মানুষ সামাজিক জীব। আইন মানব সমাজের দর্পণস্বরূপ। সমাজে একসঙ্গে বসবাস করার জন্য নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলা অপরিহার্য। মানবকল্যাণের স্বার্থেই নিয়ম-কানুন প্রয়োজন। স্বীকৃত এই নিয়ম-কানুনই হল আইন। আইন হলো ফারসি শব্দ যার অর্থ সুনির্দিষ্ট নীতি বা নিয়ম। আইনের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Law'। যার অর্থ ‘স্থির বা অপরিবর্তনীয় এবং সকলের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। বিশেষজ্ঞগণ বিভিন্নভাবে আইনের সংজ্ঞা দিয়েছেন।
অ্যারিস্টটল বলেছেন ‘সমাজের যুক্তিসিদ্ধ ইচ্ছার অভিব্যক্তিই হচ্ছে আইন’ (Law is the passionless reason)। অধ্যাপক হল্যান্ডের মতে আইন হচ্ছে সেই সাধারণ নিয়ম যা মানুষের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সার্বভৌম রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ যা প্রয়োগ করেন।’ অর্থাৎ মানবজাতির বৃহত্তর কল্যাণে মানুষের আচার-আচরণ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশে রাষ্ট্র যে সকল বিধি নিষেধ প্রণয়ন করে সাধারণভাবে সেগুলোকেই আইন বলা হয়।
আইন শুধুমাত্র জনসাধারণের জন্যেই নয়, শাসকের জন্যেও। রাষ্ট্রের সার্ভিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে শাসক শ্রেণি আইন মানতে বাধ্য নয়, কিন্তু আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে জনসাধারণকে আইন মানতে বাধ্য করা হচ্ছে। আবার যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে জনসাধারণকে আইন মানতে বাধ্য করা হয় সেই বাহিনীকে দেখা যায় আইন ভঙ্গ করতে।
সম্প্রতি কোনো একদিন গাড়ির ভেতর থেকে দেখতে পাই এক ট্রাফিক পুলিশ এক ছেলেকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ভাবতে থাকি ছেলেটি রাস্তায় কী এমন অপরাধে জড়িয়েছে যার জন্য তাকে ট্রাফিকের হাতে আটক হতে হলো। ছেলেটির হাত ধরে তার ঊর্ধ্বতন সার্জেন্টের নিকট গেলে তার চোখের ইশারায় ছেলেটির হাত থেকে কি যেন একটি নেয়ার পর তাকে ছেড়ে দিল ওই ট্রাফিক। মুক্ত হওয়া ছেলেটি হেটে থেমে থাকা এক বাসে উঠলেন। বুজতে বাকি রইলো না ছেলেটি থেমে থাকা বাসের হেলপার বা কন্ট্র্রাকটার। এবার বিষয়টির জট খুলল। প্রশ্ন হলো এটাই কি রাষ্ট্রের চিত্র, আইন মানার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সব দায়িত্বশীলরা কি এমন।
একটি রাষ্ট্রের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা মানে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলসমূহের অবাধ সভা-সমাবেশই নয়। রাষ্ট্রের সর্বত্র বাগস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা জরুরি। দেশে বসবাসরত প্রত্যেক শ্রেণি পেশার মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষাকরা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইনের শাসন অর্থাৎ বিশ্ব ব্যাপী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০১২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তটি নিশ্চিত করে যে ‘মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং গণতন্ত্র পরস্পর সম্পৃক্ত এবং এই মৌলিক অধিকারগুলি পারস্পরিকভাবে একে অপরকে শক্তিশালী করে।
এ মৌলিকঅধিকারগুলি জাতিসংঘের সর্বজনীন এবং অবিভাজ্য মূল্যবোধ এবং নীতির অন্তর্ভুক্ত। যা একটি জাতির সর্বসাধারণের মধ্যে সমতা নির্ধারণ করে এবং শাসকদের জবাবদিহিতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একটি দেশের মধ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অত্যান্ত জরুরি। সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যান্ডেট হলো রাষ্ট্রে একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং সুশাসন কায়েম করা।
