকেও না। গ্রামের স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করার খুশিতে কত দুর্ভোগ যে বিলীন হয়ে যায় সত্যিই এক অনন্য বিষয়।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌপথের ভ্রমণ স্বস্তিদায়ক। বিশেষ করে বড় বড় লঞ্চগুলোতে। যাত্রা ভোগান্তি টেরই পাওয়া যায় না। সন্ধ্যায় লঞ্চ ছাড়ে পরের দিন ভোরে গন্তব্যে পৌঁছায়। নিরাপদ এবং স্বস্তিদায়ক উপভোগ্য যাত্রা তো বটেই। লঞ্চের টিকিট সব মানুষের জন্য অবারিত হয় না। মুষ্টিমেয় সচ্ছল, প্রযুক্তিতে পারদর্শী ব্যক্তিবর্গই এমন সব অভিজাত যাত্রা উপভোগ করেন আনন্দস্রোতে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো যাত্রায় স্বস্তি কিংবা ভোগান্তির পরেও যেন সময় মতো গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মিলনযজ্ঞে ঈদ উৎসবকে পরিপূর্ণতায় ভরিয়ে তোলা যায়। সেখানেও অনেক সময় বিপত্তি ঘটে। বিশেষ করে শেষ সময়ে যারা যাত্রা করেন, তাদের অনেকে গন্তব্যে পৌঁছে নামাজটাও সারতে পারেন না। গাড়িতেই তেমন দুর্লভ সময় পার হয়ে যায়। যার জন্য অপেক্ষমাণ থাকতে হয় আরো একটি বছর।
তবে গৌরবময় পদ্মা সেতুর সঙ্গে শত সেতুর উদ্বোধনে গত ঈদযাত্রায় স্বস্তি মিলেছিল। এবারও হয়তো তার অন্যথা হবে না। নিরাপদে নির্বিঘ্নে স্বচ্ছন্দে মানুষের তার চিরচেনা গন্তব্যে পৌঁছতে বিলম্ব হবে না। অবকাঠামোর উন্নয়নের সুফল থেকে সাধারণ মানুষ যেন বঞ্চিত না হয় এই প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক
ভোরের আকাশ/নি