logo
আপডেট : ২২ জুন, ২০২৩ ১৫:০৫
কোরবানি মানেই পশু জবাই নয়
স্বপ্না রেজা

কোরবানি মানেই পশু জবাই নয়

কোরবানি ঈদ ছুঁই ছুঁই। একটা অংশের মানুষ মনে করে, কোরবানি ঈদ মানেই পশু জবাই। ধর্মীয় বোধ যতটা না, তার চেয়ে পশু জবাইয়ের উৎসবটাই যেন মুখ্য হয়ে ওঠে। একটা দৃশ্যমান প্রতিযোগিতা চলে। কে কার চেয়ে বড় পশু ও দামি পশু কোরবানি দেবেন, তার প্রতিযোগিতা। সাধারণত যেসব পশু জবাইয়ের হিড়িক পড়ে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গরু, ছাগল, দুম্বা, উট। অবশ্য বাংলাদেশে গরু ও ছাগলই কোরবানির অন্যতম ও সহজলভ্য পশু। সোজা কথায়, মানুষের আয়ত্তের মধ্যে পড়ে।

 

কেউ কেউ আবার অর্থবিত্তের দাপটে উট ও দুম্বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আনিয়ে কোরবানি দিয়ে থাকেন এবং সেটা তাদের সামাজিক অবস্থানকে বোঝাতে। বলাবাহুল্য, এই বোঝানোটা পত্রিকার পাতায় সংবাদ হয়। অন্য লোকে তাদের চিনতে ও জানতে পারে।

 

যাহোক, ঈদ আগমনে গরু ও ছাগল কেনাবেচার চিন্তাভাবনা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। প্রচারমাধ্যমে তার সচিত্র সংবাদ প্রচার হতে শুরু হয়েছে। সাধারণত গরু ও ছাগল যারা লালন-পালন করে সেই গবাদি কৃষকের দল কোরবানি ঈদকে চিন্তা করে, সামনে রেখে সারা বছর একটা প্রস্তুতি নিয়ে থাকে।

 

অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা তথা খামারিরা বছরজুড়ে গরু-ছাগল লালন-পালন করে থাকে বিরাট মুনাফা লাভের আশায়। গ্রামগঞ্জে চলে গবাদি কৃষকের দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি এবং লাভের প্রতীক্ষা। কোথাও কোথাও আবার এটাকে কেন্দ্র করে হয়, মুনাফার নীলনকশা। নানাবিধ কলাকৌশলে গবাদি কৃষকরা বঞ্চনার শিকার হয়। তার ন্যায্যতা হারায়।

 

যেটাই হোক, নানা ধরনের সামাজিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রতীক্ষায় ক্লান্তি আসে না গবাদি কৃষকের। সারা বছর খেয়ে-পরে থাকার অবলম্বন আঁকড়ে চলে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম। সঙ্গে স্বপ্ন।

 

আবার এই কোরবানির গরুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে একটা দালাল ও চাঁদাবাজ চক্র এবং যারা একটা বিশেষ মুহূর্তে সক্রিয় হয়ে ওঠে, আধিপত্য বিস্তার করে। হিংস্রতাও দেখা যায়। আরো একটা চক্রের উৎপাত দেখা যায় সেটা হলো গরু চোর। গরু চুরি নতুন কোনো চুরিকর্ম নয়। অনেকের ধারণা, কসাইগোষ্ঠী গরু চুরিকর্মের সঙ্গে পুরোপুরি লিপ্ত। তাদের কেউ কেউ গরু চুরি করে বাজারে বিক্রি করে থাকে। গরু নিয়ে বিমার ব্যবস্থার কথা শোনা গেলেও আদতে এর ফলাফল কী, তা অনেকেই জানে না। সারা বছরের একটা চলমান অপরাধ হলেও কোরবানি ঈদের আগে গরু চুরির মাত্রা ছাড়ায়।

 

গোয়ালঘরের বেড়া কেটে গরু চুরি যেমন হয়, তেমন হয় মাঠে ঘাস খেতে দেয়া গরু চুরি। আবার সড়কপথে ট্রাক থামিয়ে গরু ছিনতাই গরু চোরের বেপরোয়া ও জোরালো ভার্সন বলা যায়। চোরের মাতব্বর শ্রেণিই হলো এই গরু ছিনতাইকারীরা। ছিনতাইকৃত গরু আবার ভাগ-ভাটোয়ারা হয়। এই ভাগ-ভাটোয়ারা সংস্কৃতিই গরু ছিনতাইয়ে ইন্ধন, সমর্থন দেয়। যাইহোক, গরু শব্দটা এদেশের মানুষের কাছে কখনো-সখনো গালি হিসেবে ব্যবহৃত হলেও গরুর কদর রয়েছে এবং সেটা সারা বছর ধরে প্রোটিন খাদ্য হিসেবে যেমন রয়ে যায়, তেমন রয়ে যায় কোরবানির পশু হিসেবে।

 

