বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণার রীতি চালু হয়েছিল ২০০৬ সালে গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমদের আমলে; ড. আতিউর রহমান তা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু ২০১৯ সালে তা রহিত করে বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা শুরু হয়।
এবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে সর্বশেষ ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ নেয়ার সময় বছরে অন্তত দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণার প্রদত্ত শর্ত পূরণ করা হলো। সংকোচনমূলক এ মুদ্রানীতিতে ঋণের সুদহার, রিজার্ভ গণনার পদ্ধতি, মুদ্রা সরবরাহ নীতি, ডলারের ভিন্ন ভিন্ন দর ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ইতোপূর্বে মুদ্রানীতিতে মুদ্রার জোগান হ্রাস-বৃদ্ধির নীতি অনুসৃত হতো এ নীতি থেকে সরে এসে এবার সুদহারনির্ভর মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে।
মুদ্রানীতির কাঠামোগত এ পরিবর্তনকে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার মৌলিক পরিবর্তন বলে উল্লেখ করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর আব্দুর রউফ তালুকদার প্রথমবারের মতো মুদ্রানীতি ঘোষণা করলেন।
তার প্রত্যাশা, এ মুদ্রানীতির মাধ্যমে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে ঘোষিত মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে এনে ৭.৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে। সুদহার বাড়িয়ে ঋণকে ব্যয়বহুল করার নীতি ইউরোপ এবং আমেরিকায়ও গ্রহণ করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কিছু পরামর্শও এ মুদ্রানীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে, যদিও গভর্নর তা অস্বীকার করেছেন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.৫ এবং মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ। বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি এবং অভ্যন্তরীণভাবে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও অন্যান্য ব্যাংকবহিভর্‚ত ঋণ নেয়া হবে ২৩ হাজার কোটি টাকা।
সরকারি খাতে এমন অধিকমাত্রায় ঋণ গ্রহণ বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহকে সংকুচিত করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঘোষিত মুদ্রানীতির মাধ্যমে সরকারের ব্যয় সংকোচনের সুযোগ কম, উন্নয়নের যে সবাই পরিকল্পনা বাস্তবায়নাধীন এবং যেসব অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হচ্ছে, সেগুলোর অবকাঠামো নির্মাণে সরকারের পক্ষে মাঝ পথে থেমে যাওয়া সম্ভব নয়; তাই উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়নে সরকারকে ঋণ নিতেই হবে, যদিও তা মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিতে পারে। তবে সরকারের অহেতুক ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন করা হলে, প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা আনয়ন করা গেলে, যথাযথ ও ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা অর্জনে তদারকি থাকলে, অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের বাতিক রদ করা সম্ভব হলে সরকারের ঋণ গ্রহণ কমবে।
বর্তমানে অর্থনীতিতে নানা রকমের সংকট চলছে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার এখন ৯.৯৪ শতাংশ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিন দিন কমছে, জ্বালানি সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন, ঘুষ-দুর্নীতি আর অর্থপাচার রোধ করা যাচ্ছে না, বাড়ছে ঋণখেলাপি, বাড়ছে হতদরিদ্র মানুষ, বাড়ছে সরকারের ভর্তুকি এবং সামাজিক সুরক্ষা, বাড়ছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে পক্ষে-বিপক্ষে জোটবদ্ধ করার চাপ। অর্থনীতিবিদের অভিমত, উল্লেখিত বহুবিধ চাপ মোকাবিলায় কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে পরিলক্ষিত হয়নি, তাই মুদ্রানীতির ওপর অনেকে ভরসা করেছেন। কিন্তু সরকারের সম্প্রসারণশীল রাজস্বনীতি ও উন্নয়ন বাজেটের সঙ্গে সমন্বয় করে মুদ্রানীতির প্রণয়ন তত সহজ ছিল না।
তাই বোধ হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে সরকারের রাজস্বনীতি বাহ্যত সাংঘর্ষিক মনে হয়। তবে মূল্যস্ফীতি কমানো জরুরি। আগামী বছর আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হবে; তাই পণ্যমূল্য কমানোর লক্ষ্যে প্রণীত মুদ্রানীতি সাংঘর্ষিক হলেও তা যথার্থ ও সময়োপযোগী। তবে তা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে সেই ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এবারের মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পক্ষে প্রণীত বলে উল্লেখ করা হলেও এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ব্যাপক। কারণ আমাদের টাকার অবমূল্যায়নে পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে অবমূল্যায়নের এ বিরূপ প্রভাব মুদ্রানীতি দ্বারা প্রতিকার করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি হ্রাসে ডলারের একক দর স্থিতিশীল রাখা জরুরি। ক্রমহ্রাসমান রিজার্ভ বিবেচনায় টাকার আরো অবমূল্যায়ন করা হলে কোনো নীতি দ্বারাই মূল্যস্ফীতি রোধ করা যাবে না।
আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু পণ্যের দর কমলেও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে কমছে না। আমাদের দেশে পণ্যের চাহিদা না বাড়া সত্তে¡ও পণ্যের দাম বেড়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য মূল্য বেড়েছে। আমাদের পণ্যের বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নেই, আছে সিন্ডিকেট; এক্ষেত্রে অঢেল পণ্যের জোগান প্রয়োজন, কিন্তু পণ্য আমদানির জন্য পর্যাপ্ত ডলার নেই। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির এ নিয়ামকগুলো মুদ্রানীতি দ্বারা সবসময় নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
জিনিসপত্রের উচ্চমূল্যে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের মানুষ দিশেহারা, হতদরিদ্র মানুষ না খেয়ে উপবাস করছে। তাই এ মুহূর্তে প্রবৃদ্ধির চেয়ে মূল্য নিয়ন্ত্রণ জরুরি। এমন বিবেচনায় বাজারে অর্থের জোগান কমাতে ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সুদহার বাড়ানো হয়েছে। রেপো রেট আগের তুলনায় কিছুটা বাড়িয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়ে লগ্নি করার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর আগ্রহ কমার কথা।
অন্যদিকে রিভার্স রেপো হারও আগের ৪.২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪.৫০ শতাংশ করা হয়েছে। রিভার্স রেপোর সুদহার বৃদ্ধি করার কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ প্রদান না করে বাংলাদেশ ব্যাংকে অর্থ জমা রেখে আমানতে প্রদত্ত সুদের সঙ্গে কিছুটা সমন্বয় করার সুযোগ পাবে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেপো ও রিভার্স রেপো রেটের কার্যকারিতা নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার অবকাশ কম।
সুদহার বাড়ানোর প্রধান উদ্দেশ্য ঋণের জোগান হ্রাস করা; কিন্তু প্রণীত মুদ্রানীতি বাজারে অর্থ প্রবাহ কমাতে পারবে কিনা, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রত্যাশা করছে, সরকারও বেশি সুদে বেশি ঋণ নিতে আগ্রহী হবে না। চলতি অর্থবছরে সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৪০ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে এবং এবারের মুদ্রানীতিতে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৪৩ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ঋণ নেয়ার কথা বলছে। বর্ধিত সুদহার সরকারের কাছে মুখ্য নয়, মুখ্য হচ্ছে অর্থ।
বেসরকারি খাতেও শুধু সুদহার ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির প্রতিবন্ধক নাও হতে পারে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণের সুদহার কম থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব মন্দার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়েনি; লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪.১ শতাংশ, কিন্তু অর্জন হয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ। এবার মুদ্রানীতিতে তা আরো কমিয়ে করা হয়েছে ১০.৯ শতাংশ। তাই সুদহার হ্রাস-বৃদ্ধি করে অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা একটু কঠিন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি হলে বর্ধিত সুদহার ঋণের সংকোচনে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে হয় না। এছাড়া সুদহার বৃদ্ধির কারণে ঋণের খরচ কিছুটা বাড়লেও তা বড় ব্যবসায়ীদের জন্য চ্যালেঞ্জিং নয়, কারণ এর চেয়ে বেশি সুদে ঋণ নিয়ে তারা অভ্যস্ত। তবে সুদহার বাড়ার কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা নিরুৎসাহিত হতে পারে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি যে বিকল্প বাজেট উপস্থাপন করেছে তার আকার ২০ লাখ ৯৪ হাজার ১১২ কোটি টাকা। সমিতি মনে করে, রাজস্ব আয় থেকে ১৯ লাখ ২৯ হাজার ১১২ কোটি টাকা আহরণ করা সম্ভব। অর্থনীতি সমিতির এ উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আদায় পুরোপুরি সম্ভব না হলেও করকাঠামো সংস্কার এবং আধুনিক প্রযুক্তি দ্বারা সমৃদ্ধ করা সম্ভব হলে রাজস্ব আদায় অবশ্যই বাড়বে। আইএমএফও তাই বলেছে।
রাজস্ব আদায় বাড়লে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ হ্রাস পাবে। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নরের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন জরুরি। ঋণখেলাপি হওয়ার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের নির্বাহী প্রধানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়ী করা আরো বেশি জরুরি। সর্বোপরি ঋণপ্রবাহ সংকোচনে প্রকৃত উদ্যোক্তারা যাতে যথাসময়ে হয়রানি ছাড়া ঋণ পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক
ভোরের আকাশ/নি