মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: স্বপ্নে পদ্মা সেতু চালু হয়েছে এক বছর হলো। সেতু নিয়ে নানা আলোচনা-সমলোচনা থাকলেও সরকারের অন্যতম এই মেগা প্রকল্পটির কারণে এরই মধ্যে জনজীবনে সুফল দৃশ্যমান হয়েছে। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বিশাল এই জনপদের মানুষের জীবনে গতি এসেছে পদ্মা সেতুর কারণে। তারা অর্থনৈতিক মুক্তির আশা দেখছেন এই সেতু ঘিরে।
২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন ২৬ জুন ভোর ৬টা থেকে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এই সেতু দিয়ে এখন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার যানবাহন চলাচল করছে। পদ্মা নদীতে আগে ফেরি থাকায় এসব জেলার সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ ছিল ভোগান্তির। সেতু হওয়ায় সেই ভোগান্তি দূর হয়েছে।
পদ্মা সেতুতে এক বছরে টোল আদায় ৭৯৮ কোটি টাকা। এ সময়ে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়েছে পৌনে ৫৭ লাখ যান। উদ্বোধনের পরদিন থেকে প্রথম বছরে পদ্মা সেতু পাড়ি দিয়েছে ৫৬ লাখ ৭৫ হাজার ২০৫টি যানবাহন। এ সময়ে টোল আদায় হয়েছে ৭৯৮ কোটি ২৩ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫০ টাকা। রোববার পদ্মা সেতু সাইট অফিসের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আমিরুল হায়দার চৌধুরী এ তথ্য জানিয়েছেন।
তবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও এসএসএফ তাদের যানবাহন পারাপারে প্রতি মাসে মোট টোল একসঙ্গে দেয়ায় চলতি মাস শেষে তাদের টোল পাওয়া যাবে। এতে প্রথম বছরের টোলের পরিমাণ আরো কিছুটা বাড়বে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
সেতু বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিদিন গড়ে পাড়ি দিয়েছে সাড়ে ১৫ হাজারের কিছু বেশি যানবাহন। আর দৈনিক গড়ে আদায় হয়েছে ২ কোটি ১০ লাখ টাকার বেশি টোল। গত ২০ এপ্রিল সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার পর বেড়েছে যানবাহনের সংখ্যা। আদায় হচ্ছে বাড়তি টোল। এদিকে উদ্বোধনের পর এক মুহূর্তের জন্যও পদ্মা সেতুতে বন্ধ ছিল না যানচলাচল।
এই সেতু দিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ গন্তব্যের পথে ছুটে চলেছেন অবিরাম গতিতে। স্বপ্নের সেতু দিয়ে চলাচল করতে পেরে উচ্ছ¡সিত এ পথের যাত্রী, চালকসহ সংশ্লিষ্টরা। ভোগান্তির দৃশ্যপট পরিবর্তন করে স্বস্তির যাত্রা তৈরির জন্য তারা ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
যাত্রীরা জানান, এক বছর পূর্তির এ দিনটি এ পথে যাত্রীদের জন্য স্মরণীয়। কারণ ঠিক এক বছর আগেই এ পথে যাতায়াতে ভোগান্তিমুক্ত হয়েছিল কোটি মানুষ। দেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় ঘটেছিল নতুন বিপ্লব। দিনে কিংবা রাতে এখন সমান গতিতে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে সাধারণ মানুষ। সবই সম্ভব হয়েছে ছয় কিলোমিটারের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কারণে। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দ্বিতল পদ্মা সেতু গত বছর ২৫ জুন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন প্রধানমন্ত্রী নিজে মাওয়া প্রান্ত দিয়ে টোল দিয়ে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুতে আরোহণ করেন। পরদিন সকাল থেকে সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
এদিকে জনপ্রতিনিধি থেকে সাধারণ মানুষ সবাই এখন একবাক্যে বলছেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তবে রূপলাভ করার পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবনে সুফল মিলছে। বিভিন্ন জেলার সঙ্গে রাজধানী থেকে যাতায়াতের সময় কমেছে ৪-৫ ঘণ্টা, যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে। এর ফলে যাত্রী পরিবহনে যেমন দ্রুত গতি যুক্ত হয়েছে, তেমনই পণ্য পরিবহনেও এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এ কারণে যোগাযোগের পাশাপাশি তারা এখন অর্থনৈতিক মুক্তির আশা দেখছেন।
পদ্মা সেতু চালু হয় গত বছরের ঈদুল আজহার ঠিক আগ মুহূর্তে। গত বছরের কোরবানির ঈদ এবং চলতি বছরের ঈদুল ফিতরের সময় অর্থাৎ এই দুই ঈদযাত্রায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। এবারের কোরবানির ঈদযাত্রায়ও স্বস্তি মিলবে। ফলে ওই অঞ্চলের মানুষের জীবন থেকে ফেরির দীর্ঘ যানজট ও ভোগান্তি দূর হয়েছে। জনজীবনে এই সেতুর সুফলের কথা সবার মুখে মুখে।