তবে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন, মানবাধিকার সংরক্ষণ, সমাজের সকল স্তরের দলমত সকল শ্রেণির মাঝে সমতা, ন্যায়পরায়ণতা, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার চর্চা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এগুলোই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পেছনের মূল চেতনা ও প্রেরণা।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়, নির্বাচন গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত মাত্র। নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের যাত্রাপথের সূচনা হয় এবং এর সফলতা নির্ভর করে মূলত নির্বাচিত সরকার কী করে, আর না করে তার ওপর। অর্থাৎ দুই নির্বাচনের মাঝখানে নির্বাচিত সরকারের কার্যক্রম ও আচার-আচরণই নির্ধারণ করে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে কিনা।
পৌরনীতির ভাষায়, সুশাসন প্রত্যয়টি পৌরনীতির সাম্প্রতিক সংযোজন। সুশাসনের ইংরেজি প্রতিশব্দ হল ‘Good Governance’। সুশাসনকে স্পষ্টভাবে বুঝতে হলে শাসন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। Governance হলো একটি বহুমাত্রিক ধারণা যা বিভিন্ন দৃষ্টিকোন, ক্ষেত্র এবং প্রেক্ষাপট থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
Government এর মতই Governance শব্দটি এসেছে 'kubernao' নামক ল্যাটিন শব্দ থেকে, যার অর্থ পরিচালনা করা। সাধারণত Governance বা শাসন এমন একটি পদ্ধতিকে বোঝায়, যেখানে একটি পরিকল্পিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো সংস্থা, সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নীতি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। বর্তমান বিশ্বে একটি জনপ্রিয় ধারণা হল সুশাসন। কেন না সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে সুশাসন।
১৯৮৯ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন সর্বপ্রথম সুশাসন প্রত্যয়টি ব্যবহার করা হয়। ২০০০ সালে বিশ্বব্যাংক সুশাসনের চারটি স্তম্ভ ঘোষণা করে। স্তম্ভগুলি হচ্ছে দায়িত্বশীলতা, স্বচ্ছতা, আইনি কাঠামো ও অংশগ্রহণ। ম্যাক করণী (Mac Corney) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সুশাসন বলতে রাষ্ট্রের সঙ্গে সুশীল সমাজের, সরকারের সঙ্গে জনগণের এবং শাসকের সঙ্গে শাসিতের সম্পর্ককে বুঝায়।’
মারটিন মিনোগ (Martin Minogue) সুশাসন সম্পর্কে বলেন, ‘ব্যাপক অর্থে সুশাসন হচ্ছে কতগুলো উদ্যোগের সমষ্টি এবং একটি সংস্কার কৌশল যা সরকারকে অধিকতর গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক করতে সুশীল সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করে তোলে।’
ল্যান্ডেল মিল (Landell Mill) মনে করেন, সুশাসন একটি জাতির রাজনেতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে দিক নির্দেশ করে এবং জনপ্রশাসন এবং আইনি কাঠামোর মধ্যে এটি কীভাবে কাজ করে তা জানায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সুশাসন সরকার পরিচালনা অপেক্ষা একটি বিস্তৃত ধারণা যা একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডের সামাজিক নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষায় এবং নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহারের প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকার সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।’ পরিশেষে বলা যায় যে, সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, দায়িত্বশীলতা এবং জনগণের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে জনগণের কল্যাণ শাসনকার্য পরিচালনাই হচ্ছে সুশাসন।
সুশাসন সেই শাসনব্যবস্থা যেখানে জনগণের তথা রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণ সাধিত হয়। আইনের শাসন, গণতন্ত্রের সংযোগের আরেকটি মূল দিক হল, আমাদের সমাজে প্রচলিত গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন গড়ে তোলার প্রক্রিয়াগুলি অভিন্ন কেবল মাত্র এ দুইটি বিষয় পারস্পরিকভাবে শক্তিশালী হতে পারে তখন, যখন সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। আইন মানার ক্ষেত্রে সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, আইন মানার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার পরিবর্তে মানার মানুসিকতা তৈরি করতে হবে।