একজন রসিক মানুষ বলছিল, গরু চুরি এমন আর কী, যেখানে মানুষের নবজাতক চুরি হয় দিনে-দুপুরে এবং নিত্যদিন। হাসপাতালগুলো, বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালগুলোতে অব্যবস্থাপনাগত কারণে প্রায়ই নবজাতক চুরি হয়, হচ্ছে। চুরি হওয়ার পর হাসপাতালে তদন্ত কমিটি হয়, তদন্ত কমিটি চোর খুঁজে ফিরে। কখনো নবজাতকের সন্ধান মেলে, কখনো সন্ধান মেলে না। নবজাতক চুরি করে চোর তা অন্যের কাছে বিক্রি করে। সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করে চুরির গল্প তৈরি হয়। যে চুরি করেছে তাকে ধরার চেষ্টা চলে। কিন্তু যা হয় না তা হলো, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।

 

চোরই যেন এখানে অপরাধী, চুরি করার ক্ষেত্রে সহায়তা ও সুযোগ প্রদানকারীর কোনো অপরাধ নেই যেন এখানে। ফলে নবজাতক চুরি হওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তার বিষয়ে টনক নড়তে দেখা যায় না, দায়িত্বও বাড়ে না। নবজাতকের নিরাপত্তা না দিতে পারার বিষয়কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কখনো কাউকে নড়েচড়ে বসে কঠোর হতে দেখেছে কিনা, সেটা জানা নেই। নবজাতক চুরির বিষয়টা এখন হাসপাতালের সংস্কৃতি। গর্ভবতী মা ও তাদের স্বজন এবং পরিজনদের প্রসব পরবর্তী সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।

 

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, কিঞ্চিৎ অসাবধানতায় দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। যাহোক, নবজাতক চুরির সঙ্গে গরু চুরির একটা সহজ মিলটা হলো, উভয় চুরি করা যায় যখন তখন এবং অবলীলায়। চুরি রোধে উভয় ক্ষেত্রেই কোনো জোরালো ব্যবস্থা নেই।

 

মূলত প্রয়োজনবোধ নেই কারোর। কেউ কেউ আবার এই ধরনের চুরিকে বড় চুরি বলে মনে করে না। অবশ্য নবজাতক চুরির বিষয়টিতে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখা হয়। কিন্তু গরু চুরির কোনো ফুটেজ সাধারণত দেখার ব্যবস্থা নেই। সাধারণত চুরি যাওয়া গরু কখনোই আর ফিরে পাওয়া যায় না। চুরি যাওয়া গরু কখনো কেউ ফেরত পেয়েছে, এমন ঘটনা বিরল। তবে হারিয়ে যাওয়া গরু কোনো মহৎ ব্যক্তির কারণে ফিরে পাওয়া সম্ভব বলে, কেউ কেউ অভিজ্ঞতালব্ধ অভিমত প্রকাশ করে। কোরবানির গরু নিয়ে ইদানীং আরেক ধরনের সংস্কৃতি চালু হয়েছে সমাজে, যা অতীতে মোটেও ছিল না।

 

আগে মানুষ এমন সংস্কৃতির ধারেকাছেও যেত না। চিন্তা তো দূরের কথা। ধর্মীয় বিষয়টি কোথাও কোথাও করপোরেট ছুঁয়ে গেছে। মানে হলো, কোরবানির গরু সিএসআর তথা করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির একটি দিক উন্মোচন করেছে। সেটা কেমন? গরু এখন দরিদ্র, অসহায় মানুষের ভেতর জাকাতের আদলে বিতরণ করার কথা ভাবছে কোনো কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান।

 

তবে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সরাসরি এই কাজ করছে না। তারা মাধ্যম খোঁজে। এই মাধ্যম হয় দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। এই দ্বিতীয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অসহায়ের বা গরিবের বন্ধুর আত্মস্বীকৃতিতে কোম্পানিতে গরু প্রাপ্তির আবেদন জানায়। যে কোনো কারণবশত তারা গরু পেয়ে যায়। এই গরু নিয়েই দ্বিতীয় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের চলে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের অভিনব উদ্যোগ, যেখানে ধর্মীয় সততা, স্বচ্ছতার বালাই নেই। এটাও এক ধরনের গরু ছিনতাই বলে কেউ কেউ মনে করে।

 

ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এখন অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে পালিত হয়, যেখানে মুনাফা, লাভটাই মুখ্য। হোক তা আর্থিকভাবে কিংবা সামাজিকভাবে। এই পরিবর্তন দুঃখজনক। সমাজকে, সমাজের সুস্থতাকে নস্যাৎ করতে যথেষ্ট সহায়ক এই পরিবর্তন। গরু, গরুর জায়গায় থাকলে কার কী ক্ষতি? ক্ষতি নেই। গরুকে নিয়ে চোর, ছিনতাইকারী যত খেলাই খেলুক না কেন, গরুর মতো নিষ্পাপ, সহজ সরল প্রাণী তো আর মানুষ হতে পারবে না। গরুর কাছে শেখার আছে অনেক কিছু। শিখলে সমস্যা কী?

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।

 

ভোরের আকাশ/নি