জানতে চাইলে যাত্রীরা বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে রাজধানীতে বসবাস করা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত একেবারে সহজ হয়ে গেছে। এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরিঘাটে অপেক্ষা করতে হয় না। আগে সকাল ও সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে বাস ছাড়ত। এখন এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা পরপর বাস ছাড়ছে। বাসের টিকিট পেতেও সমস্যা হয় না। পরিবহনগুলো এখন রীতিমতো প্রতিযোগিতা করছে। ফলে যাত্রীসেবাও আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। এসবের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে পদ্মা সেতু।
রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এই অভ‚তপূর্ব পরিবর্তনের সুফল জনজীবনে স্বস্তি এনেছে। সময় বাঁচার পাশাপাশি অর্থের অপচয়ও রোধ করা সম্ভব হচ্ছে, বিশেষ করে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে। ফেরিতে যানজটের কারণে দীর্ঘ সময় ঘাটে অপেক্ষমাণ থাকত সারি সারি ট্রাক-পিকআপ। এখন টোলে ফেরির চেয়ে টাকা বেশি দিতে হলেও পণ্য পরিবহনের ভাড়া আগের চেয়ে কমেছে। আগে ঘাটে আটকে থাকার কারণে পচনশীল মালামাল নষ্ট হতো, এখন সেই শঙ্কা আর তাড়া করে না ব্যবসায়ীদের।
এদিকে সড়কের পাশাপাশি রেলপথ চালু হবে দ্বিতলবিশিষ্ট পদ্মা সেতুতে। সেতুর নিচে রেল এবং ওপরে গাড়ি চলাচলের জন্য নির্ধারিত। চলতি বছরের ৪ এপ্রিল পরীক্ষামূলকভাবে একটি বিশেষ ট্রেন পদ্মা সেতু অতিক্রম করে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ৬৬২১ নম্বর ইঞ্জিন পরিচালিত ৫টি বগিবিশিষ্ট ট্রেনটি ভাঙ্গা স্টেশন থেকে ৪২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পদ্মা সেতু পার হয়ে মাওয়া প্রান্তে পৌঁছায়। ওই দিন মাদারীপুর, শরীয়তপুর এবং মুন্সীগঞ্জ জেলার ওপর দিয়ে প্রথমবারের মতো ট্রেন চলে। ট্রেনের গতি ছিলে ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার।
পদ্মা সেতুর এক বছর পূর্তির বছরই উদ্বোধন হবে ঢাকা-ভাঙ্গা রেললাইনে ট্রেন চলাচল। সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুবিধাজনক সময়ে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত পদ্মা সেতু দিয়ে রেল যোগাযোগ উদ্বোধন করবেন। এরপর থেকেই খুলে দেয়া হবে সেতু দিয়ে রেল চলাচল।
গত ২৩ জুন রেল সচিব হুমায়ন কবির যশোরের শার্শার বেনাপোল রেলস্টেশন পরিদর্শনে গিয়ে জানান, ২০২৪ সালের মধ্যে পদ্মা সেতু হয়ে বেনাপোল-ঢাকা রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হবে। বেনাপোল রেলস্টেশনকে আরো আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ করা হবে। পাশাপাশি যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর লক্ষ্যে যাত্রী বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হবে। বহিরাগতরা যাতে স্টেশন এলাকায় প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য নজরদারি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
সারা দেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণ করায় এখানেও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে। শিল্প-কলকারাখানা হবে। আমাদের ফসল উৎপাদন হবে। সেই ফসল আমরা প্রক্রিয়াজাত করতে পারব। দেশে-বিদেশে রপ্তানি করতে পারব। আমাদের মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ করে দেশে-বিদেশে রপ্তানি করতে পারব। বাংলাদেশের মানুষের দুঃখ ঘুচে যাবে। তাদের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। অনন্ত ২১টি জেলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হবে। সেটা আমরা করতে পারব। এ অঞ্চলের সার্বিক উন্নতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকান্ড হবে।’
পদ্মা সেতুর সুফল পাওয়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলা হচ্ছে খুলনা বিভাগের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি এবং ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী।
পদ্মা সেতু চালুর ফলে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলার গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ের মধ্যে পণ্য পরিবহন করে মোংলা বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি ও আমদানি করতে উৎসাহিত হচ্ছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণের পর পায়রা বন্দরের গুরুত্বও বেড়েছে। প্রয়োজনীয় আধুনিকায়ন করা হলে পদ্মা সেতুর মাধ্যমে এই বন্দরও এক বৃহত্তম বন্দরে রূপান্তরিত হওয়ার হাতছানি দিচ্ছে।
ভোরের আকাশ/নি