এটি যখন পরিপূর্ণভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে তখন সমাজে কার্যকর ভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সংবিধানে প্রদত্ত নির্দেশনা এবং দেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করলে সাধারণ মানুষও সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে। আমাদের সংবিধানের বিধানানুযায়ী দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সংবিধান ও আইন মেনে চলা আবশ্যিক কর্তব্য।
আমাদের দেশে বিভিন্ন সাংবিধানিক ও সরকারি পদে যারা আসীন, তাদের সবার বেতন, ভাতা ও সুবিধাদি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নির্বাহ করা হয়। স্বাধীনতা-পূর্বকালে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী ৫০ বছরে মাত্র কয়েকটি কালো আইন গণতন্ত্রকে প্রহসনে পরিণত করেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বিশেষ ক্ষমতা আইন, জরুরি আইন এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত গণতন্ত্রকে প্রতিবন্ধী করে ফেলেছে।
পাকিস্তান আমলে প্রাদেশিক নিরাপত্তা আইন, কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা আইন, ডিফেন্স অফ পাকিস্তান রুলস এবং জরুরি আইন নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে অর্থহীন করে তুলেছিল। প্রশ্ন উঠতে পারে, কালো আইন কথাটি কোথা থেকে এসেছে। ইংল্যান্ডে এক সময় সাধারণ চাষিরা ভূ-স্বামীর জমিকে পশুর চারণভ‚মি হিসাবে ব্যবহার করত, ভূ-স্বামীর মালিকানাধীন বনভূমিতে পশু-পাখি শিকার করত। কিন্তু ভূ-স্বামীদের স্বার্থ পূরণ করতে গিয়ে রাজা আইন করলেন, এসব করা চলবে না। অথচ যুগ যুগ ধরে ইংল্যান্ডের কৃষকরা জমির মালিক না হয়েও এ অধিকারগুলো ভোগ করত।
আজকাল এসব অধিকার প্রথাসিদ্ধ আইন তথা কাস্টমারি ল’ দ্বারা কৃষকের অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু এ ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো আইনের শাসনের দিক থেকে অত্যন্ত নাজুক। এসব দেশে দুর্নীতি সর্বব্যাপক। পুলিশ ঘুষ খায় এবং বিচারপতিরা কর দেয় না। রুশ ফেডারেশনে নির্বাচন হচ্ছে। কিন্তু দেশটিতে প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে নিচের দিকের ক্ষুদ্র শক্তিমানরা বিচারহীন অবস্থায় আইন ভঙ্গ করে চলছে।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ওপর অনেক লেখালেখি এবং গবেষণা হয়েছে। এসব গবেষণা আমাদের সমস্যার মূলে যেতে সাহায্য করছে। আধুনিক বিশ্ব, যার জন্য প্রয়োজন ছিল একটি পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং এর পূর্বশর্ত ছিল আইনের শাসনের অস্তিত্ব-এ রকম কিছু এখন আর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দেখা যায় না। আইনের শাসন চুলচেরাভাবে প্রতিষ্ঠিত না হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও আশা করা যায় না। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে গতি সঞ্চারিত হয়েছে তা আগামী দিনে অব্যাহত থাকবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট দুশ্চিন্তা আছে।
আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কীভাবে সম্পর্কিত তা নিয়ে অনেক কিছু লেখা যায়। আপাতত আমরা যদি বুঝি আইনের শাসন কত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, তাহলে এ উপলব্ধি আমাদের অনেক দূর নিয়ে যাবে।
অর্থাৎ সর্বশেষ আমরা বলতে পারি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। সমাজে সমভাবে আইন প্রতিষ্ঠিত হলেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। শুধুমাত্র নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্থানে, সর্বক্ষেত্রে সফল ভাবে আইনের শাসন বা সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি।
লেখক : সংবাদকর্মী
ভোরের আকাশ/নি